কেউ চুটিয়ে অভিনয় করছেন, কেউ ক্রিকেট খেলছেন, গল্ফ খেলছেন, সমাজসেবা করে দিব্যি হইহই করে বাঁচছেন। নিজেদের জীবনে মারণরোগের সত্যকে তাঁরা অস্বীকার করেননি। তা বলে তার কাছে আত্মসমর্পণও নয়। বরং সেই সত্যকে দাবিয়ে রেখে তাঁরা নিরন্তর ছড়িয়ে দিচ্ছেন এক অমোঘ জীবনবোধ— যার নাম, বাঁচার মতো বেঁচে থাকা।
এর মধ্যে বিশিষ্টেরা যেমন আছেন, তেমন রয়েছেন সাধারণ চাকরিজীবী, পেশাদারেরা। কেউ রাজ্যেই চিকিৎসা করিয়েছেন, কেউ ভিন্ রাজ্যে কেমোথেরাপি করিয়েছেন, কেউ চিকিৎসার জন্য বিদেশের ক্লিনিকের দ্বারস্থ হয়েছেন, কেউ বা কেমোথেরাপি-রেডিওথেরাপির সঙ্গে নতুন ‘সোরিনাম থেরাপি’ করিয়েছেন। কিন্তু একটা জায়গায় তাঁদের অদ্ভুত মিল, তা হল জীবনীশক্তি ‘লড়াই ছাড়ব না। হার মানব না।’ ক্যানসারের মতো মারণ রোগ যে জীবনীশক্তির কাছে নতজানু।
|
এক কালের দাপুটে সিপিএম নেতা, বর্তমানে পিডিএস এবং প্রাক্তন সাংসদ সৈফুদ্দিন চৌধুরী সোমবার নিজের বেলগাছিয়ার ফ্ল্যাটে সাংবাদিক সম্মেলন করে শুনিয়েছেন সেই হার না-মানা যুদ্ধের কথা। বছর দুয়েক আগে, ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে গলার একটা গ্ল্যান্ডে ক্যানসার ধরা পড়ে। চিকিৎসা চলতে চলতেই তা ছড়িয়ে পড়ে হাড়ে, তার পরে থাবা বসায় মস্তিষ্কে। চিকিৎসার ভাষায়, স্টেজ ফোর ক্যানসার। সৈফুদ্দিনের কথায়, “কখনও মনে হয়নি যে, মরে যাব। একটুও আতঙ্ক হয়নি। ক্যানসার তার কাজ করছে। আমি ঠিক করি, পড়ে থেকে থেকে মৃত্যুর দিকে এগোব না। আমার মতো করে যতখানি প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব, গড়ব।”
কেমোথেরাপি-রেডিওথেরাপির পরে পার্শ্বপ্রক্রিয়ায় মুখে এমন ঘা হল যে, এক ফোঁটা জল গিলতে আধঘণ্টা সময় লাগত। এখন ‘সোরিনাম থেরাপি’ বলে একটা নতুন ধরনের চিকিৎসা-পদ্ধতির ভিতরে আছেন। অনুুপ মজুমদার, অর্ণব গুপ্ত, আশিস মুখোপাধ্যায়ের মতো অনেক চিকিৎসক যদিও এই পদ্ধতি নিয়ে সন্দিহান এবং এতে ঠিক কোন গোত্রের ওষুধ ব্যবহার হয়, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। তবে সৈফুদ্দিন জানান, তাঁর ক্যানসার আর নতুন করে কোষে ছড়াচ্ছে না।
নাট্যকর্মী চন্দন সেনের অনুভূতি আরও সোজা, “আমার কাছে যখন আর কোনও বিকল্প নেই, তখন রোগের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে লড়তে চাই। আমার কথা হল, সময় নষ্ট না-করে লড়াইয়ে নেমে পড়তে হবে। তার মাঝখানে সাপ্টেসুপ্টে উপভোগ করতে হবে জীবনকে।” কয়েক বছর চিকিৎসায় আছেন এবং এখন আগের মতোই মঞ্চে, সিনেমায়। |
|
|
সৈফুদ্দিন চৌধুরী ও চন্দন সেন। |
|
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের বয়স এখন ৭৯। রোগ ধরা পড়ার পরে তিনি চিকিৎসা করিয়েছেন দেশে এবং বিদেশে। তিনিও তাঁর নিজের এই লড়াইয়ের অনেকটা কথা প্রকাশ্যে, অকপটে জানান তাঁর আত্মজীবনীমূলক নাটক ‘তৃতীয় অঙ্ক অতএব’-এ। তবে নিজের এই লড়াইকে কখনই ‘মহান’ করে দেখাতে চান না এই শিল্পী। বরং কিছুটা সংযমী প্রতিক্রিয়া তাঁর, “যে যাঁর নিজের মতো করে লড়েন। কেউ পারেন, কেউ পারেন না। আমার তো তেমন মনের জোর নেই। চারপাশের পরিস্থিতি আমাকে অনেকটা সাহায্য করেছে বলে পেরে যাচ্ছি।” পেরেছেন আরও অনেকে। আমেরিকা থেকে অস্ত্রোপচার করিয়ে আসার ছ’মাস পরে ক্রিকেট মাঠে ফিরেছেন যুবরাজ সিংহ। আছেন অনুরাগ বসু, অজয় গুপ্ত, লিজা রায়, উলা গ্রেনস্ট্রোমাররা। সুইডেন থেকে কলকাতায় এসে অস্ত্রোপচারের করিয়ে ফের দেশে ফিরেছিলেন উলা গ্রেনস্ট্রোমার। চার মাসের মাথায় গল্ফ খেলা শুরু করেছেন তিনি। মৃত্যুভয়কে দশ গোল দিয়ে জীবনকে জিতিয়ে দিয়েছেন তাঁরা সকলেই। |