ছিল পশ্চিম। ভেঙে হল উত্তর আর পশ্চিম। বিমানের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণে সুবিধার তাগিদে ভাগ করে দেওয়া হল কলকাতা ‘এয়ার ট্র্যাফিক কন্ট্রোল’ (এটিসি)-এর আওতাধীন আকাশের একটি অংশ।
অতিরিক্ত সংখ্যক বিমানের চাপে এটিসি-অফিসারদের মনঃসংযোগে ব্যাঘাত ঘটছে বলে অভিযোগ অনেক দিনের। যার ফলে আকাশে একের পর এক বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। সদ্য যেমন হয়েছিল ১৭ জানুয়ারি দুপুরে। কাতার এয়ারওয়েজের একটি বিমান আবু ধাবি থেকে কলকাতায় আসছিল। তিরিশ হাজার ফুট উচ্চতায় তার প্রায় নাকের ডগায় চলে আসে একটা বেলজিয়ান বিমান অস্ট্রেলিয়া থেকে ইউরোপে যাওয়ার পথে। কাতারের পাইলট শেষ মুহূর্তে মুখ ঘুরিয়ে কোনওক্রমে বিপর্যয় এড়ান।
এবং এ জন্য কাতারের পাইলটের পাশাপাশি এটিসি-র নজরদারিতে ঘাটতির দিকেও আঙুল উঠেছে। কলকাতা বিমানবন্দর সূত্রের খবর: সে দিন কাতারের পাইলট এটিসি-র নির্দেশ অমান্য করে পঁয়ত্রিশ হাজার ফুট থেকে ভুল রুটে নেমে আসছিলেন। কিন্তু দায়িত্বপ্রাপ্ত এটিসি-অফিসারের তা নজরে পড়েনি। প্রাথমিক তদন্তে প্রকাশ, ওই সময়ে আরও দু’টি বিমান কাছাকাছি চলে আসায় এটিসি তা নিয়েই ব্যস্ত ছিল। কাতারের বিমান তার নজর এড়িয়ে যায়।
|
এটিসি-সংস্কার |
|
কী ছিল |
কী হল |
• এটিসি-তে বেশি বিমানের চাপ
• এক এলাকায় তিন প্রধান রুটের বিমান
• কাজের চাপে মনঃসংযোগে ঘাটতি
• পাইলট-যোগাযোগে একটি বেতার-তরঙ্গ |
• এটিসি-অফিসার পিছু উড়ান-সংখ্যা হ্রাস
• দিল্লি-মুম্বই ও গুয়াহাটি পৃথক এলাকায়
• চাপ কমায় মনঃসংযোগে সুবিধা
• নতুন এলাকার জন্য পৃথক বেতার-তরঙ্গ |
|
বস্তুত, গত ক’মাস ইস্তক কলকাতার আকাশপথে পরের পর এমন ঘটনা ঘটে চলেছে। প্রতি বারেই শোনা যায়, একেবারে শেষ মুহূর্তে পাইলটের তৎপরতায় কিংবা এটিসি-অফিসারের তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে দুই বিমানের কয়েকশো যাত্রীর প্রাণ বেঁচে গিয়েছে! দেশের বিমান নিয়ন্ত্রক সংস্থা ‘ডিরেক্টরেট জেনারেল অফ সিভিল অ্যাভিয়েশন’ (ডিজিসিএ) সম্প্রতি এ নিয়ে কড়া বার্তা পাঠিয়েছে। বার্তায় অভিযোগ: কলকাতার আকাশেই এমন ঘটনা বেশি করে ঘটছে।
এই সমস্যারই সুরাহার লক্ষ্যে কলকাতা এটিসি’র পশ্চিম আকাশের এলাকা ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তৈরি হয়েছে নতুন ‘উত্তর’ আকাশ।
বিমানবন্দর সূত্রের খবর: কলকাতা এটিসি-র নিয়ন্ত্রণাধীন আকাশ এত দিন তিন এলাকায় বিভক্ত ছিল। পূর্ব, পশ্চিম ও দক্ষিণ। নামে কলকাতার হলেও তার তিন ভাগেই অন্য বিভিন্ন রাজ্যের আকাশ ছিল। তিন ভাগের মধ্যে আবার পশ্চিম ছিল তুলনায় অনেক বড়। তার আওতায় এক দিকে যেমন ছিল বারাণসী-রায়পুর, অন্য দিকে নেপাল সীমান্ত থেকে আগরতলা। এতেই বিমান নিয়ন্ত্রণে অনেক ক্ষেত্রে অসুবিধা দেখা দিচ্ছিল বলে এটিসি সূত্রের দাবি।
কী রকম?
বিমানবন্দরের এক অফিসারের ব্যাখ্যা: পশ্চিমের আকাশ দিয়ে এক সঙ্গে অনেক বিমান যাতায়াত করত। “কলকাতা থেকে দিল্লি-মুম্বই-গুয়াহাটির মতো ব্যস্ততম তিনটে রুট-ই পশ্চিমের আওতায়। অথচ, গোটা পশ্চিম আকাশে বিমান নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব ছিল শুধু এক জন কন্ট্রোলারের। পশ্চিম আকাশে সমস্ত বিমানের সঙ্গে তিনি একাই কথাবার্তা চালাতেন।” অফিসারদের অভিযোগ, বিরাট পশ্চিম আকাশ একা সামলাতে গিয়ে অস্বাভাবিক চাপ পড়ছিল সংশ্লিষ্ট এটিসি-অফিসারের উপরে। এক সঙ্গে অনেকগুলি বিমানের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে গিয়ে তাঁরা ক্লান্ত হয়ে পড়ছিলেন। যার ফলে মনঃসংযোগে বিঘ্ন ঘটছিল। অন্য দিকে, একই আকাশে বিমানের সংখ্যাধিক্যের দরুণ বেতার যোগাযোগ লাইনও হামেশা ‘জ্যাম’ হয়ে যাচ্ছিল। অনেক ক্ষেত্রে আপৎকালীন পরিস্থিতি তৈরি হওয়া সত্ত্বেও পাইলটেরা এটিসি-র সঙ্গে সময়ে যোগাযোগ করতে পারছিলেন না। “কখনও তো এক জন পাইলটকে এটিসি’র সঙ্গে কথা বলার জন্য আধ ঘণ্টাও অপেক্ষা করতে হচ্ছিল।” বললেন এক অফিসার।
সব মিলিয়ে প্রায়ই বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছিল। এ বার সেই প্রবণতা কিছুটা কমবে বলে আশা করা হচ্ছে। কারণ, এটিসি-তে উত্তর আকাশের বিমানে নজরদারির জন্য এক জন আলাদা কন্ট্রোলার থাকবেন। উপরন্তু গুয়াহাটি রুটটিকে সরিয়ে আনা হচ্ছে উত্তরে। এতে পশ্চিম আকাশের কন্ট্রোলারের উপরে চাপ কমবে। দুই আকাশের পাইলটদের সঙ্গে কথা বলতে ব্যবহার করা হবে দু’টো ভিন্ন রেডিও-তরঙ্গ। তাই প্রয়োজনে এটিসি’র সঙ্গে যোগাযোগ করতে পাইলটদের অসুবিধে হবে না বলে বিমানবন্দর-কর্তাদের আশা।
এটিসি-র জেনারেল ম্যানেজার চন্দন সেন বলেন, “পশ্চিম ভেঙে তৈরি হয়েছে নতুন এলাকা উত্তর। এতে কন্ট্রোলারদের পাশাপাশি পাইলটদেরও সুবিধা হবে। এটিসি-অফিসারকে যেমন তুলনায় কম সংখ্যক বিমান সামলাতে হবে, তেমন পাইলটেরাও এটিসি-র সঙ্গে কথা বলার সুযোগ বেশি পাবেন। দুর্ঘটনার সম্ভাবনা কমে আসবে।”
|