পেল্লায় হোর্ডিং বলছে, তোমারি ধূলামাটি অঙ্গে মাখি ধন্য জীবন মানি!
কিন্তু লালবাবার আশ্রমের মাঠে দ্রুত পায়ে মেলায় চক্করের সময়ে বাতাসে ধুলোর বিস্ফোরণে মুখ্যমন্ত্রীই মেজাজ হারালেন।
“এত ধুলো উড়লে কী করে হবে!”— বলতে বলতে শনিবার দুপুরে ধুলো উড়িয়েই ঢেঁকি-ছাঁটা চাল গুঁড়নো পিঠের লাইভ কাউন্টারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর থেকে সামান্য তফাতে হামলে-পড়া জনতা, মন্ত্রী-সান্ত্রী, আলোকচিত্রীর দল। মছলন্দপুরের গ্রাম্যবধূ সুনীতা দাস মুখ্যমন্ত্রীকে ঢেঁকি চালাতে পীড়াপীড়ি করছিলেন। তখনই দড়াম শব্দে বাইরে ফুলগাছের টব উল্টোল। দু’দিন আগেই বইমেলার মাঠে তাঁর গাড়ি আসতে দেরি হওয়ায় নিরাপত্তারক্ষীদের চাবকানোর হুমকি দেন মুখ্যমন্ত্রী। এ যাত্রা রেগেমেগে ওই তল্লাট থেকে তিনি ছিটকে বেরিয়ে এলেন।
একটু বাদে মেলার মাঠে গড়ে ওঠা ধানের বীজতলায় হাওয়াই চটি খুলে নেমে ধান পুঁতে তাঁর মেজাজ শরিফ হল। তখন ফের ঢেঁকির কাছে গিয়ে সুনীতাদের মন রাখতে কিছু ক্ষণ পায়ে-পায়ে ধান ভানা চলল। সুনীতাদের মুখে হাসি ফুটলেও বেলপাহাড়ির নবকুমার মিস্ত্রি বা অক্কুর সিংহের অবশ্য কপাল খোলেনি। তাঁদের বলা হয়েছিল, প্রস্তুত থাকতে। মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং এসে পাথর কুঁদে শিল্পসৃষ্টির নমুনা দেখবেন। সেই মতো দুই প্রৌঢ় পাথর বেছে সকাল থেকে শিবলিঙ্গ গড়ার মহড়া দিচ্ছিলেন। ছৌয়ের মুখোশ, মাটির পুতুল থেকে ডোকরা-শিল্পের বিপণিতে ঝটিকা-সফরের সময়ে শেষ পর্যন্ত তাঁদের দিকটায় মমতার পদধূলি পড়ল না। |
মুখ্যমন্ত্রীর প্রাণের মাটি-উৎসবের উদ্বোধনী আসরে মনমেজাজের এমন নানা রঙই মিশতে দেখা গেল। তবু কোনটা যে এই উৎসবের রং, তা নিয়ে ধন্দও শেষমেশ বহাল রইল। দু-দু’টো ছবি এঁকে শ্রান্ত যোগেন চৌধুরী যেমন, ভাবতে ভাবতে হাল ছেড়ে দিলেন। সবুজ, নীল, কালো, হলদেটে হতে পারে! কিংবা মাটি মানে মানুষ যেখানে জন্মায় বা ফসল ফলায়! ধুর, মাটির আবার কোনও একপেশে রং হয় নাকি?--- সহাস্য বললেন যোগেন চৌধুরী। শুভাপ্রসন্ন বললেন, “মাটি বলতে আমার তো পেঁচার কথা মনে হল। গ্রামবাংলার শুভঙ্কর প্রতীক লক্ষ্মী পেঁচা।”
খোলা মঞ্চের ক্যানভাসে পেঁচা ও তাঁর প্রিয় কাকের ছবিই আঁকলেন শুভাপ্রসন্ন। তিন শিল্পী মুখ্যমন্ত্রী নিজে এবং তাঁর প্রিয় শুভাদা ও যোগেনদার ছবির মধ্যে মাটি উৎসবের রং খুঁজতে গেলেও সংশয়। শুভাপ্রসন্ন কাক-পেঁচা আঁকলেও যোগেন প্রাকৃতিক দৃশ্য এঁকেছেন। তিনি বললেন, এই ভিড়, হইচইয়ের মধ্যে গভীর কোনও বিষয় আঁকা যায় না। তাই সহজ, সুন্দর একটা কিছু আঁকলাম। আর মমতা এঁকেছেন একটি নারীমুখ, তাতে নানা রঙের আভাস। আর একটি লালরঙা ক্যানভ্যাসে ফুল-পাতার আদল! নিজের ছবি প্রসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী ক’দিন আগে টাউন-হলের প্রদর্শনীতে বলেছিলেন, “স্যাটাস্যাট মেরে দিয়েছি!” এ দিনও প্রথিতযশা দুই শিল্পীর ঢের আগে দু’টি ছবি সেরে দর্শকাসনে সামনের সারিতে ইন্দ্রনীল সেনের গান শুনতে বসে পড়লেন।
যোগেন-শুভাপ্রসন্নদের আঁকা শেষ হওয়ার আগেই নাট্যকর্মী অর্পিতা ঘোষ ঘোষণা করে দিলেন, তিন চিত্রকরের ছ’টি ছবিই বাউল-লোকশিল্পীদের সাহায্যার্থে ১০ লক্ষ টাকায় এক ব্যক্তি কিনে ফেলেছেন।
মাটি উৎসব কি তবে বাউল-উৎসব? নাকি মঞ্চে প্রতুল মুখোপাধ্যায়-ইন্দ্রনীল-নচিকেতাদের আধুনিক বা জীবনমুখী সঙ্গীতের?
শেক্সপিয়র কবেই বলেছেন, হোয়াট্স ইন আ নেম! শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর ভাষায় মৃত্তিকাচারী লেখক মহাশ্বেতা দেবী বুঝিয়ে বললেন, “এ হল মায়ের উৎসব। মাটি-উৎসব নিজের মাকে নিয়ে উৎসব! এক মহান-উৎসব।” সাম্প্রতিক রুশদি-কাণ্ড বা অতীতে আরও কয়েকটি ঘটনায় তৃণমূল সরকারের কড়া নিন্দা করেছিলেন মহাশ্বেতা। মাটিরঙা শাড়ি পরে মঞ্চে আসীন মহাশ্বেতা দেবীই এ দিন তাঁর হাতে এগিয়ে দেওয়া একটি খাতা থেকে এ রাজ্যে ৩৪ বছরের অপশাসনের পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ২০ মাসের সরকারের ‘সাফল্যে’র খতিয়ান তুলে ধরলেন। ‘রবীন্দ্রনাথ যেমন বহু উৎসবের সূচনা করেছিলেন, তেমনই মমতার অবদান এই মাটি-উৎসব।’ এ কথা বলেছেন শুভাপ্রসন্ন। মমতার অনেক মন্ত্রীই মাটিরঙা পাঞ্জাবি খুঁজে পাননি। মমতা কিন্তু মাটিরঙা আঁচলের শাড়িতেই এসেছিলেন। বললেন, “মাটি উৎসব ইজ আ নিউ কনসেপ্ট। এই উৎসব এক দিন সবাই গ্রহণ করবে। বাংলা পথ দেখাবে।”
কিন্তু যাঁদের জন্য প্রায় দশ কোটি টাকা খরচ করে এই এলাহি উৎসব, তাঁরাই কিছুটা ধন্দে পড়েছেন। পূর্বস্থলীর অজগাঁয়ের বরজহান শেখ বা তারাপদ রায় এক মন্ত্রীর নির্দেশমাফিক লাঙল নিয়ে হাজির। চেয়েচিন্তে একটা হুঁকোও জোগাড় করেছেন।
বরজহান বললেন, “আজকাল তো লাঙলে চষা প্রায় উঠেই গিয়েছে। ট্র্যাক্টরের জমানা! হুঁকোও বিদায় নিয়েছে। বিড়ি-সিগারেটের যুগ এখন। তবু স্যারেরা বললেন, তাই আনতি হল!” সাজানো বীজতলায় ধান রুইতে রুইতে কাছেই ত্রিলোকচন্দ্রপুর অঞ্চলের সুমিত্রা মুর্মু বা অজয়-দামোদরের জেলে শিবশঙ্কর মণ্ডলও বললেন, এ ভাবেই তো রোজ করি! কেন যে মুখ্যমন্ত্রী দেখতে চাইলেন? মঞ্চ থেকে মমতা উৎসবে উপস্থিত লোকশিল্পীদের জন্য ২৫০০ টাকা সাম্মানিক ঘোষণার পরে শিবশঙ্কর বলছিলেন, কে জানে বাপু! আমাদের কত দেবে! কিছু তো কেউ বলল না!”
বক্তৃতায় মাটি-বিষয়ক স্লোগানের ফুলঝুরির সঙ্গে বাউল লোকশিল্পীদের পাশে দাঁড়াতে তথ্যভাণ্ডার তৈরির কথা বলেছেন মমতা। বলেছেন, বাউল বা আদিবাসী লোকনাচের মাধ্যমে বাল্যবিবাহ বা পোলিও প্রতিরোধের কাজ করা হবে। তাতে গ্রামীণ শিল্পের উন্নতি ঘটবে। মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, “অনেকে ভাবে শুধু ফিল্ম বা যাত্রা-শিল্পই শিল্প! গ্রামীণ শিল্প কি শিল্প নয়!” বৃহৎ বাণিজ্যিক শিল্প ও কলাশিল্পকে এক করে দেখিয়ে আগেও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। মাটি-উৎসবেও শিল্প নিয়ে নিজের ব্যাখ্যায় তিনি অনড় থেকেছেন।
উৎসব করা নিয়ে বিরোধীদের কটাক্ষকে যে মুখ্যমন্ত্রী আদৌ আমল দিচ্ছেন না, মাটি-উৎসবেও তা পরিষ্কার। কৃতী চাষি থেকে গুণী লোকশিল্পীসবার জন্য অকাতরে ইনাম ঘোষণা করেছেন তিনি। অনেকটা পুজোর থিমের আদলে উৎসব তথা মেলার আয়োজনেও কার্পণ্য নেই। মাঠের কোথাও বিশাল পুকুর খুঁড়ে, কোথাও ধানজমি বসিয়ে কৃষি ও মৎস্যচাষের উপস্থাপনার পাশাপাশিই রয়েছে রবীন্দ্র-নজরুলের জীবন নিয়ে স্টল। উদ্বোধনী-আসরে ধামসা-মাদল বাজিয়ে বাউল গানের সঙ্গে সাঁওতালি নৃত্যের পরে সন্ধ্যায় নট্ট কোম্পানির যাত্রা ‘পরিব
সকালে মেলায় ঢোকার আগে পানাগড় বাজারে কাঁকসা ব্লক তৃণমূল কংগ্রেসের একটি ট্যাবলো চোখে পড়ল। দৃপ্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে মা-মাটি-মানুষের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ঠিক উপরেই ‘সৌজন্যে’ অমুক-মার্কা কাচ্চি ঘানি সর্ষের তেল কোম্পানি। সীতারামপুরের চবলপুর গ্রামের সংস্থা। দেখে এক পথচারীর টিপ্পনী, দেখেছেন, দিদি কেমন মাটিতে কৃষি আর শিল্পকে মিলিয়ে দিয়েছেন। |