গার্ডেনরিচ কাণ্ড
মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ দুই নেতার দ্বন্দ্ব
তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্বকে সঙ্কটের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে গার্ডেনরিচ-কাণ্ড। দলের অন্দরে অনেকের মতে যা, শ্যাম রাখি, না কুল রাখি অবস্থা!
প্রশাসনিক সূত্রের মতে, গার্ডেনরিচ এলাকায় দখলদারি নিয়ে আপাতত টানাপোড়েন চলছে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ তৃণমূলের দুই শীর্ষ নেতার মধ্যে। মঙ্গলবারের ঘটনা সেই সংঘাতেরই ফল। মুখ্যমন্ত্রী এ বার তাঁর আস্থাভাজন দুই নেতার মধ্যে কী ভাবে ভারসাম্য রক্ষা করেন, সেটাই দেখার।
হরিমোহন ঘোষ কলেজের নির্বাচন যে উপলক্ষ মাত্র, সেটা স্পষ্ট হয়েছিল মঙ্গলবারই। জানা গিয়েছিল, বন্দর এলাকায় রাজনৈতিক জমি দখল ও তোলাবাজির বখরা আদায়ের লড়াই-ই আসল কারণ। সেই লড়াইয়ের জেরে শাসক দলের অভ্যন্তরে বিভাজনের কথা শোনা যাচ্ছে এলাকায় কান পাতলেই। যে বিভাজনের দুই প্রান্তে রাজ্যের এক প্রভাবশালী মন্ত্রী এবং এক পুরকর্তা।
প্রকাশ্যে তৃণমূলের কেউই অবশ্য গোষ্ঠী বিভাজনের কথা স্বীকার করছেন না। সেই প্রসঙ্গ তুলতেই তা সপাটে উড়িয়ে দিয়েছেন দলের মহাসচিব তথা শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং এলাকার বিধায়ক তথা রাজ্যের পুরমন্ত্রী ফিরহাদ (ববি) হাকিম। যদিও তৃণমূলের স্থানীয় ও রাজ্যের নেতাদের অনেকেই একান্ত আলোচনায় গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের কথা স্বীকার করে নিয়ে বলছেন, মমতা কড়া হাতে রাশ না-টানলে ভবিষ্যতে আরও বড় ঘটনা ঘটতে পারে।
গার্ডেনরিচের ঘটনায় মমতা কড়া অবস্থান নিয়েছেন বলেই দাবি পার্থবাবুর। তাঁর কথায়, “মুখ্যমন্ত্রী পরিষ্কার নির্দেশ দিয়েছেন অভিযুক্তদের গ্রেফতারের ব্যাপারে কোনও রকম শিথিলতা দেখানো হবে না।” তৃণমূলের অন্দরে প্রশ্ন উঠেছে, নিজের আস্থাভাজন নেতাদের বিরুদ্ধে মমতা কতটা ব্যবস্থা নেবেন তা নিয়ে। ওই দুই নেতার এক জনের উপরে কিছু দিন আগে পর্যন্ত বেনজির ভাবে নির্ভরশীল ছিলেন তৃণমূল নেত্রী। পুরকর্তা হয়েও মহাকরণ থেকে জেলা সফর, সর্বত্র মুখ্যমন্ত্রীর ছায়াসঙ্গী ছিলেন তিনি। অন্য জনের প্রতি সাম্প্রতিক অতীতে নজর কাড়ার মতো আস্থা দেখিয়েছেন মমতা। একের পর এক দায়িত্ব দিয়েছেন তাঁর হাতে। দল চালানোর অনেক বিষয়েই মমতা ওই দুই নেতার উপরে নির্ভরশীল।
মুখ্যমন্ত্রী ঘণ্টার পর ঘণ্টা বক্তৃতা করেন। অথচ শাসক
দলের আশ্রিত দুষ্কৃতীর হাতে যখন পুলিশ খুন হলেন,
দু’টো লাইনও বিবৃতি দেওয়ার সময় পেলেন না!

সূর্যকান্ত মিশ্র
রেজিনগরের এক সভায়
তৃণমূলের একাংশের বক্তব্য, গার্ডেনরিচের ঘটনায় মুখ্যমন্ত্রী অত্যন্ত বিরক্ত। কেন পরিস্থিতি মোকাবিলা করা গেল না, সেই প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী নিজে মুখ খুললেন না কেন? তৃণমূল সূত্রের ব্যাখ্যা, তাতে দলের গোষ্ঠী দ্বন্দ্ব নিয়ে জল্পনার সুযোগ আরও বাড়ত। তাই নিঃশব্দে ধীরে ধীরে আস্থাভাজন নেতাদের কোণঠাসা করার কথা ভাবছেন তিনি। রাজ্যপালের সঙ্গে বাকযুদ্ধের পরে ঠিক যেমনটা করা হয়েছে সুব্রত মুখোপাধ্যায়কে।
বন্দর এলাকায় তৃণমূলের গোষ্ঠী বিন্যাসটা কী রকম? স্থানীয় সূত্রের খবর, ১৫ নম্বর বরোর চেয়ারম্যান মহম্মদ ইকবাল ওরফে মুন্না ভাই ও মেয়র পারিষদ সামসুজ্জামান আনসারির অধীনে তৃণমূল কর্মীরা দু’টি গোষ্ঠীতে ভাগ হয়েছে অনেক দিনই। মুন্না পুরমন্ত্রীর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। তাকে কেন পুলিশ গ্রেফতার করছে না, এই প্রশ্ন ওঠায় মহাকরণে এ দিন ফিরহাদ বলেন, “মহম্মদ ইকবাল ওই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত আমি বিশ্বাস করি না।’’ তৃণমূলের একাংশের মতে, “ববির এ কথা বলা ছাড়া উপায় নেই।
কারণ মুন্নার খাসতালুক ববির নির্বাচনী কেন্দ্রের মধ্যেই পড়ে। ববিকে ঘিরেই এলাকায় নিজের রমরমা বাড়িয়েছে মুন্না। ববিও তার উপর নির্ভরশীল।”
মুন্না প্রয়াত কংগ্রেস নেতা মোগল ওরফে মহম্মদ জাহাঙ্গিরের দাদা। বন্দর এলাকায় কলকাতা পুরসভার ১৩৩ থেকে ১৩৬ নম্বর ওয়ার্ডের একচ্ছত্র অধিপতি ছিলেন মোগল। ২০০১-এর ফেব্রুয়ারিতে তিনি খুন হন। তার পরই এলাকা সিপিএমের মোক্তার আহমেদের দখলে চলে যায়। তাঁকে ঠেকাতে পুর ভোটে মুন্নাকে প্রার্থী করে তৃণমূল। তিনি ১৩৪ নম্বর ওয়ার্ডে জেতেন। বন্দর এলাকা চলে আসে তৃণমূলের দখলে। মোগলের অনুগামীরা ফের তৎপর হয়। তাদের সঙ্গে নিয়ে ক্রমশ শক্তিশালী হতে থাকে ইকবাল ওরফে মুন্না। হাওয়া ঘুরছে বুঝতে পেরে মোক্তারের অনুগামীরাও অনেকে তার দলে চলে আসে। যেমন ইবনে। সিপিএম ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দেয় সে।
এলাকায় সিপিএমের দাপট কমছে বুঝে বিধানসভা ভোটের পর কংগ্রেসে যোগ দেন মোক্তার। ইকবালের সঙ্গে শুরু হয় তাঁর ঠান্ডা লড়াই। ইতিমধ্যে মোক্তারের সঙ্গে সামসুজ্জামান আনসারির পরিবারের একটা বৈবাহিক সম্পর্ক তৈরি হয়। তৈরি হয় নয়া সমীকরণ। সামসুজ্জামান গোড়া থেকেই মুন্নার বিরোধী ছিলেন। তাঁকে মদত দেন ববি-বিরোধী ওই পুরকর্তা। মোক্তার পাশে আসার পরে সামসুজ্জামানের জোর বাড়ে। যার জেরে বছর দেড়েক ধরে মাঝে মধ্যেই এলাকা দখলের লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়ছিল দুই গোষ্ঠীর অনুগামীরা। মঙ্গলবার তা চরম আকার নেয়।
বুধবার দুপুরে বরো অফিসে বসে ইকবাল ওরফে মুন্না বলেন, “ওরা (দুষ্কৃতীরা) সিপিএম করত। পরে যোগ দেয় আমাদের দলে। আমি আপত্তি করেছিলাম। কিন্তু দলের চাপে ওদের সঙ্গে রাখতে বাধ্য হয়েছি। ওরা কেন গুলি চালাল বলতে পারব না। আমিই তো ফেঁসে গেলাম।” এলাকা দখলের লড়াইয়ে তিনি নেই বলে দাবি করে ইকবাল বলেন, “আমি ব্যবসাদার। আমার তোলাবাজির প্রয়োজন নেই।” এলাকা দখল নিয়ে ইকবালের সঙ্গে তাঁর বিরোধ নেই বলে দাবি করেছেন মোক্তারও। দু’জনেরই বক্তব্য, ভোট যাতে শান্তিতে হয় তা নিশ্চিত করতেই তাঁরা কলেজের সামনে গিয়েছিলেন।
ইকবাল-মোক্তার মুখে যা-ই বলুন এলাকা দখলের রাজনীতির শিকড় যে অনেক দূর পর্যন্ত পৌঁছেছে তার ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছে স্থানীয় এক তৃণমূল নেতার কথায়। তিনি জানান, মোক্তারকে ফাঁসানোর পরিকল্পনা হয়েছেল দু’দিন আগেই। ওই নেতার কথায়, “গোলমাল বাধিয়ে দলেরই এক তৃণমূল সমর্থককে খুন করার ছক কষা হয়েছিল। আর সেই দোষ চাপানো হতো কংগ্রেসের মোক্তারের উপর। কিন্তু সব কিছু ওলটপালট হয়ে যায় বুলেটের নিশানায় থাকা তাহির হোসেন আচমকা সরে যাওয়ায়।”
তাহিরের বাঁ হাত ছুঁয়ে যাওয়া গুলিতেই প্রাণ গিয়েছে এসআই তাপস চৌধুরীর। খিদিরপুরের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তাহির বলে, “আমাকে কেন মারতে গেল, বুঝতে পারছি না। আমি তো তৃণমূলকে সমর্থন করি। হয় তো ‘মিসটেক’ হয়ে গিয়েছে। আমাকে হয়তো মোক্তারের লোক ভেবেছে। আমি শেখ সুহানকে চিনি না। কে গুলি চালিয়েছে, তা-ও দেখতে পাইনি।”
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.