৮ বছরের টালবাহানা শেষ সকাল ৮টায়
জমল কসাবের পর এ বার আফজল গুরু!
মাঝে মাত্র ৭৯ দিনের ব্যবধান। তার পর আজ আবার গোটা দেশকে চমকে দিয়ে সরকার জানাল, সকাল ৮টায় তিহাড় জেলে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছে ২০০১ সালে সংসদ হামলার অন্যতম প্রধান চক্রী আফজল গুরুকেও। পরে তিহাড়েরই তিন নম্বর কুঠুরির কাছে কবর দেওয়া হয়েছে জইশ-ই-মহম্মদের এই সন্ত্রাসবাদীকে।
গত ২১ নভেম্বর পুণের ইয়েরওয়াড়া জেলে ফাঁসি হয় ২৬/১১-এর একমাত্র জীবিত জঙ্গি আজমল আমির কসাবের। হুবহু সেই একই চিত্রনাট্য মেনে ফাঁসি হল আফজল গুরুরও। কিন্তু দুই ঘটনার মধ্যে সব থেকে বড় পার্থক্য হল, রায় ঘোষণা এবং ফাঁসির মধ্যে সময়ের ফারাক। আফজল গুরুর প্রাণদণ্ডের রায় হয় ২০০৫ সালের ৪ অগস্ট, ২৬/১১-র সন্ত্রাসবাদী হামলারও তিন বছর আগে। অথচ কসাবকে ফাঁসিতে ঝোলাতে সরকার বেশি সময় নেয়নি। হাতেনাতে ধরা পড়া পাকিস্তানি জঙ্গিকে যে দিন প্রাণদণ্ড দেওয়া হল, সে দিনও প্রশ্ন ছিল, আফজল গুরুর কী হবে? সংশয় ছিল সরকারের একাংশের মধ্যেই, আর কত দিন ঝুলে থাকবে বিষয়টি? তবে এর পরে আর বিশেষ সময় নেয়নি সরকার। প্রায় আট বছর ধরে দীর্ঘ টালবাহানার পরে শেষ পর্যন্ত আফজলকে ফাঁসি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। যা দেখে রাজনীতির কারবারিরা বলছেন, চমক একটা আছে ঠিকই। কিন্তু শাসক দলের আসল উদ্দেশ্য, রাজনৈতিক ভাবে ফায়দা তোলা। তাঁদের বক্তব্য, নরেন্দ্র মোদীকে সামনে রেখে বিজেপি যখন ভোটে নামতে চাইছে, তখন জাতীয়তাবাদের হাওয়া কাড়তেই এই পথে হাঁটল কংগ্রেস। একই সঙ্গে এই প্রশ্নও উঠেছে যে, এই সাহসিকতার মধ্যে কি লোকসভা ভোট এগিয়ে আনার ইঙ্গিত রয়েছে?
সে দিন সংসদে
মুখে অবশ্য কংগ্রেস নেতারা আজ বলেছেন, এই সিদ্ধান্তের পিছনে রাজনীতি খুঁজতে যাওয়া অর্থহীন। তা ছাড়া আফজলের ফাঁসির সিদ্ধান্ত নিতে মোটেও দেরি করেনি সরকার। প্রথা ও আইন মেনে যথাসময়ে প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
আজ সকালে ফাঁসি হওয়ার আড়াই ঘণ্টা পরে সাংবাদিক বৈঠক করে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীলকুমার শিন্দে জানান, আফজলের মৃত্যুদণ্ড মকুবের আর্জি খারিজ করার সুপারিশ আগেই পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রতিভা পাটিলের কাছে। কিন্তু প্রণব মুখোপাধ্যায় রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হওয়ার পর এ ব্যাপারে ফের সরকারের মত জানতে চান। গত ২১ জানুয়ারি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক তাঁকে সরকারের মত জানায়। তার পরে ৩ ফেব্রুয়ারি আফজল গুরুর প্রাণদণ্ড মকুবের আর্জি খারিজ করে দেন রাষ্ট্রপতি।
কিন্তু শিন্দে যতই বিষয়টিকে সহজ ভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করুন, কংগ্রেসেরই অনেক নেতা বলছেন, ব্যাপারটা এত সরল নয়। যে মানুষটিকে প্রায় আট বছর ধরে ‘কনডেমন্ড সেল’-এ (ফাঁসির আসামিদের জন্য বিশেষ কুঠুরি) দিন কাটাতে হচ্ছিল, তাঁকে কয়েক দিনের নোটিসে ফাঁসিতে ঝোলানো যায় না। তার জন্য কিছুটা হলেও প্রস্তুতি দরকার। কংগ্রেস সূত্রেই খবর, আফজলকে ফাঁসি দেওয়া হবে এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরে জম্মু-কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তাঁকে বিষয়টি জানিয়ে বলা হয়, কাশ্মীরের পরিস্থিতি সামলে রাখাটাই এখন সব থেকে বড় পরীক্ষা হতে চলেছে। সে জন্য ওমর এ দিন রাজ্যবাসীকে বলেছেন, “অনুরোধ করছি, শান্ত থাকুন।”
শুধু ওমরকে জানানোই নয়, দেশ জুড়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা কেমন, তা খতিয়ে দেখারও দরকার ছিল। কংগ্রেসের অনেক নেতাই বলছেন, এ সব কাজ সারতে সময় তো লাগবেই। তাই ফাঁসির সিদ্ধান্ত সম্ভবত এক-দেড় মাস আগেই নেওয়া হয়েছে। এক দল বলছেন, হয়তো কসাব আর আফজল গুরুর ব্যাপারে একসঙ্গেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সনিয়া-মনমোহন। অপেক্ষা করছিলেন শুধু সঠিক সময়ের। রাষ্ট্রপতির ছাড়পত্র নেওয়াটা তো নিয়মরক্ষা ছাড়া আর কিছুই নয়।
তবে এই ক’দিনের তৎপরতার আগে প্রায় আট বছর ধরে আফজলের ফাঁসি নিয়ে যা হয়েছে, তা টালবাহানারই ইতিহাস। সর্বোচ্চ আদালতের ফাঁসির নির্দেশ হওয়ার পরে ২০০৬ সালের অক্টোবরে আফজলের মৃত্যুদণ্ড মকুবের জন্য তাঁর স্ত্রী তবসুম গুরু তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এ পি জে আব্দুল কালামের কাছে আর্জি জানান। তখন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শিবরাজ পাটিল। কিন্তু শিবরাজ এর পরের দু’বছর স্রেফ এই বলে সময় কাটিয়ে দেন যে, আর্জি বিবেচনা করে দেখা হচ্ছে। শিবরাজের পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হন চিদম্বরম। তিনিও বিষয়টি বারবার এড়িয়ে যান। এমনকী, একটা সময় আফজলের ফাঁসি নিয়ে চিদম্বরমের সঙ্গে দিল্লি প্রশাসনের মধ্যে প্রকাশ্যেই চাপানউতোর শুরু হয়ে যায়। চিদম্বরম বলেছিলেন, আফজলকে ফাঁসি দিলে রাজধানীর নিরাপত্তার ক্ষেত্রে কী প্রভাব পড়বে, তা দিল্লি সরকারের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে। কিন্তু তারা এখনও জবাব দেয়নি। তাঁর সেই কথা শুনে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী শীলা দীক্ষিত বলেন, তাঁর সরকার এ ব্যাপারে রিপোর্ট অনেক আগেই পাঠিয়ে দিয়েছে দিল্লির লেফটেন্যান্ট গভর্নর তেজেন্দ্র খন্নার কাছে। এই কথা শুনে খন্না জানান, তিনি ফাইলটি নিজের কাছে না রেখে সঙ্গে সঙ্গে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকে পাঠিয়ে দিয়েছেন। ফলে চিদম্বরম যে দিল্লি সরকারের কোর্টে বল ঠেলে দিতে চাইছিলেন, তা আবার তাঁর কাছেই চলে আসে। তখন তিনি নিজেই আবার বলেন, বিষয়টি এখন রাষ্ট্রপতির বিবেচনাধীন।
তবে কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্ব আজ ঘরোয়া আলোচনায় স্বীকার করেছেন, প্রধানত দু’টি কারণে এত দিন সিদ্ধান্ত নিয়ে উঠতে পারেনি সরকার। প্রথমত, আশঙ্কা ছিল আফজলকে ফাঁসি দিলে উপত্যকা ফের অশান্ত হয়ে উঠতে পারে। কেন না, এ ব্যাপারে হুরিয়ত নেতৃত্ব থেকে শুরু করে কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী বারবার কেন্দ্রকে বারণ করছিলেন। একই কারণে আপত্তি তুলেছিলেন গুলাম নবি আজাদ-সহ কংগ্রেসের বহু নেতাও। তাঁদের বক্তব্য ছিল, কাশ্মীরের মানুষের সঙ্গে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রক্রিয়া এর ফলে ভেস্তে যাবে। এবং তার সুযোগ নেবে পাকিস্তান। এ ক্ষেত্রে কসাবের সঙ্গে আফজলের তুলনা করাও ঠিক নয়। কসাব পাক জঙ্গি আর আফজল কাশ্মীরের ভূমিপুত্র। তাই কসাবের ক্ষেত্রে না হলেও আফজলের বেলায় সমস্যা হতেই পারে। বস্তুত, তাঁদের সেই আশঙ্কা সত্যি করে এ দিনই অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছে কাশ্মীর। কংগ্রেসের দ্বিতীয় উদ্বেগটি একেবারে রাজনৈতিক। দলের একাংশের আশঙ্কা ছিল এতে সংখ্যালঘু ভোট হাতছাড়া হতে পারে।
তা হলে হঠাৎ কেন সাহসী হয়ে উঠল সরকার?
সরকার ও কংগ্রেসে শীর্ষ নেতৃত্বের বক্তব্য, এ-ও এক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এর পিছনে অন্যতম প্রধান কারণ, জাতীয় রাজনীতিতে নরেন্দ্র মোদীর উত্থানের সম্ভাবনাকে মোকাবিলা করা। তাই গুজরাত নির্বাচন এবং মোদীর ঘনঘন দিল্লি আগমন হয়তো অনুঘটকেরই কাজ করেছে।
তবে আফজলকে ফাঁসি দেওয়ার পরেও কংগ্রেস বা সরকার যে খুব নিশ্চিন্ত, তা নয়। বরং অনেকটাই টানটান উত্তেজনা রয়েছে দিল্লির অন্দরে। কারণ, সামনে কুম্ভের বড় স্নান। সেখানে সন্ত্রাসবাদী হামলার আশঙ্কা রয়েছে। আশঙ্কা তৈরি হয়েছে কাশ্মীর পরিস্থিতি নিয়েও। মানবাধিকার সংগঠন বা কর্মীদের সমালোচনাও রয়েছে। এ দিনই প্রশ্ন উঠেছে, ফাঁসিতে যখন ঝোলানোই হবে ঠিক ছিল, তখন আট বছর ধরে তিল তিল করে কেন মারা হল আফজলকে? এই সবের মোকাবিলায় অবশ্য এর মধ্যেই মুখ খুলেছেন সরকার ও কংগ্রেসের নেতারা। ফাঁসির পক্ষে যুক্তি সাজিয়েছেন তাঁরা। পাশাপাশি হিসেব কষছেন, এর ফলে কতটা লাভ হল দলের? কেউ কেউ অবশ্য প্রশ্ন তুলেছেন, আদৌ লাভ হল কি?

১৩ ডিসেম্বর, ২০০১: গাড়িতে লাল বাতি, সরকারি স্টিকার। ফৌজি বেশে ৫ জঙ্গির হানা সংসদ চত্বরে। হত ৮ রক্ষী ও ১ মালি। হত জঙ্গিরাও।
১৫ ডিসেম্বর, ২০০১: হামলার ষড়যন্ত্রে যুক্ত থাকা ও জইশ-ই-মহম্মদ জঙ্গিদের আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগে গ্রেফতার আফজল গুরু।
৪ জুন, ২০০২: চার্জ গঠন

আফজল গুরু

এস এ আর গিলানি

শওকত হুসেন গুরু
ও আফসান গুরুর
বিরুদ্ধে।
১৮ ডিসেম্বর, ২০০২: দায়রা আদালতে মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা আফজল, গিলানি, শওকতের। মুক্তি শওকতের স্ত্রী আফসান গুরুর।
২৯ অক্টোবর, ২০০৩: দিল্লি হাইকোর্টে আফজলের মৃত্যুদণ্ড বহাল ফৌজদারি দণ্ডবিধি ও পোটা আইনে। মুক্তি গিলানির।
৪ অগস্ট, ২০০৫: আফজলের মৃত্যুদণ্ড বহাল সুপ্রিম কোর্টে। শওকতের মৃত্যুদণ্ড মকুব করে ১০ বছরের কারাদণ্ড।
৩ অক্টোবর, ২০০৬: আফজলের মৃত্যুদণ্ড মকুবের দাবি নানা শিবিরে। রাষ্ট্রপতি আব্দুল কালামের কাছে ক্ষমাভিক্ষার আর্জি আফজলের স্ত্রীর।
১২ জানুয়ারি, ২০০৭: মৃত্যুদণ্ড পুনর্বিবেচনার আর্জি খারিজ সুপ্রিম কোর্টে। “পুনর্বিবেচনা করার মতো কিছু নেই,” বলল কোর্ট।
১০ ডিসেম্বর, ২০১২: সংসদের অধিবেশন শেষেই আফজলের ফাইল নিয়ে বিবেচনা, জানালেন নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীলকুমার শিন্দে।
৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩: ক্ষমাভিক্ষার আর্জি খারিজ করলেন রাষ্ট্রপতি। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিল কেন্দ্র। প্রস্তুতি শুরু প্রশাসনে।
৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩: সকাল আটটায় তিহাড় জেলে ফাঁসি আফজল গুরুর। কবর দেওয়া হল জেলের তিন নম্বর কুঠুরির কাছে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.