বয়সের ভারে ক্লান্ত। কাজের চাপ আর নিতে পারছেন না। শারীরিক ভাবে তো বটেই। মানসিক ভাবেও। তাই প্রায় ছ’শো বছরে যা ঘটেনি, সেটাই করবেন বলে ঘোষণা করে দিলেন তিনি। জোসেফ অ্যালয়সিয়াস র্যাটজিঙ্গার। বিশ্ব যাকে পোপ ষোড়শ বেনেডিক্ট নামে জানে। অবসর নিচ্ছেন তিনি। আট ভাষায় অনুদিত হয়ে তাঁর সেই স্বেচ্ছাবসরের চিঠি এখন ভ্যাটিকানের ওয়েবসাইটে।
নিজের মুখে ঘোষণাটি করেন সোমবার সকালে। ল্যাটিনে। ১২০ কোটি ক্যাথলিকের ধর্মগুরুর আচমকা বিদায়ের ঘোষণায় খ্রিস্টান দুনিয়া শুধু নয়, বিশ্ব জুড়ে শুরু হয় তুমুল আলোড়ন। প্রতিক্রিয়ায় কেউ শোকাতুর, কেউ বিস্মিত ও বিভ্রান্ত.... কেউ আবার উল্লসিত স্বাগতও জানিয়েছেন পোপের সিদ্ধান্তকে। সিদ্ধান্তটা অপ্রত্যাশিত। কিন্তু তার এমন প্রতিক্রিয়া বুঝি প্রত্যাশিতই।
ষোড়শ বেনেডিক্টের ইস্তফায় উঠে আসছে অনেক প্রশ্ন। শুরু হয়ে গিয়েছে কাটাছেঁড়া ও বিশ্লেষণ। এই অবসরের পিছনে কি শুধুই বার্ধক্য, নাকি অন্য কিছু এই নিয়ে জল্পনার ঝড়ের মুখে তড়িঘড়ি বিবৃতি দেন ভ্যাটিক্যানের মুখপাত্র ফেদেরিকো লম্বাদর। তিনি জানান, বয়সের কারণেই অবসর নিয়েছেন পোপ। তবে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কাজ চালিয়ে যাবেন। এর পর ৩১ মার্চের মধ্যেই নতুন পোপ নির্বাচিত করা হবে। এ বার কি কৃষ্ণাঙ্গ কেউ পাবেন ওই পদ? বহু যুগ ধরেই এই প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে ভ্যাটিকানকে। এ বারও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। জল্পনা শুরু হয়েছে আরও বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকেই। কারণ অতিরিক্ত রক্ষণশীলতার জন্য পরিচিত (এবং বেশ কিছু মহলে সমালোচিতও) ষোড়শ বেনডিক্টের পুরো কার্যকাল ধরেই বিতর্ক ছিল তাঁর ছায়াসঙ্গী। তবে যে বিতর্ক তাঁকে সব থেকে বেশি তাড়া করে বেড়িয়েছে, তা হল চার্চের যাজকদের বিরুদ্ধে শিশু নিগ্রহের অভিযোগ। এমনকী, এই বিতর্কে জড়িয়ে গিয়েছিল তাঁর নিজের নামও। ২০০৫ সালের ২৪ এপ্রিল পোপ হিসেবে শপথ নেওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই একাধিক যাজকের বিরুদ্ধে শিশু নিগ্রহের অভিযোগ প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে। |
ছ’শো বছরে প্রথম |
• নির্বাচিত ১৯ এপ্রিল, ২০০৫
• শপথ ২৪ এপ্রিল, ২০০৫
• পদ ছাড়বেন ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ |
এখন ক্লান্ত শরীর, অবসন্ন মন |
বিতর্ক তাঁর ছায়াসঙ্গী |
• শিশু নিগ্রহে অভিযুক্ত যাজকদের আড়াল করার চেষ্টা।
•
খ্রিস্ট ধর্মের প্রচার করতে গিয়ে মুসলিমদের ক্ষুণ্ণ করা।
•
নিজের বই ‘জেসাস অফ নাজারেথ’-এ যিশুর মৃত্যুর জন্য ইহুদিদের দায়ী করা।
• ভ্যাটিকানের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ফাঁস করে গ্রেফতার তাঁর বাটলার পাওলো গ্যাব্রিয়েল।
• সমকামিতার বিরোধিতা।
•
মেয়েদের যাজক হওয়া রোখা।
• স্টেম সেল নিয়ে গবেষণায় আপত্তি । |
|
এই ঘটনায় ধর্মগুরু হিসেবে প্রকাশ্যে নিগৃহীত শিশু ও তাঁদের পরিবারের কাছে ক্ষমা চেয়ে নেন পোপ স্বয়ং। কয়েক জন নিগৃহীত শিশুর সঙ্গে দেখাও করেন তিনি। এই ঘটনাকে ‘চার্চের নোংরামো’ বলে অভিহিতও করেন তিনি। কিন্তু এই সময়েই পোপের বিরুদ্ধে শিশু নিগ্রহে অভিযুক্ত এক যাজককে পুনরায় চার্চে কাজে নিয়োগ করার অভিযোগ ওঠে। পোপের পদত্যাগের দাবিতে মুখর হন অনেকে। বলা হয়, ঘটনাকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছে চার্চ। অভিযোগ উড়িয়ে ভ্যাটিকানের তরফে বলা হয়, তবে ঘটনাটি ১৯৮৫ সালের। তখন তিনি কার্ডিনাল (ভ্যাটিক্যান আধিকারিক, যাঁরা পোপ নির্বাচন করেন) ছিলেন। আর ওই ঘটনায় পোপ কোনও ভাবেই জড়িত ছিলেন না।
এই বিতর্কের জের কাটার আগেই ২০০৬-এ ক্রুসেড তথা ঐতিহাসিক খ্রিস্টান-মুসলিম ধর্মযুদ্ধ নিয়ে একটি বক্তৃতায় পোপের বক্তব্যে ক্ষুণ্ণ হন ইসলাম ধর্মালম্বীরা। এই ক্ষেত্রে ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা হয় এই বলে যে, ওই বক্তব্য আদৌ পোপের নয়। যদিও তাঁর প্রতি বিরূপ মনোভাব আদৌ বদলায়নি তাতে। সমলিঙ্গে বিবাহ, মেয়েদের যাজক হওয়া এবং স্টেম সেল (দেহের বিশেষ কোষ) নিয়ে গবেষণায় প্রকাশ্যে আপত্তি জানিয়ে বিতর্ক আরও উস্কে দেন তিনি। বিজ্ঞানের অগ্রগতির উল্টো পথে হাঁটার অভিযোগ ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে। ভ্যাটিকানের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ অবশ্য নতুন কিছু নয়। কিন্তু গত ফেব্রুয়ারিতে ফের খবরের শিরোনামে উঠে আসে তাঁর নাম। ইতালির কিছু সংবাদপত্রে খবর ছড়ায়, “পোপকে খুন করা হতে পারে।” পোপ সম্পর্কে এমন গুজব বা খবর ছড়ানোর ঘটনা ইতিহাসে প্রথম।
ছ’শো বছরের ইতিহাসে তিনিই প্রথম পোপ যিনি পদত্যাগ করলেন। এর আগে শেষ যে পোপ পগত্যাগ করেছিলেন, তিনি পোপ দ্বাদশ গ্রেগরি। ১৪১৫ সালের ঘটনা। |
২০০৫-এর ১৮ এপ্রিল,
পোপ নির্বাচিত হচ্ছেন
ষোড়শ বেনেডিক্ট |
ষোড়শ বেনেডিক্ট যখন ২০০৫ সালে পোপ হিসেবে শপথ নেন, তখনই তাঁর বয়স ৭৮ পেরিয়ে গিয়েছে। লিপিবদ্ধ হয়ে গিয়েছে সবচেয়ে বয়স্ক পোপ হিসেবে ইতিহাসে তাঁর নাম। এখন তিনি ৮৫। আজ অবসরগ্রহণের বিবৃতিতে পোপ বলেন, “এখনকার যুগে এত দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে যে ভক্তদের মধ্যে বিশ্বাস জাগাতে, সর্বোপরি সব দিক সামলাতে শারীরিক ও মানসিক দিক থেকে সক্ষম থাকা প্রয়োজন। কিন্তু গত কয়েক মাসে আমার মধ্যে এই সক্ষমতারই অভাব দেখা যাচ্ছে। সেই কারণেই আমি নিজের ইচ্ছায় পদত্যাগ করলাম।” ভ্যাটিকানের তরফে জানানো হয়েছে, নিয়ম মতো পোপ নিজের ইচ্ছায় অবসর নিতে চাইলে কেউ তাঁকে আটকাতে পারেন না। শুধু অবসরের বিবৃতিটি যেন পুরোপুরি প্রকাশ্যে আসে।
জন্ম ১৯২৭-র ১৬ এপ্রিল, জার্মানির বাভেরিয়ায়। বাবা ছিলেন পুলিশ অফিসার। পোপ দ্বিতীয় জন পলের সময়কালে দু’দশকেরও বেশি সময় ধরে তাঁর সঙ্গী ছিলেন ষোড়শ বেনেডিক্ট। দ্বিতীয় জন পলের মৃত্যুর পরে ১১৫ জন কার্ডিনালের অধিকাংশ তাঁকেই পরবর্তী পোপ বলে মেনে নেন। কিন্তু ষোড়শ বেনেডিক্টের পর তাঁর উত্তরসূরি কে হবেন তা নিয়ে ভ্যাটিকান ধোঁয়াশায়। ভাই জর্জ র্যাটজিঙ্গার জানিয়েছেন, হাঁটাচলায় অসুবিধে হচ্ছে বেনেডিক্টের। চিকিৎসকরা বেশি ভ্রমণ না করতে পরামর্শ দিয়েছেন পোপকে। জর্জের কথায়, “এই বয়সে ভাইয়ের একটু বিশ্রাম দরকার।” অথচ পোপের ঠাসা কর্মসূচিতে বিশ্রামের কোনও অবকাশই ছিল না। অবসরের সিদ্ধান্ত এ জন্যই।
পোপের অবসরে হতচকিত ক্যাথলিক সমাজ। কিন্তু তাঁর সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে মেসেজে ভরে গিয়েছে টুইটটার, ফেসবুক। শিশু নিগ্রহের শিকার এক আইরিশ পরিবার লিখেছেন, “তাঁর কার্যকালে কোনও ভাল কাজই করেননি পোপ ষোড়শ বেনেডিক্ট। উল্টে অসহায় শিশুদের যাঁরা অত্যাচার করেছে তাঁদেরই আড়াল করে গিয়েছেন।” এক জন লিখেছেন, “খুব ভাল ঘটনা। পোপের এই সিদ্ধান্তের জন্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাই।” |