ক্ষমতায় এসেছিলেন ‘আমরা-ওরা’র ব্যবধান মোছার প্রতিশ্রুতি দিয়ে। কিন্তু মহাকরণে বসে যত দিন যাচ্ছে, নিজের প্রশাসনেই রাজনীতির রং আবিষ্কার করছেন মুখ্যমন্ত্রী বন্দ্যোপাধ্যায়!
পঞ্চায়েত ভোটের আগে এ বার মুখ্যমন্ত্রীর অভিযোগ, কৃষি দফতরে অনেক সিপিএম সমর্থক আধিকারিক রয়েছেন। তাঁরা উন্নয়নের কাজ বন্ধ করতে চান। সেই কারণেই তাঁরা জনতার সঙ্গে অসহযোগিতা করেন! এর আগে নদিয়ার হরিণঘাটায় গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী অভিযোগ করেছিলেন, সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে যাঁরা কাজে ফাঁকি দেন, তাঁরা সবাই সিপিএম! এ বার দক্ষিণ ২৪ পরগনায় গিয়ে রাজ্যের কৃষি দফতরের আধিকারিকদের মধ্যে সিপিএম সমর্থকদের চিহ্নিত করে সরাসরি তোপ দেগেছেন সরকারি মঞ্চ থেকেই!
ভাঙড়ের চণ্ডীপুরে সোমবার একটি সংখ্যালঘু মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের শিলান্যাস অনুষ্ঠানে সংখ্যালঘু ও কৃষি উন্নয়ন প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মন্তব্য করেছেন, “ব্লক কৃষি আধিকারিক অনেক সময় বলবেন, টাকা নেই। এটা দিতে পারব না। ওটা দিতে পারব না। এমন হলে বিডিও-কে অভিযোগ করুন। সিপিএম সমর্থক বহু অফিসার রয়েছেন। আমাদের প্রশাসনে বসে রয়েছেন! তাঁরা উন্নয়ন বন্ধ করতে চাইছেন!”
মুখ্যমন্ত্রী এ ভাবে নিজের প্রশাসনের কর্মীদের উপরেই অনাস্থা প্রকাশ করায় অশনি সঙ্কেত দেখছে রাজ্যের প্রশাসনিক মহলের একাংশ। তাদের মতে, প্রশাসনিক প্রধান হিসাবে মুখ্যমন্ত্রী এক বিপজ্জনক প্রবণতার জন্ম দিচ্ছেন। জনরোষের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিচ্ছেন সরকারি আধিকারিকদের! প্রকাশ্য সভায় দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রী এমন কথা বলার পরে সরকারি দফতরে গিয়ে কোনও কারণে পরিষেবা পেতে সমস্যা হলে জনতার ক্রোধ আধিকারিক-কর্মীদের উপরে গিয়ে পড়তেই পারে। কখনও কোথাও কোনও প্রশাসক নিজের আওতাধীন কর্মীদের সম্পর্কে এমন কথা বলেছেন কি না, তা নিয়েই প্রশ্ন উঠে গিয়েছে প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক শিবিরে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উত্তরবঙ্গের এক কৃষি আধিকারিকের মন্তব্য, “এ বার তো জনতার হাতে মার খেতে হবে।” |
ভাঙড়ের সভায় মাছের চারা উপহার মুখ্যমন্ত্রীর। সোমবার রাজীব বসুর তোলা ছবি। |
কর্মী-আধিকারিকদের এই আশঙ্কা সরকার সম্পর্কেই তাঁদের বিরূপ মনোভাব তৈরি করতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রশাসনিক মহলের। যার প্রভাব পড়তে পারে তাঁদের কাজে। যার ফল ভুগতে হবে সাধারণ মানুষকেই। আবার নির্ভয়ে সুষ্ঠু পরামর্শ দিতেও দ্বিধাগ্রস্ত হবেন সরকারি আমলারা। পাছে তাতে ‘সিপিএম সমর্থক’ বলে চিহ্নিত হয়ে যেতে হয়!
মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য নিয়ে স্বভাবতই প্রশ্ন তুলেছে বিরোধীরা। সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মহম্মদ সেলিম যেমন বলেছেন, “মুখ্যমন্ত্রী স্বপ্নেও সিপিএমের ভূত দেখছেন! যেখানে সেখানে সিপিএমের ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছেন! কোনও দায়িত্বশীল প্রশাসকই তাঁর প্রশাসনে কর্মরত ব্যক্তিদের সম্পর্কে এমন কথা বলতে পারেন না। নিজেদের অপদার্থতা, অদক্ষতা আড়াল করার জন্য এখন ওঁরা সরকারি কর্মীদের দোষারোপ করতে শুরু করেছেন।” তাঁর আরও বক্তব্য, “ওঁরাই তো বলেছিলেন, আমরা-ওরা দেখবেন না! এখন নিজের প্রশাসনে আমরা-ওরা দেখছেন!”
পঞ্চায়েত ভোটের পর পঞ্চায়েতের বিভিন্ন অফিসারের পদোন্নতির প্রতিশ্রুতিও এ দিন দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, “পঞ্চায়েতের অনেক অফিসারের প্রোমোশনের বিষয়টি নিয়েও আলোচনা করছি। ওঁদের প্রোমোশন দেওয়া হবে।” ভোটের আগে সরকারি অফিসাদের খুশি করতেই এই প্রতিশ্রুতি বলে অনেকের মত। একই মঞ্চ থেকে মুখ্যমন্ত্রী সরাসরি বলেছেন, “পঞ্চায়েত নির্বাচনে আমার পাশে এসে দাঁড়ান। আমার নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়! আমি মানুষের জন্য কাজ করি। দুর্নীতিমুক্ত পঞ্চায়েত গড়তে চাই। উন্নয়ন হবে। আগামী পাঁচ বছরে রাজ্যের সব রাস্তা চকচক করবে। আমার উপর আস্থা রাখুন! বাংলাকে কোথাও যেতে হবে না। সবাই বাংলায় আসবে।”
|
ব্লক কৃষি আধিকারিক অনেক সময় বলবেন, টাকা নেই। সিপিএম সমর্থক বহু অফিসার রয়েছেন। তাঁরা উন্নয়ন বন্ধ করতে চাইছেন!
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, মুখ্যমন্ত্রী |
|
ক’দিন আগেই দার্জিলিঙে সরকারি অনুষ্ঠানে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার সমর্থকেরা গোর্খাল্যান্ড প্রসঙ্গ তোলায় মুখ্যমন্ত্রী ধমক দিয়েছিলেন, সরকারি অনুষ্ঠানের মঞ্চ থেকে রাজনীতি করা উচিত নয়। কিন্তু তিনি নিজেই নিয়মিত ভাবে সেই কাজ করে চলেছেন। এ দিনও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
বিরোধী সিপিএমকে হুঁশিয়ারি দিয়ে সরকারি মঞ্চ থেকে মুখ্যমন্ত্রীর এ দিনের মন্তব্য, “আমার নামে কুৎসা করবেন না! আমি লড়াই করতে জানি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেখানে যায়, সোনা ফলায়! আপনারা কেটে পড়ুন!” সিপিএমের দক্ষিণ ২৪ পরগনার জেলা সম্পাদক সুজন চক্রবর্তীর প্রতিক্রিয়া, “সরকারি অনুষ্ঠান থেকে মুখ্যমন্ত্রী বিরোধীদের সম্পর্কে লাগাতার কুৎসা করে চলেছেন। সেই কারণে মুখ্যমন্ত্রীর অনুষ্ঠানে আর মানুষ আসছেন না। মানুষ সিপিএমের সভায় আসছেন।”
পাঁচ হাজারের বেশি মানুষের জমায়েত হয়েছিল এ দিনের অনুষ্ঠানে। উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা থেকে তৃণমূল সমর্থকেরা ওই অনুষ্ঠানে এসেছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী জানান, ভাঙড় লাগোয়া ভেড়িগুলিতে পর্যটনকেন্দ্র তৈরির কথা ভাবা হচ্ছে। তাঁর কথায়, “কয়েক দিন পর ফের জেলায় আসব। ডায়মন্ড হারবারে মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিলান্যাস করব। তার পর আবার আসব। সমুদ্র এলাকায় পর্যটন শিল্প করার পরিকল্পনা নেব।”
|