ফুলকপি, তবে সাদা রঙের জমাট বাঁধা নয়। তবে তাতে কী আসে যায়। আর তাই হালকা সবুজ রঙের এবং ততটা জমাট বাঁধা না হয়েও পুষ্টির গুণে সাদা ফুলকপিকে অনেকটাই পিছনে ফেলেছে ‘ব্রোকলি’ বা সবুজ ফুলকপি। পরিচিত সাদা রঙের ফুলকপির বাজারি জনপ্রিয়তায় ভাগ বসাতে শুরু করেছে তারই সহোদরা।
সবুজ রঙের এই ফুলকপি বা ব্রোকলির উপকারিতায় মোহিত কৃষি বিশেষজ্ঞরাও। সাধারণ ফুলকপির মতো দেখতে হলেও বাস্তবে কিন্তু তা এক নয়। এটি অনেকটা ফুলের অপরিণত কুঁড়ি বা মঞ্জরীর সমাবেশ। ব্রোকলির ফুলগুলি জমাট বাঁধা অবস্থায় না থেকে ছাড়া ছাড়া অবস্থায় থাকে। গাছের ডগার উপর থাকা ‘সুস্বাদু’ ও সুগন্ধী’ এই কপির ওজন সাধারণত ৪০০-৫০০ গ্রাম হয়। গাছের ডগার বড় আকারের সবুজ কপি কেটে নিলে এর নীচের পাতার কাণ্ডের কোল থেকে আরও দু-চারটি ছোট ছোট কপি বের হয়। শীতকালীন এই চাষ এই সময়ের বিকল্প সব্জি চাষ বলেই মনে করছেন চাষিরা। লাভও সাধারণ ফুলকপির তুলনায় অনেক বেশি বলে বেশি থাকে। |
মাঠে ফলেছে ব্রোকলি।--নিজস্ব চিত্র।
|
মূলত আমেরিকা ইউরোপে ব্রোকলির পরিচিতি হলেও গত ১০-১২ বছর ধরে ভারতেও এর চাষ হচ্ছে এবং ক্রমে তা জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। এ রাজ্যে ব্রোকলি চাষে প্রথম সারিতে উত্তর ২৪ পরগনা। জেলা উদ্যানপালন দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, কয়েক বছর ধরে জেলায় বিক্ষিপ্তভাবে ব্রোকলির চাষ করছিলেন চাষিরা। গত বছর থেকে ব্রোকলি চাষ বাড়ানোর জন্য বিশেষভাবে উদ্যোগী হয় উদ্যানপালন দফতর। চাষিদের আর্থিক সাহায্যের পাশাপাশি এই চাষ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো, প্রশিক্ষণ সবই করছে দফতর। তার ফল মিলছে চলতি মরসুমে। জেলা উদ্যান পালন আধিকারিক দীপক কুমার ষড়ঙ্গী বলেন, “জেলায় কয়েক বছর ধরে ৫-৭ হেক্টরে বিক্ষিপ্তভাবে চাষ হচ্ছিল ব্রোকলির। এ বার এই চাষ হয়েছে ২০ হেক্টর জমিতে। এই চাষ খুবই লাভজনক এবং সব্জি হিসাবেও এটি খুবই পুষ্টিকর। রাজ্যের মধ্যে উত্তর ২৪ পরগনাতেই সবচেয়ে বেশি চাষ হয় ব্রোকলির।”
কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে, ক্যানসার প্রতিরোধ ক্ষমতার পাশাপাশি এই কপিতে যথেষ্ট পরিমাণে ফ্ল্যাভোনয়েড, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ভিটামিন (এ,বি,সি) প্রোটিন, ভোজ্য তন্তু ও খনিজ লবণ থাকে। সবচেয়ে বড় কথা, কোলেস্টরল কম থাকায় হৃদরোগের সম্ভাবনা কম। ব্রোকলিতে সাধারণ ফুলকপির তুলনায় ১৩০ গুণ এবং বাঁধাকপির তুলনায় ২২ গুণ বেশি ‘ভিটামিন এ’ আছে। সেই কারণে ব্রোকলিকে বলা হয় ‘পুষ্টির মণিমুকুট’ (জুয়েল ক্রাউন অফ নিউট্রিশন)। দীপকবাবুর কথায়, “বৈচিত্রময় শীতকালীন সব্জির মধ্যে ফুলকপি, বাঁধাকপি, ওলকপি ইত্যাদি সুপরিচিত কপির পরিবারে ব্রোকলি নতুন সংযোজন।”
ব্রোকলি গাছের অঙ্গজ বৃদ্ধির জন্য ২০ থেকে ২৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা এবং কুঁড়ি তৈরির সময়ে ১২ থেকে ১৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা প্রয়োজন। এর বেশি তাপমাত্রায় সবুজ ফুলকপি সাধারমত জমাট না বেঁধে আলগা হয়ে যায়। তোলার পর সাধারণ তাপমাত্রায় ৩-৪ দিনের বেশি রাখা যায় না। তাই এর দ্রত বিপণন ব্যবস্থা জরুরি। সবুজের পাশাপাশি বেগুনি, লালচে ও খয়েরি রঙের ব্রোকলিও দেখা যায়। এক বিঘে জমিতে ব্রোকলি চাষ করতে খরচ হয় প্রায় ১৫ হাজার টাকা। বিঘা প্রতি কমপক্ষে ৫০০০টি ফলন হতে পারে। সে ক্ষেত্রে ৩৫-৪০ হাজার টাকা লাভ হয়।
উত্তর ২৪ পরগনা জেলায় মূলত দেগঙ্গা, আমডাঙা, গাইঘাটা, বারাসত-২, হাবরা প্রভৃতি ব্লকে ব্রোকলি চাষ হচ্ছে। দেগঙ্গার দৈবঞ্জপোল গ্রামের ৫৯ বছরের চাষি সনাতন বিশ্বাস ২০০৭ সাল থেকে ব্রোকলি চাষ করছেন। এ বার ৭ বিঘা জমিতে চাষ করেছেন। এক বিঘে জমিতে সাড়ে ৪ হাজার ব্রোকলি পেয়েছেন। কী ভাবে এলেন এই চাষে? সনাতনবাবুর কথায়, “অতীতেও সাধারণ সব্জি চাষ করেছি। কিন্তু তাতে বিশেষ লাভ হত না। পরে দেগঙ্গা কৃষি খামারে এই চাষের প্রশিক্ষণ নিই। তারপর কৃষি আধিকারিকদের পরামর্শে শুরু করি ব্রোকলি চাষ। এখন এলাকাতেই ৭-৮ হেক্টর জমিতে ব্রোকলি চাষ হচ্ছে। ফড়েরা কিনে কলকাতার বাজারে নিয়ে যাচ্ছে।” তিনি জানান, এক-একটির ব্রোকলি গড়ে বিক্রি হয় ১২-১৪ টাকায়। আগের চেয়ে এখন ব্রোকলির চাহিদা বেড়েছে।” একই সুর শোনা গেল আমডাঙা ব্লকের কামদেবপুরের বাসিন্দা পবন বাগের কথাতেও। এ বার ১০ বিঘে জমিতে ব্রোকলি চাষ করেছেন তিনি। বেসরকারি সংস্থার লোক সরাসরি তাঁর ফসল কিনে নিয়ে যায়। লাভের পরিমাণ বেড়েছে বলে দাবি তাঁরও। ব্রোকলি চাষ লাভজনক বলে দাবি করেছেন গাইঘাটার গাজনা গ্রামের চাষি চিত্তরঞ্জন মণ্ডলও।
জেলা উদ্যানপালন দফতর সূত্রে জানানো হয়েছে, ব্রোকলি কাঁচা অবস্থায় স্যালাড করে, সেদ্ধ সুপ বা স্যালাড করে খাওয়া হয়। বড় বড় হোটেল রেস্তোরাঁতেও ভাল চাহিদা ব্রোকলির। স্বাস্থ্যের পক্ষেও এই কপি খুব উপকারী। আগামী দিনে ব্রোকলি চাষের জনপ্রিয়তা আরও বাড়বে বলেই মনে করছেন কৃষি কর্তারা। |