এক খিলি মিঠাপাতা দিয়ে সাজানো পানের দাম সাত টাকা শুনে আঁতকে উঠেছিলেন ক্রেতা ভদ্রলোক। তা দেখে দোকানদার প্রেম অধিকারীর মন্তব্য, “এক হাজার মিঠা পাতার পানের দাম ৪ হাজার টাকা। একটু অপেক্ষা করুন এমন চলতে থাকলে চৈত্র-বৈশাখ নাগাদ একটি পানেরই দাম উঠবে ১০ টাকা পর্যন্ত।”
এ বড় দুঃসময় ‘পানাসক্ত’-দের। পানের দাম চড়ছে হু হু করে। সাধারণ বাংলা পাতার এক পন পানের দর অন্যান্য বছর ৫০-৬০ টাকার মধ্যে ঘোরাফেরা করে। এ বার মাঘের শেষ সপ্তাহে তা বিকোচ্ছে ৮০ থেকে ৯০ টাকায়। ব্যবসায়ীদের আশঙ্কা, চৈত্রের শেষ নাগাদ এই দর ৩০০ টাকা অবধি চড়তে পারে। অন্য দিকে মিঠা পাতার পানের দর প্রতি হাজার ৩,৫০০ থেকে ৪০০০ টাকা পর্যন্ত।
ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায়ের বাঙালীর ইতিহাসে দময়ন্তীর বিবাহ ভোজের যে বনর্না রয়েছে, তাতে পানের কথা বিশেষ ভাবে উল্লেখ রয়েছে। “.....ভোজের পর দেওয়া হয়েছিল নানা মশলাযুক্ত পানের খিলি। সমস্ত প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলিতে এবং পূর্ব ও দক্ষিণ ভারতে পান পরিবেশনের রীতি হইতেছে পান, সুপারি এবং অন্যান্য মশলা পৃথক পৃথক ভাবে সাজাইয়া দেওয়ার। পান খিলি করিয়া পরিবেশন করা বোধহয় পরবর্তী আর্য ভারতীয় রীতি। এবং উচ্চ কোটি লোকস্তরে ক্রমশ সেই রীতিই প্রবর্তিত হয়।.....” |
তাই খাওয়া দাওয়ার পর এক খিলি পান মুখে দেওয়া বাঙালীর বহু কালের অভ্যাস। হঠাৎ মূল্যবৃদ্ধিতে সেই অভ্যাসে ব্যাঘাত ঘটতে বসেছে।
কিন্তু কেন পানের এই অগ্নিমূল্য? উত্তরে পানচাষী থেকে পান বিক্রেতা, সকলেই এক বাক্যে জানাচ্ছেন, দীর্ঘস্থায়ী কনকনে ঠান্ডাই এই মূল্যবৃদ্ধির জন্য দায়ী। একটানা হিমঝরা ঠান্ডায় বরজের পর বরজ ফাঁকা করে খসে গিয়েছে পান পাতা। মোট ফলনের ৯০ শতাংশই গেছে নষ্ট হয়ে। বৈশাখে নতুন পান না ওঠা পর্যন্ত চলবে এই পরিস্থিতি। প্রাক্তন কৃষি আধিকারিক নিশীথ দে বলেন, “রাজ্যের পর ১৮২০৩ হেক্টর জমিতে পান চাষ হয়। প্রায় ৫ লক্ষ মানুষের রুটি রুজি নির্ভর করে পান চাষের উপর। পান ও পান জাত দ্রব্য থেকে উদ্ভূত সম্পদের ৭০ শতাংশই আসে এই রাজ্য থেকে।” তাঁর কথায়, “এ বছর প্রবল ঠান্ডায় রাজ্যের মোট উৎপন্ন পানের প্রায় ৭০ শতাংশই নষ্ট হয়ে গিয়েছে।’’ নদিয়ার কালীগঞ্জের শেরপুরের পানচাষী নারায়ন দাস, গুরু দাসেরা একে “শীত মড়ক” বলছেন। গুরুদাসবাবু বলেন, “আমার বিঘে কয়েক পান বরজ রয়েছে। ঠান্ডার পর বরজে ঢুকেই দেখি শুধু লতাগুলো দাঁড়িয়ে আছে। নীচে জমে আছে খসে পড়া পান পাতা। বিরাট ক্ষতি হয়ে গেল।” চিত্রটা কালীগঞ্জ থেকে করিমপুর সর্বত্র এক। অস্বাভাবিক দামের জন্য অনেক পান বিক্রেতাই বন্ধ করে দিয়েছেন পান বেচা।
বর্ধমানের পানের আড়তদার নীলকমল পাল বলেন, “এই সময় পানের দাম একটু চড়ে। প্রতি পন বাংলা পানের দাম ওঠে ৫০ টাকা পর্যন্ত। এ বছর সেটা ৯০ টাকা। দিন কয়েক পর ২৫০-৩০০ টাকাও পৌঁছতে পারে। অন্য দিকে মেদিনীপুর বা দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা থেকে আসা মিঠা পানের দাম প্রতি হাজার ১৫০০ থেকে ৪০০০ টাকা পর্যন্ত যাচ্ছে। এ অবস্থা কোনওদিন তৈরি হয়নি।” বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং পান বিশেষজ্ঞ দীপেন্দু মাইতি বলেন, “পান বেশি তাপমাত্রা ও ঠান্ডা সহ্য করতে পারে না। এ বছর প্রচন্ড ঠান্ডা আর তার সঙ্গে কুয়াশা পান গাছকে শেষ করে দিয়েছে।” বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগে অধ্যাপক পীযূষকান্তি সরকার বলেন, “কুয়াশার ফলে রোগ পোকার আক্রমনও তীব্র হয়েছে। কান্ড ও পাতার গোড়াপচা রোগ লেগেছে পান গাছে। ম্যানকোজেব ও সাইমষ্পানীল-এর মিশ্রন নিয়মিত ব্যবহার করা দরকার এই সময়।” বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখ্য বিজ্ঞানী আখতার জামান বলেন, “এই অবস্থায় রাতে গরম জল বরজে ঢুকিয়ে সকালে বার করলে ক্ষতি কমতে পারে।” নদিয়ার জেলার অন্যতম পান উৎপাদন কেন্দ্র করিমপুর। ভিন রাজ্যেও এখানকার পানের কদর রয়েছে। করিমপুর-১ ব্লকের প্রায় ১০ হাজার লোক পান চাষের উপর নির্ভরশীল। করিমপুর-১ পান চাষী কল্যান সমিতির সম্পাদক সুবোধ বিশ্বাস বলেন, “এই ঠান্ডায় ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ পান নষ্ট হয়ে গিয়েছে। চাষীদের মাথায় হাত। এখন চলছে ক্ষতির হিসেব নিকেশ কষার পর্ব।” ক্ষতির পরিমান ঠিক কতটা? উত্তরে সুবোধবাবু বলেন, “এখনই তা নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয়। তবে অন্যান্য বার যদি এই সময় চাষী এক বিঘে পান বেচে ১ লক্ষ টাকা পেতেন। এ বার সেটা ১০ হাজার টাকা ছাড়াবে কিনা সন্দেহ।” জেলার হর্টিকালচার বিভাগের প্রধান রাহুল মারিক বলেন, “৫০-৭০ শতাংশ পানই নষ্ট হয়ে গিয়েছে। ব্লক ধরে ধরে চলছে ক্ষতির হিসাব। মনে হচ্ছে, ক্ষতির পরিমাণ কয়েকশো কোটি টাকা ছাড়াবে।” |