পুরুলিয়া জেলার পর্যটন শিল্পের বিকাশ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যেপাধ্যায়ের কাজের তালিকার শীর্ষে রয়েছে। অযোধ্যা পাহাড়ের পর্যটনের পরিকাঠামো গড়ার জন্য রাজ্য সরকার অর্থও বরাদ্দ করেছেন। কিন্তু পর্যটকদের আকর্ষণ করতে শুরু হওয়া ‘অযোধ্যা উৎসব’ই শনিবার শুরু হল নিতান্তই ম্যাড়ম্যাড়ে ভাবে। এমনটাই উপলব্ধি পাহাড়বাসী থেকে প্রশাসনের একাংশের।
বাসিন্দাদের মতে, মুখ্যমন্ত্রী যেখানে রাজ্যের পাহাড় থেকে সমুদ্র, যাত্রা থেকে মাটি— নানা উৎসব করছেন। লোকশিল্পী ও শিল্পের প্রসারের জন্য এমনই বিশেষ উদ্যোগ নিচ্ছেন তিনি। সেখানে পুরুলিয়ার মতো পিছিয়ে পড়া জেলায় অযোধ্যা পাহাড়ের পর্যটন ক্ষেত্রের বিকাশের জন্য শুরু হওয়া অযোধ্যা উৎসব এমন রঙহীন হল কী করে? রবিবার মেলা শেষের বিকেলে অবশেষে কিছু লোকের ভিড় দেখা গেলেও এই প্রশ্নটা রয়েই গেল।
কারণ একটাই, শুধু মাত্র প্রচারের অভাব। মেলা পরিচালনা করে পুরুলিয়া জেলা প্রশাসন। জেলাশাসক মেলার অন্যতম পৃষ্ঠপোষকও। কী বলছেন তিনি? ঠেকে শিখে জেলাশাসক মহম্মদ গুলাম আলি আনসারি বলেন, “প্রচারের বিষয়টি আমরা পরের বার নিশ্চয়ই মাথায় রাখব।” |
মাওবাদী আতঙ্ক সরিয়ে গত বছরেই পর্যটকদের আনাগোনা কিছুটা শুরু হয়েছিল এখান। পর্যটকদের কাছে অযোধ্যাকে আরও এগিয়ে দেওয়ার জন্যই জেলা প্রশাসন গত বছর শুরু করে ‘অযোধ্যা উৎসবের’। থিতিয়ে যাওয়া পর্যটকদের ভিড়ও এ বার কিছুটা চাঙ্গা হয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয় বছরে পা রেখে সেই ‘অযোধ্যা উৎসব’ই দেখাল কোথাও যেন তাল কেটে গিয়েছে। মেলায় ছিল শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, বন, উদ্যানপালন, অনগ্রসর শ্রেণি কল্যান, পুলিশ সহায়তা কেন্দ্র-সহ বিভিন্ন দফতরের স্টল। শনিবার ও রবিবার দু’দিনই দুপুরে মেলায় ছিল পাতপেড়ে সবার খাওয়াদাওয়ার আয়োজন। বিকেল থেকে নানা লোক সংস্কৃতি অনুষ্ঠানও ছিল। কিন্তু যাঁদের জন্য এই উৎসবের আয়োজন, উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দেখা গেল না তাঁদেরই। স্থানীয় মানুষজনের ভিড় ছিল খুবই কম। পর্যটকদেরও তেমন দেখা গেল না। রাজ্যের স্বনির্ভর গোষ্ঠী ও স্বনিযুক্তি দফতরের মন্ত্রী শান্তিরাম মাহাতো যখন মেলার উদ্বোধন করছিলেন, তখন মেলা চত্বরে সাকুল্যে ৪০০ লোকও ছিল না। মেলার শেষ দিন রবিবার সকালের দিকেও বেশ ফাঁকাই ছিল। বিকেলের পর ভিড় কিছুটা বাড়ে। মুখরক্ষা হয় মেলার উদ্যোক্তাদের। কিন্তু পর্যটকদের এ দিনও সে ভাবে দেখা গেল না।
মেলার আয়োজনের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা অবশ্য এতে আশ্চর্য হচ্ছেন না। তাঁরা জানিয়েছেন, এমনটাই প্রত্যাশিত ছিল। উৎসবে যে সমস্ত দফতর স্টল দিয়েছে, তাঁদেরও কেউ কেউ জানিয়েছেন শেষ মুর্হূর্তে এই উৎসবের খবর জানানো হয়েছে। অযোধ্যা পঞ্চায়েতের প্রধান ঝন্টু সিং মুড়া বলেন, “প্রচারে ঘাটতি তো রয়েইছে। এ ছাড়া এই উৎসবের নির্দিষ্ট কোনও দিন ক্ষণ নেই। গত বার মেলা হল ১৯-২০ ফেব্রুয়ারি। এ বার তার ১০ দিন আগে উৎসব হল। বছরের কোনও নির্দিষ্ট দিন ঠিক থাকলে, পর্যটকেরা সেই সময় চলে আসবেন। তাতে পর্যটনেরও বিকাশ হবে।” তাঁর মতে, বিষ্ণুপুর মেলা, পৌষ মেলার মতোন অযোধ্যা উৎসবের জন্যও নির্দিষ্ট দিন ঠিক করা উচিত প্রশাসনের। পাহাড়তলির বাড়েরিয়া গ্রামের বাসিন্দা প্রশান্ত মাহাতোর কথায়, “বাঘমুণ্ডি বা পুরুলিয়া শহরে কোথাও উৎসবের ব্যানার, পোস্টার বা বিজ্ঞাপন চোখে পড়েনি।”
শুধু কী তাই? বাসিন্দারা থেকে প্রশাসনের একাংশ জানাচ্ছেন, এ বার অযোধ্যা উৎসব নিয়ে কার্যত তেমন প্রচারই হয়নি। গত বার এই উৎসবকে নিয়ে পাহাড়ে কার্যত সাজোসাজো রব পড়ে গিয়েছিল। গত বারও উৎসবের মেয়াদ ছিল দু’দিনের। কিন্তু এই উৎসবের জন্য বুরুবাহা পাহাড় থেকে পুরুলিয়া শহর পর্যন্ত একটি বাস চালু করা হয়েছিল। উদ্বোধনের দিন সেই বাস যখন পাহাড়ে এসেছিল, পাহাড়বাসী তখন সেই উদ্যোগকে দু’হাত তুলে স্বাগত জানিয়েছিলেন। এ বার কোথায় কি? অযোধ্যা পাহাড়ের বাসিন্দা পেশায় গাইড বেণু সেন বলছিলেন, “পাহাড়ে এমন একটি উৎসব হতে যাচ্ছে, অথচ তা পাহাড়ের বেশিরভাগ মানুষ জানেন না। কোন প্রচার করা হয়নি।” স্থানীয়েরা জানান, পাহাড়ে ৭৪টি গ্রাম রয়েছে। ওই গ্রামগুলি থেকে লোকজন এলে এই মাঠে তিলধারণের জায়গা থাকত না।
উদ্বোধনের দিন হিলটপের মাঠে এসেছিলেন স্থানীয় রাঙা গ্রামের সীতারাম মুর্মু ও মহেশ্বর হাঁসদা। তাঁদের কথায়, “এখানে একটা কাজে এসেছিলাম। খবর পেয়ে মেলায় ঘুরতে এলাম। কিন্তু এখানে যে পরব হচ্ছে, তা আগে জানতাম না।” বাসিন্দারা জানান, উৎসবের এক দিন আগে মাইক নিয়ে এলাকায় প্রচার করা হয়েছে। না হলে এলাকায় উৎসব, মেলা চলছে, আর পাহাড়ের মানুষ ঘরে বসে রয়েছেন, এমনটা কখনও হয়নি। স্থানীয় সীতাকুণ্ডে পৌষ সংক্রান্তির পরের দিন থেকে মেলা শুরু হয়েছে। কত মানুষ সেখানে সমবেত হয়েছেন। অথচ সরকারের আয়োজিত এত বড় উৎসবে পাহাড়ের লোকের কার্যত দেখাই মিলল না! মানবাজার ২ ব্লকের খড়িদুয়ারা ডুংরিতে ১৮ বছর ধরে সৃজন উৎসবের আয়োজন করে আসছেন সৈকত রক্ষিত। তাঁর মতোই জয়চণ্ডী পাহাড় উৎসব কমিটির সম্পাদক সুকুমার মণ্ডল বললেন, “অযোধ্যা উৎসব নিয়ে কোনও প্রচারই চোখে পড়েনি। আগে জানলে ভাল হত।”
শান্তিরাম মাহাতো বলেন, “আমাদের সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরেই পাহাড়ে শান্তি ফিরেছে। তবে পরের বার উৎসবের নির্দিষ্ট দিনক্ষণ নির্ধারিত করার চেষ্টা করব। প্রচারের ঘাটতি যাতে না হয়, সে দিকেও গুরুত্ব দেওয়া হবে। |