পশ্চিম বান্দ্রায় জগার্স পার্কের ঠিক কোনাকুনি এখন তাঁর নয়া আস্তানা। সচিন তেন্ডুলকর কেয়ার অব মুম্বই লিখলেই যে কোনও চিঠি হাতে পৌঁছে যাওয়ার সম্ভাবনা। তার সঙ্গে কেউ যদি যোগ করে, নিয়ার জগার্স পার্ক, প্রেরকের সম্ভাবনা আরও পাকা হবে।
অত্যাধুনিক চারতলা সেই বাড়ি থেকে দ্রুত হাঁটলে আড়াই মিনিট। গজেন্দ্রগমনে পাঁচ মিনিট। কার্টার রোডের ওপর দাঁড়িয়ে আছে বহুচর্চিত সেই আশীর্বাদ বাংলো। বিষ্যুদবার রাতে এক এলাকাবাসী বলছিলেন, কাছাকাছি দুটো বাড়ির মালিকের জীবনদর্শন তাঁদের পৃথিবীটাকে কেমন আলাদা করে দিয়েছে! তিনিরাজেশ খন্না এমন আকাশচুম্বী সাফল্য পেয়েও সেই মদমত্ততার স্রোতে ছিটকে গেলেন। বেহিসাব, বিশৃঙ্খলা আর নিয়মানুবর্তিতার অভাব নিয়ে তিনি ইতিহাসে থেকে গেলেন ঠিকই। কিন্তু ট্র্যাজিক রোম্যান্টিক নায়ক হিসেবে। রাজেশের সেরা ছবিগুলোর গল্পের মতোই চরম বিয়োগান্ত পরিণতি নিয়ে।
ইনিসচিন তেন্ডুলকর সেই দশ বছর বয়স থেকে কোনও কিছুই চান্সের ওপর ছাড়েননি। আজ চল্লিশ বছর থেকে মাত্র দু’মাস দূরেও সকালে সবার আগে নেটে ঢোকেন। আবার মুম্বইয়ের হয়ে খেলা হলে ওয়াংখেড়ে থেকে বেরনোরও বাঁধাধরা সময় রয়েছে। বিকেল সাড়ে চারটে। তার এ দিক-ও দিক হবে না। ওটা যদি দশ মিনিটও দেরি হয়ে যায়, দক্ষিণ মুম্বই থেকে বান্দ্রা পৌঁছতে সময় লেগে যাবে অতিরিক্ত পঁয়তাল্লিশ মিনিট। মুম্বই অফিস টাইমের কুখ্যাত যানজট দেড় ঘণ্টার দূরত্বকে যে সোয়া দু’ঘণ্টায় নিয়ে যায় সচিন বারবার হিসেব করেছেন। অতিরিক্ত পঁয়তাল্লিশ মিনিট আর চান্স ফ্যাক্টরে নিচ্ছেন না। এ সব দিক দিয়ে তিনি অ্যান্ডি মারের কোচের মতো। ইভান লেন্ডলোচিত! |
এ দিন ওয়াংখেড়েতে স্টাম্পের ভেতরে আসা বলগুলোতে তাঁকে অতি আক্রমণাত্মক দেখে। প্রজ্ঞান ওঝার মতো দেশের এক নম্বর বাঁহাতি স্পিনারকে অনূর্ধ্ব চোদ্দোর স্তরে নামিয়ে আনতে দেখে মনে হচ্ছিল, এখানেও কি চান্স ফ্যাক্টরের ওপর প্রচুর কাজ করা হয়েছে? নইলে এই ডিসেম্বর মাসেই তো জাতীয় বিতর্ক উঠে গিয়েছিল, তিনি বাঁহাতি পানেসরকে খেলতে পারছেন না। আর অ্যান্ডারসনের ভেতরে আসা বলে বারবার আউট হচ্ছেন। জাতীয় বিতর্ক এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে, জাতীয় নির্বাচকেরা বসে যান তাঁর সঙ্গে কথা বলতে। কী ভাবছেন সচিন তাঁর ভবিষ্যৎ নিয়ে? অভিমানে এর পর বোর্ডকে একটা মেল পাঠিয়ে ওয়ান ডে থেকে অবসর নিয়ে নেন সচিন। ডিসেম্বরের সেই সচিন যেন ‘আনন্দ’-এর বাবুমশাই! যার ক্রিকেট-পারের কড়ি ফুরিয়েছে।
ফেব্রুয়ারিতে যে সচিনকে একান্তে দেখলাম, তাঁর পক্ষে ৩৪৩ মিনিট ক্রিজে থেকে ১৯৭ বল খেলে করা অপরাজিত ১৪০ মোটেও অস্বাভাবিক নয়। অবশিষ্ট ভারতের আক্রমণকে ছেলেমানুষির স্তরে নামিয়ে আনা। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে গাওস্করের চেয়ে ৪৬ ম্যাচ কম খেলেও ৮১ সেঞ্চুরির যুগ্ম রেকর্ড আরও বেশি কৃতিত্বের। কিন্তু এ সবই নিছক ক্রিকেটীয় প্রতিবিম্ব। এই মুহূর্তের আয়নায় যে তেন্ডুলকর ধরা পড়লেন, তিনি সেই পুরনো লোকটা। যার চোয়াল প্রতিজ্ঞায় স্থির। যার শরীরের প্রতিটি রোমকূপ ক্রিকেটজীবনের চূড়ান্ত চ্যালেঞ্জ নেওয়ার জন্য টগবগ করছে।
ওয়াংখেড়েতে যাঁরা বিপক্ষে বল করলেন তাঁরা অবশ্যই মিচেল জনসন, পিটার সিডল, জেমস প্যাটিনসন, মিচেল স্টার্ক নন। অভিমন্যু মিঠুন, পাণ্ডে বা শ্রীসন্থের বল ১৩৫ কিলোমিটারেই পৌঁছয়নি। তবু বিপক্ষ, পরিস্থিতি বা রানের বাইরেও একটা অদৃশ্য হিসেব থাকে। ইরানি কাপের তেন্ডুলকরকে মাঠে-মাঠের বাইরে দেখে সেই হিসেবের কথাই প্রথম মনে হবে। যাকে বলা যেতে পারে এক্স-ফ্যাক্টর। |
আবছায়ায় তা যেন চরম প্রতিজ্ঞা! ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে চেন্নাইয়ে যে প্রতিজ্ঞার প্রথম অঙ্ক অভিনীত হতে যাচ্ছে। চলবে এক মাস ধরে। নতুন তেন্ডুলকরকে তাঁর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটজীবনের রজত জয়ন্তী বর্ষে দেখে মনে হচ্ছে, বরাবরের মতো এ বার শুধুই ভারতের হয়ে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে খেলছেন না। তাঁর এ বারের ব্যাটিং সচিন-বিশ্বাসী দলের হয়ে সচিন-অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে। সেই বিপক্ষ দলে যে শুধুই অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটার নেই।
আচমকা ওয়ান ডে অবসরের পর লাখ-লাখ বার্তা পেয়েছেন তিনি, এটা কী করলে? এই সচিন আর আচমকা অবসরের বান্দা নন। এ বারেরটা মনে হচ্ছে, যখনই হোক নিশ্চিত ভাবে ক্রিকেট মাঠ থেকে হবে। নতুন বিপক্ষ তো আর অস্ট্রেলীয় নয়। সেরা সময়ের অস্ট্রেলীয়দের স্লেজিংই শোনেননি। তো ক্রিকেটজীবনের সায়াহ্নে নতুন বিপক্ষের শুনতে যাবেন কোন দুঃখে। যাবতীয় নেটওয়াকির্ং সাইটগুলো শুক্রবার বিকেল থেকে গর্জন করেছে, ইরানির সেঞ্চুরির বার্তা হল: ওহে অস্ট্রেলিয়া স্বাগত!
কাছ থেকে দেখে মনে হল, এ বারের ব্যাখ্যা তা নয়। নতুন বিধান হল: নিজে এসেছিলাম। কখন যাব নিজে ঠিক করব। চান্সের ওপর কিছু রাখব না। বিয়োগান্ত পরিণতি মেনে নিতে আমি রাজি নই। ওটা প্রতিবেশীর টেমপ্লেট হয়েই থাক।
|
মাস্টারস্ট্রোক |
তেন্ডুলকর ৮১ |
গাওস্কর ৮১ |
টেস্টে ৫১
রঞ্জি ট্রফিতে ১৮
দলীপ ট্রফিতে ৩
ইরানি কাপে ২
বিদেশ সফরে প্রস্তুতি ম্যাচে ৫
দেশে সফরকারী দলের বিরুদ্ধে ১
কাউন্টিতে (ইয়র্কশায়ার) ১
(ম্যাচ ৩০২) |
টেস্টে ৩৪
রঞ্জি ট্রফিতে ২২
দলীপ ট্রফিতে ৬
ইরানি কাপে ১
বিদেশ সফরে প্রস্তুতি ম্যাচে ১৪
দেশে সফরকারী দলের বিরুদ্ধে ১
কাউন্টিতে (সমারসেট) ২
অবশিষ্ট বিশ্ব একাদশের হয়ে ১
(ম্যাচ ৩৪৮) |
সচিন মাইলস্টোন ছুঁলেন গাওস্করের থেকে ৪৬ ম্যাচ কম খেলে |
|