কলঙ্কমুক্ত হলেও বিতর্কমুক্ত হল না ‘অন্য ডার্বি’!
রেফারির বিতর্কিত সিদ্ধান্তে এ বারও উত্তপ্ত হয়েছে গ্যালারি। তবে দু’হাজার পুলিশ আর নিরাপত্তারক্ষীর কড়া চোখ এড়িয়ে কোনম ঢিল পড়েনি মাঠে। পড়েনি জলের বোতল। সবুজ-মেরুন, লাল-হলুদ পতাকা উড়েছে অবাধে। আবির না উড়লেও বেজেছে ব্যান্ড।
দু’মাস আগের কলঙ্কিত ডার্বির রেশ কিন্তু ছিল পুরোমাত্রায়। তা নিয়ে প্রতিপক্ষ গ্যালারিকে লক্ষ্য করে টিকা-টিপ্পনিও জারি ছিল। লাল-হলুদ থেকে বিরতির পর ওডাফাদের মাঠে নামতে দেখে ভেসে এসেছে, “দেখুন, দেখুন। টিভিতে ব্রেকিং নিউজ দিচ্ছে, মোহনবাগান এ বার দল তুলে নেয়নি। মাঠে নামছে।” পাল্টা মন্তব্যও এসেছে বাগান সমর্থকদের কাছ থেকে, “এ বার বিষ্ণু চৌহান নেই। ওডাফাও লাল কার্ড দেখে বেরিয়ে যায়নি। তোরাও জিতবি না।” সবই হয়েছে। তবে সেটা উৎসবের মেজাজে। মৈত্রীর মন্ত্রে। গ্যালারিতে পুলিশ থাকলেও তাদের লাঠি চালাতে হয়নি।
নজিরবিহীন নিরাপত্তায় মুড়ে থাকা যুবভারতীর সবুজ ক্যানভাসে কলঙ্কের ছিটে লাগেনি। ম্যাচ ঝামেলাহীন অবস্থায় শেষ হলেও মাঠ ও মাঠের বাইরের দুটি সিদ্ধান্ত নিয়ে তীব্র বিতর্ক শুরু হয়েছে।
ফিফা রেফারি কেরলের সন্তোষ কুমারকে কাঠগড়ায় তুলেছে মোহনবাগান, তাদের নিশ্চিত পেনাল্টি থেকে বঞ্চিত করার জন্য। |
আর ডার্বির ইতিহাসে সবচেয়ে কম দর্শক কেন হল, তা নিয়ে ম্যাচ সংগঠক মোহনবাগানের সিদ্ধান্তের দিকে আঙুল তুলেছে ইস্টবেঙ্গল। যাতে জড়িয়ে পড়েছেন রাজ্যের ক্রীড়ামন্ত্রী স্বয়ং।
এ বারের আই লিগের প্রথম ডার্বির কথা মাথায় রেখে ম্যাচের পর টোলগে-উগা ওপারা বা ওডাফা-চিডিরা শুভেচ্ছা বিনিময় করেছেন। তাল কেটেছে শুধু দুই কোচের ব্যবহারে। যাঁরা ম্যাচের চব্বিশ ঘণ্টা আগে শান্তির বার্তা দিয়েছিলেন সমর্থকদের জন্য, ম্যাচের পর সেই ট্রেভর জেমস মর্গ্যান আর করিম বেঞ্চারিফা একে অন্যের বিরুদ্ধে কটাক্ষের কামান দেগেছেন। শ্লেষাত্মক মন্তব্য করেছেন।
খেলার শেষে অন্য ম্যাচের মতো এ দিন মর্গ্যান হাত মেলাতে যাননি বিপক্ষ কোচের দিকে। খেলা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই গটগট করে বেরিয়ে যান মাঠ থেকে। টানেল ধরে সোজা ড্রেসিংরুম। আর করিম! মর্গ্যানকে এড়াতে ব্রিটিশ কোচের দিকে না তাকিয়েই ঢুকে যান মাঠে। দু’দলের ফুটবলারদের শুভেচ্ছা জানাতে।
সাংবাদিক সম্মেলনে এসে দুই কোচই অবশ্য বিস্ফোরক!
দ্বিতীয়ার্ধে টোলগের শট উগা ওপারা হাত দিয়ে থামালেও কেন পেনাল্টি দেওয়া হল না, তা নিয়েই শুরু হয়ে গেল চাপান-উতোর। ৫৩ মিনিটে বিতর্কিত ঘটনার পর রেফারিকে ঘিরে ধরেছিলেন টোলগে-মণীশ-জুয়েলরা। কিন্তু সেটা মাত্রা ছাড়া হয়নি। ক্ষোভের মধ্যেই আবদ্ধ থেকেছে। সম্ভবত আগের ডার্বির ঝামেলার কথা ভেবে।
সাংবাদিকদের সামনে এসে মর্গ্যান অবশ্য বলে দিলেন, “আমি যেখানে ছিলাম সেখান থেকে পেনাল্টিটা ছিল কি না বলা সম্ভব নয়। ওরা ৪-৫-১ ফর্মেশনে এত রক্ষণাত্মক খেলল। এ রকম হলে গোল করা মুশকিল।” পাল্টা মরোক্কান করিমের কটাক্ষ, “রেফারির সিদ্ধান্ত নিয়ে কিছু বলতে চাই না। তবে আশা করব যে পেনাল্টিটা এ দিন পেলাম না সেটা যেন পরের কোনও ম্যাচে দিয়ে দেওয়া হয়।” মর্গ্যানের নাম না করে এর পর হাসতে হাসতে মোহন- কোচের মন্তব্য, “বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশে সবাই কোচিং করাতে এসেছে। যা ইচ্ছে বলতেই পারে। তবে ৪-৩-৩ ফর্মেশনটা ওর দেখা উচিত ছিল। আমি তো জিততে চেয়েছিলাম।”
রেফারির বিরুদ্ধে যখন কোচ-সহ মোহনবাগান শিবির ফুঁসছে তখন সংগঠক সবুজ-মেরুনের বিরুদ্ধেই ফের তোপ দেগেছেন ইস্টবেঙ্গল কোচ ট্রেভর মর্গ্যান। ডার্বির ৮৮ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে কম দর্শক এসেছিলেন এ দিন। হাজার পঁচিশেক। মর্গ্যান বলে দিলেন, “এখানকার যা অর্থনৈতিক অবস্থা তাতে এত দামের টিকিট হলে মাঠে কম লোক হবেই। এত দামের টিকিট করা ঠিক হয়নি।” ক্রীড়ামন্ত্রী মদন মিত্রও বলে দেন, “এরপর থেকে যাতে ৫০, ১০০ টাকারও টিকিট থাকে সেটা সংগঠকদের বলব। বেশি দামের জন্যই দর্শক আসেনি।” লাল-হলুদ এবং ক্রীড়ামন্ত্রীর জোড়া আক্রমণের সামনে মোহনবাগান সচিব অঞ্জন মিত্র অবশ্য নিজের সিদ্ধান্তের সপক্ষে বলে দিয়েছেন, “ইডেনে যদি দামি টিকিট কিনে দর্শকরা খেলা দেখেন তা হলে ডার্বিতে কেন দেখবেন না?” আড়াই গুণ বেশি দামে টিকিট করার পক্ষে তাঁর যুক্তি, “অবাঞ্ছিত দর্শকরা ঢুকতে পারেননি বলেই লোক কম হয়েছে। পুলিশ খুব সাহায্য করেছে। আমরা চাই লোক কম হলেও যাঁরা আসবেন তাঁরা শান্তিতে খেলা দেখুক।”
দর্শক কম হওয়ায় পুলিশের কাজও কমেছে। বিদেশের কায়দায় গ্যালারির দিকে পুলিশকে তাকিয়ে থাকতে হবে, প্রশাসনের নির্দেশ ছিল। কিন্তু যেখানে দর্শক ছিল না সেখানকার পুলিশরা চুটিয়ে খেলা দেখেছেন। ম্যাচের পর পাড়ার রক, চায়ের দোকানে পেনাল্টি নিয়ে বিতর্ক হয়েছে। তবে মালা পরানো হয়নি সকালে লাগানো কোনও পতাকায়, কোনও ফুটবলারের ছবিতে। যুবভারতীর সবুজ রং সবুজ থাকার মতোই বাজারে চিংড়ি, ইলিশের দাম যা ছিল তাই আছে। ম্যাচ ড্র, অঙ্ক কষা চলছে দুই শিবিরেই। লিগ টেবিলে কার ক্ষতি, কার লাভ তা নিয়ে। সে যাই হোক, বাঙালির পিঠে পুলি, বইমেলা, দুর্গাপুজোর মতো ডার্বিও যে উৎসবের রঙেই শেষ হয়েছে! এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কী আছে। |