সংসদের শীতকালীন অধিবেশন শুরু হইবার পূর্বলগ্নে আফজল গুরুর ‘আকস্মিক’ ফাঁসির ঘটনাটিকে প্রধান বিরোধী দল ভারতীয় জনতা পার্টি ইউ পি এ সরকার তথা প্রধান শাসক দল কংগ্রেসের একটি রাজনৈতিক কৌশল হিসাবে চিহ্নিত করিবে, ইহা নিতান্ত স্বাভাবিক এবং প্রত্যাশিত। ভারতের মতো দেশে এমন একটি সিদ্ধান্ত রাজনীতির বহির্ভূত হইতে পারে না। মৃত্যুদণ্ড যখনই কার্যকর হউক (বা না হউক), এই ধরনের সিদ্ধান্তের অধিকার সরকারের হাতে থাকে এবং এ দেশে যে দল বা জোটই ক্ষমতায় থাকুক না কেন সরকারের যাবতীয় আচরণ প্রবল ভাবে রাজনীতির বশীভূত। সুতরাং সংসদ বসিবার প্রাক্কালে এবং বিভিন্ন রাজ্যে ও তাহার পর জাতীয় স্তরে নির্বাচনের প্রচারে বিজেপি’র পালের হাওয়া কাড়িয়া লইবার অভিসন্ধিতে কংগ্রেসের নায়করা যদি আজমল কসাবের ফাঁসির আড়াই মাসের মধ্যে আফজল গুরুর প্রাণদণ্ড কার্যকর করিয়া থাকেন, তাঁহারা রাজনৈতিক বিচক্ষণতার পরিচয়ই দিয়াছেন। নরেন্দ্র মোদী সহ বিজেপি নেতারাও তাহা জানেন, তাঁহাদের নিতান্ত অপ্রস্তুত এবং ঈষৎ বিভ্রান্ত প্রতিক্রিয়া তাহাই দেখাইয়া দেয়। কংগ্রেস শেষ অবধি সন্ত্রাসের মোকাবিলায় এই ‘দৃঢ় এবং বলিষ্ঠ’ ভাবমূর্তি প্রদর্শনের সুফল ভোটের বাক্সে তুলিতে পারিবে কি না, তাহা ভবিষ্যৎই বলিতে পারে, বিশেষত যখন অর্থনীতির বিপন্নতা ও অনিশ্চিতি এখনও প্রবল। কিন্তু শনিবার সকালের ঘটনাটি শাসক দলের একটি কৃতিত্ব বলিয়া গণ্য হইবে, তাহাতে কোনও সন্দেহ নাই।
ইহার পরেও প্রশ্ন থাকিয়া যায়। প্রথম প্রশ্ন, কেন এমন একটি দণ্ডাদেশ কার্যকর করিবার বিষয়ে রাজনীতি-নিরপেক্ষ, নিয়ম-ভিত্তিক তৎপরতার বন্দোবস্ত হইবে না। যথা, কেন এমন আইন থাকিবে না, যাহাতে মৃত্যুদণ্ডের চূড়ান্ত ঘোষণা হইবার পরে পূর্বনির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে সেই দণ্ড কার্যকর করিতে সরকার বাধ্য থাকে? আপাতদৃষ্টিতে এই প্রস্তাব আকর্ষণীয়। কিন্তু যাহা স্বাভাবিক ভাবেই হইবার কথা, তাহা আইন করিয়া চাপাইয়া দেওয়ার চেষ্টা যত কম করিতে হয়, একটি উদার গণতান্ত্রিক দেশের পক্ষে ততই মঙ্গল। সমস্ত রাজনৈতিক দল তথা সরকারের বরং স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে এই বিষয়ে তৎপর হওয়া বিধেয়। বিলম্বিত বিচারের মতোই, দণ্ডাদেশের বিলম্বিত রূপায়ণও অবিচারের নামান্তর। দ্বিতীয়ত, নানা মানবাধিকার সংগঠন ও অন্যান্য মহলের অভিযোগ আফজল গুরুর বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ড বিধানের উপযোগী অভিযোগ প্রমাণিত হয় নাই, সুতরাং এই দণ্ড অন্যায়, অনৈতিক। সমস্ত আদালত একটি মামলায় একমত হইবার পরেও নাগরিক সমাজের মনে প্রশ্ন থাকিতেই পারে, বিশেষত যখন ‘পারিপার্শ্বিক প্রমাণ’-এর ভিত্তিতেই মামলার নিষ্পত্তি করা হয়। কিন্তু তাহার পরেও এই সত্যকে মানিয়া লইতেই হইবে যে, বিচারের প্রক্রিয়া নির্ধারিত সমস্ত স্তর অতিক্রম করিয়া সম্পন্ন হইয়াছে, সুতরাং পদ্ধতিগত ভাবে তাহার যাথার্থ্য অস্বীকার করিবার কোনও সঙ্গত কারণ নাই। বাকি যত সওয়াল-জবাব, সকলই মতামতের প্রশ্ন।
অতঃপর? এই ঘটনার প্রতিক্রিয়া কী হইতে পারে? বিশেষত কাশ্মীরে? তিন দশক আগে মকবুল বাটের ফাঁসির দৃষ্টান্ত অনিবার্য ভাবেই উঠিয়া আসিয়াছে। সেই ঘটনার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া বিশেষ হয় নাই, কিন্তু পরবর্তী অধ্যায়ে ‘শহিদ’ মকবুল বাট উত্তাল কাশ্মীরে বিক্ষোভের একটি প্রতীক হইয়া দাঁড়ান। কাশ্মীর অপরিবর্তিত নাই, সত্য, কিন্তু কাশ্মীরে বিক্ষোভ এবং অসন্তোষ এখনও রীতিমত প্রবল। সুতরাং আশঙ্কাও কম নয়। মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লার প্রতিক্রিয়ায় তাহা অত্যন্ত স্পষ্ট। এখানেই রাজনীতির দায়িত্ব। ক্ষুদ্র নয়, বৃহৎ রাজনীতি। কাশ্মীরের মানুষকে, বিশেষত তরুণ সমাজকে কী ভাবে একটি যথার্থ গণতান্ত্রিক উন্নয়নের প্রক্রিয়ায় শরিক করিয়া লওয়া যায়, তাহার সাধনাই ভারতীয় রাজনীতিকদের একটি প্রধান সাধনা হওয়া উচিত। তাঁহারা ক্ষুদ্রস্বার্থ অতিক্রম করিয়া সেই সাধনায় ব্রতী হইতে পারিলে কাশ্মীরের সমাজকে ‘শহিদ’ আফজল গুরুর মধ্যে আপন সত্তার চরিতার্থতা খুঁজিতে হইবে না। অভ্যন্তরীণ এবং বহিরাগত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধেও তাহাই হইবে শ্রেষ্ঠ জবাব। |