|
|
|
|
পচনন্দার চেষ্টাতেও বাড়ল কি মনোবল |
নিজস্ব সংবাদদাতা |
খুনিকে ধরতে পারলেই ২ লক্ষ টাকা ইনাম। ঘোষণা করেছিলেন খোদ কলকাতার পুলিশ কমিশনার। তাঁর নির্দেশ পাওয়ার দেড় ঘণ্টার মধ্যে কাজটা সেরে ফেলেন তাপস চৌধুরীর সহকর্মীরা। যদিও ইনাম নিতে তাঁরা কেউ রাজি হননি।
কয়েক ঘণ্টা আগেই কিন্তু এর উল্টো ছবি দেখেছে গার্ডেনরিচ থানা। দুই দুষ্কৃতীর এক জন, শেখ সুহানকে হাতেনাতে ধরে ফেলেছিলেন পুলিশরা। কিন্তু পুলিশের অভিযোগ, রীতিমতো শাসানি দিয়ে তাঁদের হাত থেকে সুহানকে ছাড়িয়ে নিয়ে যান ইকবাল, যিনি ১৫ নম্বর বরোর চেয়ারম্যান এবং এলাকায় তৃণমূলের প্রভাবশালী নেতা। আরও অভিযোগ, হুমকি দেওয়ার সময় তিনি রাজ্যের মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের কথাও বলেন।
কী হয়েছিল তখন? |
নিহতের পরিবারের কাছে পুলিশ কমিশনার। |
পুলিশ সূত্রের খবর, এসআই তাপস চৌধুরী গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়ার পর হকচকিয়ে গিয়ে তৃণমূল ছাত্র পরিষদ ও ছাত্র পরিষদ দু’পক্ষই সাময়িক ভাবে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। কিছু ক্ষণের মধ্যেই যুগ্ম কমিশনার ও বন্দর ডিভিশনের ডেপুটি কমিশনার ঘটনাস্থলে পৌঁছন। তখন ইকবাল এগিয়ে যান তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে। তাঁর অন্য শাগরেদদের সঙ্গে ছিল শেখ সুহানও। পুলিশ সূত্রের খবর, হঠাৎই তাকে দেখিয়ে র্যাপিড অ্যাকশন ফোর্স (র্যাফ)-এর ইনস্পেক্টর মিলনকুমার দাম চেঁচিয়ে ওঠেন, “এই ছেলেটা ছিল স্যার। এ-ও গুলি চালিয়েছিল।” সঙ্গে সঙ্গে সুহানকে ধরে ফেলে পুলিশ। ওই মিলনকুমার দামই তাপস চৌধুরীর নিহত হওয়ার ঘটনায় রুজু হওয়া খুনের মামলার অভিযোগকারী।
লালবাজার সূত্রের খবর, এর পরেই মিলনবাবুকে ধমক দিয়ে ইকবাল বলে ওঠেন, “কে আপনি বড় অফিসার এসেছেন? চাকরি খেয়ে নেব। একটা ভাল ছেলেকে আপনারা মিছিমিছি ধরছেন? ববিকে (ফিরহাদ হাকিম) এখনই ডাকছি।” এর মধ্যেই সুহানকে ছিনিয়ে নিয়ে যায় ইকবালের দল। এক সাব-ইনস্পেক্টরের কথায়, “আমরা তখন পুরোপুরি বিভ্রান্ত। অভিযুক্তদের আদৌ ধরা যাবে কি না, সেটাও পুরোপুরি বুঝতে পারছিলাম না।” শেষমেশ ওই বিভ্রান্তি দূর করতে আসরে নামেন পুলিশ কমিশনার স্বয়ং। কলকাতার এক পুলিশকর্তা বলেন, “হাসপাতালে পুলিশ কমিশনার বিক্ষোভের মুখে পড়ায় প্রমাদ গোনে লালবাজার। ঠিক হয়, অবিলম্বে বাহিনীর মনোবল ফেরাতে হবে।”
মনোবল কি ফিরল?
সুহান-ইবনেকে ধরতে পেরে পুলিশের একাংশ কিছুটা খুশি হয়েছেন ঠিকই, কিন্তু তাঁদের বক্তব্য, সামগ্রিক ভাবে রাজনীতির গোলামি বন্ধ করতে না পারলে পরিস্থিতি বদলাবে না। এক ইনস্পেক্টর বলেন, “শাসক দলের প্রতি আমাদের পক্ষপাতিত্ব অনেক ক্ষেত্রেই থাকে। কিন্তু তা বলে এই ভাবে নির্লজ্জ গোলামি?” পুলিশমহলের একাংশ অবশ্য বলছে, এই ট্র্যাডিশন অনেকটাই সিপিএম আমল থেকে পাওয়া। গার্ডেনরিচের মতো এলাকা, যেখানে জমি দখলের লড়াই বরাবরই ভয়ঙ্কর হয়ে থাকে, সেখানে দীর্ঘদিন ধরে যুদ্ধটা ছিল শাসক বামফ্রন্ট এবং বিরোধী কংগ্রেসের মধ্যে। পরে সেই
সমীকরণ বদলেছে। জমানা বদলের পরে সিপিএম আশ্রিত দুষ্কৃতীরা তৃণমূলে যোগ দিয়েছে বলে অভিযোগও রয়েছে। দাপট বেড়েছে তৃণমূল নেতাদের। তাঁর কথায়, “সেই জোরেই ইকবাল আঙুল তুলে শাসাতে পারেন। সুহানকে জোর করে ছাড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে তাঁর দলবল।” |
সমুদ্রসৈকতে মুখ্যমন্ত্রী। বুধবার। |
এই জমানায় কী হয়েছে, তার দৃষ্টান্ত দিতে গিয়ে ওই ইনস্পেক্টর বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী থানায় চড়াও হয়ে অভিযুক্তদের ছাড়িয়ে নিয়ে যাবেন, শাসক দলের বিরুদ্ধে রিপোর্ট দিলে আইপিএসকে বদলি করে দেওয়া হবে এ সব ক্রমাগত সহ্য করার পরিণতিই কিন্তু মঙ্গলবারের গার্ডেনরিচের ঘটনা।” যা কি না পুলিশকর্মীরই প্রাণ নিল।
সেই নিয়ে ক্ষোভ সামলাতেই রঞ্জিতকুমার পচনন্দা উদ্যোগী হয়েছেন। মঙ্গলবার বিকেলেই তিনি নির্দেশ দেন, অপরাধ করলে শাসক দলেরও কাউকে যেন রেয়াত করা না হয়। তাতেও কিন্তু আগুনটা পুরোপুরি নেভেনি। উল্টে তাঁরা প্রশ্ন তুলছেন, “লালবাজারের শীর্ষমহল দিনের পর দিন শাসক দলের চাপ বরদাস্ত করলেন কেন? এখন পালে বাঘ পড়েছে বলে তাঁরা অন্য রকম বলছেন।”
এ দিনও গার্ডেনরিচের ঘটনা নিয়ে কলকাতা সশস্ত্র পুলিশের সদর দফতর বডিগার্ড লাইন্সে বিক্ষোভ দেখান এক দল পুলিশ। তাঁদের বক্তব্য, নেতাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে না। এতে পুলিশ নিরাপত্তার অভাব বোধ করছে। নিরাপত্তাহীনতার কথা শোনা গিয়েছে তাপস চৌধুরীর স্ত্রীর মুখেও। মুখ্যমন্ত্রী এখনও তাঁদের বাড়িতে এলেন না কেন, সে প্রশ্নও তিনি তুলেছেন।
মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠমহল অবশ্য বলছে, পুলিশ অফিসারের নিহত হওয়ার খবর শুনে মঙ্গলবার তিনি খেজুরি না-গিয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে কলকাতা ফিরতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁকে বলা হয়, হাজার হাজার মানুষ খেজুরিতে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে। পুলিশকর্মীদের একাংশের প্রশ্ন, মুখ্যমন্ত্রী যদি সত্যিই এই ব্যাপারে আন্তরিক হতেন, তা হলে মঞ্চে উঠে শোকপ্রকাশ করলেন না কেন? তার পরে চলে গেলেন দিঘা। সেখান থেকে এ দিনও ফিরলেন না। নিহত পুলিশ অফিসারের পরিবারকে দু’লক্ষ টাকার ক্ষতিপূরণের নিয়েও ক্ষোভ রয়েছে পুলিশমহলে। তাঁদের বক্তব্য, “বিষমদ খেয়ে যারা মরেছে, তাদের দু’লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দিয়েছিল মমতার সরকার। আর নিহত এসআইয়ের পরিবারকেও একই টাকা! এ তো মুড়ি-মিছরি এক করে দেওয়া হল!”
ক্ষোভ রয়েছে অস্ত্র বহনে নিয়ন্ত্রণ নিয়েও। মগরাহাটে বেআইনি হুকিং রুখতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে দু’জন প্রাণ হারান। তার পরে ঠিক হয়, পুলিশ কাজে যাবে শুধু লাঠি, হেলমেট ও কাঁদানে গ্যাস নিয়ে। আগ্নেয়াস্ত্রধারী পুলিশের দরকার হলে সেই দলটি থাকবে তফাতে। তাঁদের দায়িত্বে থাকবেন আলাদা এক জন অফিসার। এক ইনস্পেক্টরের কথায়, “গার্ডেনরিচেও সশস্ত্র পুলিশের দলটি ছিল হরিমোহন ঘোষ কলেজ থেকে কিছুটা দূরে। কিন্তু লাঠিধারী পুলিশকেও তো নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়েছিল!”
|
নিচু তলার উদ্বেগ |
• বেলা সাড়ে ১২টা
হাজরা মোড়:
যার গেল তার গেল। আমাদেরও এভাবেই
যেতে হবে!
• বেলা ২টো
ব্যাঙ্কশাল কোর্ট: ঢাল-লাঠি নিয়ে কি বিক্ষোভ সামাল দেওয়া যায়!
• বিকেল ৪টে
লর্ড সিন্হা রোড,
আইবি অফিস: এত পুলিশের সামনে অফিসারকে গুলি করে দিল! |
|
|
|
কেন তলানিতে |
• মুখ্যমন্ত্রীর উপস্থিতিতে ভবানীপুর থানা থেকে দুষ্কৃতীদের ছাড়ানো
• বিক্ষোভ থামাতে পুলিশকে শুধু লাঠি-ঢাল ব্যবহারের নির্দেশ
• কলেজ ভোটে তৃণমূলের কথা না শোনায় পাটুলি থানার ওসি বদলি
• আমেরিকান সেন্টারের সামনে পুলিশকর্তা মার খেলেও চুপ করে থাকা
• তৃণমূলের পুলিশ-নেতা তারক দাসের নামে রিপোর্ট দিয়ে ডিসি বদলি
• পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণকাণ্ডে তদন্ত চলাকালীন দময়ন্তী সেন বদলি
• মন্ত্রী মদন মিত্রের ঘোষণা, “ওসি-কে কানের গোড়ায় মারব বলেছিলাম।”
• বইমেলায় রুষ্ট মুখ্যমন্ত্রী মন্তব্য, “আপনাদের চাবকানো উচিত।”
• থানায় পুলিশের গায়ে চিলি চিকেন ঢেলেও তৃণমূল নেত্রীর পার পাওয়া |
|
—নিজস্ব চিত্র |
|
|
|
|
|