|
|
|
|
কুম্ভে মৃত বেড়ে ৩৬, তুঙ্গে দ্বন্দ্ব |
গৌতম চক্রবর্তী • প্রয়াগ
অনমিত্র সেনগুপ্ত • নয়াদিল্লি |
ইলাহাবাদ স্টেশনে পদপিষ্ট হয়ে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ৩৬। এখনও শনাক্ত হয়নি ১৬টি দেহ। আহত আরও ৩৯ জন বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি। কয়েক জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
প্রয়াগে গোটা দেশের লোকসংখ্যার প্রায় তিন শতাংশের কাছাকাছি মানুষের সুষ্ঠু ভাবে শাহীস্নানের ব্যবস্থা করতে গিয়ে চেষ্টার কসুর করেনি অখিলেশ সিংহের সরকার কিংবা রেল মন্ত্রক। দাবি করা হয়েছিল, সমন্বয় রেখে কাজ করবে দু’পক্ষই। কিন্তু শুরুটা ভাল হয়েও শেষ বেলায় ইলাহাবাদ স্টেশনের মৃত্যু-মিছিল বহু প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। দুর্ঘটনার দায় স্বীকার করে কুম্ভমেলা কমিটির প্রধানের পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছেন উত্তরপ্রদেশের নগরোন্নয়ন মন্ত্রী আজম খান। এটুকু বাদ দিলে ঘটনার পর সমন্বয় তো দূর, সমাজবাদী পার্টি ও কংগ্রেস নেতৃত্ব, তথা রাজ্য সরকার ও রেল মন্ত্রকের মধ্যে শুরু হয়ে গিয়েছে তরজা। মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ বলেছেন, “দুর্ঘটনার জন্য কে দায়ী, আমি জানি।” তার উত্তরে রেলমন্ত্রী পবন বনশল ইলাহাবাদ এসে বলেছেন, “রেলকে দায়ী করার কোনও কারণ নেই।”
যদিও মৃত ও আহত যাত্রীদের জন্য রেল ও রাজ্য সরকার আলাদা আলাদা ভাবে ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করেছে। অখিলেশ যেমন তদন্ত কমিটি গড়েছেন, তেমনই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন বনশলও। আটকে থাকা যাত্রীদের বাড়ি পৌঁছে দিতে আরও বেশি বিশেষ ট্রেন চালানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন রেলমন্ত্রী। তাতে অবশ্য রাজ্যের আক্রমণ বন্ধ হয়নি। সপা নেতা রামাশ্রয় কুশওয়ার সরাসরি অভিযোগ, “দুর্ঘটনার সব দায় কেন্দ্রের। কারণ, রেল মন্ত্রক কেন্দ্রের অধীনে।” তাঁদের দাবি, রেলকে আগেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, মৌনী অমাবস্যায় শাহীস্নান করতে প্রায়ে সাড়ে তিন কোটি মানুষ ইলাহাবাদ আসছেন, যাঁদের যাদের অধিকাংশেরই যাতায়াতের ভরসা রেল। তা সত্ত্বেও স্টেশনে সেই মাপের পরিকাঠামো ও পর্যাপ্ত পুলিশি ব্যবস্থা দিতে ব্যর্থ হয়েছে রেল। আবার উত্তরপ্রদেশের কংগ্রেস নেতৃত্বের পাল্টা অভিযোগ, আইন-শৃঙ্খলার দায়িত্ব রাজ্যের। |
 |
এ ভাবেই বাড়ি ফেরার চেষ্টা করছেন কুম্ভ-ফেরত পুণ্যার্থীরা। সোমবার ইলাহাবাদ স্টেশনে। ছবি: রয়টার্স |
স্টেশনে কখন কত পুলিশ থাকবে, রেলের আরপিএফ ও রাজ্যের জিআরপি-র মধ্যে সমন্বয় গড়ে রাজ্যই তা ঠিক করেই উঠতে পারেনি। পূণ্যার্থীদের জন্য সড়কপথে যাতায়াতের কোনও ব্যবস্থা করা হয়নি। ফলে পুরো চাপ এসে পড়ে রেলের ঘাড়েই।
এই অভিযোগের প্রেক্ষিতে সপা নেতৃত্বের জবাবও তৈরি। তাঁরা বলছেন, ভিড় সামলাতে সঙ্গমের কাছাকাছি রামবাগ, দারাগঞ্জ, নৈনি, সুবেদারগঞ্জের মতো স্টেশনগুলিকেও ব্যবহার করা উচিত ছিল রেলের। তা না করে গোটা ট্রেন পরিচালন ব্যবস্থাটি ইলাহাবাদ ভিত্তিক করাতেই দুর্ঘটনার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। সপার এক নেতার কথায়, “একটি স্টেশন থেকে কেবলমাত্র একটি নির্দিষ্ট গন্তব্যের ট্রেন ছাড়ার ব্যবস্থা করলেই ভিড়টা ভাগ হয়ে যেত। তা হলে এই পরিস্থিতি হত না।” সপা নেতৃত্বের দাবি, কুম্ভমেলার পরিকাঠামো খাতে উত্তর-মধ্য রেলকে যে আড়াইশো কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল, তার নয়ছয় হয়েছে। ইলাহাবাদ স্টেশনে সম্প্রতি একটি এসক্যালেটর বসানো হয়। কিন্তু তার চেয়েও জরুরি ছিল ভাঙা ওভারব্রিজের মেরামতি। দুর্ঘটনার সময়ে স্টেশনে কমপক্ষে দু’থেকে আড়াই লক্ষ পূণ্যার্থীর ভিড় ছিল। অথচ তিনটি ওভারব্রিজের একটি বন্ধ থাকায় যাত্রীদের চাপ পুরোপুরি এসে পড়ে স্টেশনের মাঝামাঝি জায়গার ওভারব্রিজটিতে। সেটি থেকে ৬ নম্বর প্ল্যাটফর্মে ওঠানামার সিঁড়িই রবিবারের বিপর্যয়ের উৎসস্থল। তবে দুর্ঘটনা ঠিক কী ভাবে ঘটল, তার ব্যাখ্যা এক-এক জন এক-এক ভাবে দিয়েছেন।
সমস্যার সূত্রপাত হয় সন্ধ্যা পৌনে সাতটা নাগাদ। সে সময়ে পটনাগামী একটি কুম্ভ স্পেশ্যালের ছাড়ার কথা ছিল ৫ নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে। শেষ মুহূর্তে সেটিকে ৬ নম্বরে ঘোষণা করা হয়। ‘যাঁদের টিকিট নেই, তাঁরা ৬ নম্বর প্ল্যাটফর্মের ট্র্রেনে উঠতে পারবেন’ এমন একটি ঘোষণাও নাকি হয়েছিল। রেলকর্তারা অবশ্য এ কথা অস্বীকার করেছেন। প্রত্যক্ষদর্শীদের একাংশ জানিয়েছেন, পটনার ট্রেনের প্ল্যাটফর্ম বদলের ঘোষণা শুনে বাকি সবক’টি প্ল্যাটফর্ম থেকে যাত্রীরা স্টেশনের মাঝামাঝি থাকা ওভারব্রিজ দিয়ে ৬ নম্বরে যাওয়ার চেষ্টা শুরু করেন। আবার সেই সময়েই ১ ও ৩ নম্বরে প্ল্যাটফর্মে যথাক্রমে কানপুর ও মোগলসরাইয়ের ট্রেন দাঁড়িয়ে। ফলে একই ওভারব্রিজ দিয়ে বহু যাত্রী বিপরীত অভিমুখে যাওয়ার চেষ্টা করেন। পরস্পরমুখী এই স্রোতের ধাক্কায় এক সময়ে গোটা ভিড়টি ওভারব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে যায়। আর একটি অংশের দাবি, আগে থেকেই পটনাগামী ট্রেনটিতে অনেকে উঠে বসে ছিলেন। তাঁরা তড়িঘড়ি নামতে যান। ওভারব্রিজের সিঁড়িতেও বসে ছিলেন বহু যাত্রী। এই সব মিলিয়েই পরিস্থিতি আয়ত্তের বাইরে যাচ্ছে দেখে লাঠি চালায় পুলিশ (যদিও সরকারি ভাবে সে কথা মানছে না রেল)। লাঠি থেকে বাঁচতেও অনেকে হুড়োহুড়ি শুরু করেন। মনে করা হচ্ছে সেটিও দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ।
তবে প্রকৃত কারণ যা-ই হোক, কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর মিলছে না। ক্ষমতা না থাকা সত্ত্বেও স্টেশনে আড়াই লক্ষ যাত্রীকে কেন ঢুকতে দেওয়া হল? কেন পুলিশের সংখ্যা ছিল মাত্র সাড়ে ছ’শো? একটিমাত্র ওভারব্রিজে ভিড় হচ্ছে দেখে রেল পুলিশ কেন ভিড়কে অন্য ওভারব্রিজের দিকে পাঠিয়ে দেয়নি? কেন হঠাৎ প্ল্যাটফর্ম বদল? আজ দুর্ঘটনার পরে যেমন যাত্রীদের ঢোকা-বেরোনোর একাধিক গেট খুলে দেওয়া হয়েছে, সেটা গত কাল করা হয়নি কেন?
রবিবার ৬ নম্বর প্ল্যাটফর্মে ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের ফুলিয়ার বাসিন্দা রামচরণ মাহাতোর স্ত্রী সত্যভামা মাহাতো। এখন তিনি স্বরূপরানি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি। অবস্থা গুরুতর নয় বলেই মনে করা হচ্ছে। তবে কলকাতার এক বাসিন্দা গত কাল মেলার মাঠে পদপিষ্ট হয়ে মারা গিয়েছেন। গোবিন্দরাজ নামে ওই ব্যক্তি অবসরপ্রাপ্ত ব্যাঙ্ককর্মী।
কুম্ভের এই পূণ্যার্থীদের সম্পর্কেই অখিলেশ সরকার বলেছিল, ‘প্রত্যেকে আমাদের কাছে ভিভিআইপি’। উত্তর নেই, সেই ভিভিআইপিদের ওপর লাঠি চলল কেন, কেনই বা আহত হয়ে তাঁদের প্ল্যাটফর্মে দু’ঘণ্টা ছটফট করতে হল? রাজ্যের পঞ্চায়েতমন্ত্রী জবাব দেননি। উত্তরপ্রদেশের তদন্ত রেল মানবে কি না, তারও স্পষ্ট উত্তর নেই।
তবে ভিড়ের চাপে ইলাহাবাদ স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম দিয়ে আজও হাঁটার জো নেই। ওভারব্রিজে ওঠার পর জায়গায় জায়গায় ব্যামমিন্টন নেটের ব্যারিকেড। মহিলাদের ভিড়ই কি এই যাত্রীদের মধ্যে বেশি? মৃত ৩৬ জনের মধ্যে ২৯ জনই মহিলা। আহত ৩৯ জনের মধ্যে ২৮ জনই মহিলা। অপুষ্টি, অশিক্ষার শিকার এই মহিলাদের কি তীর্থযাত্রা এবং মৌনী অমাবস্যার পুণ্যস্নান কোনও ‘স্ব-ক্ষমতা’ দিয়েছিল?
কে জানে! |
|
|
 |
|
|