|
|
|
|
|
|
|
বেড়ানো... |
|
বাই বাই হংকং |
সাজানো শহরের গায়ে এসে ধাক্কা মারছে নোনা জলের স্রোত। রাস্তার পাশে ছোট ছোট
দোকানে অ্যাকোয়ারিয়াম নিয়ে বসে রয়েছে দোকানি। ঘুরে এসে লিখছেন সুনন্দ ঘোষ |
রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে ভিক্টোরিয়া হিলসের শান বাঁধানো রাস্তায় হাঁটতে শুরু করল সুমৌলি। ওর শাড়ির উপরে কার্ডিগান। গলায় জড়ানো লাল রঙের স্কার্ফ। গতকাল হংকং-এ পৌঁছে একটা শপিং মল থেকে কিনে দিয়েছে শান্তনু।
চারদিকে হালকা কুয়াশা। ঝিরঝিরে বৃষ্টি। মাঝে মধ্যে এক একটা হাওয়ার ধাক্কায় কাঁপিয়ে দিচ্ছে শরীর।
রেলিং-এ ভর করে দাঁড়াল সুমৌলি। একটু বাদে শান্তনুও ঘন হয়ে এসে দাঁড়াল ওর পাশে।
নীচে তাকিয়ে ওরা দেখল, হালকা কুয়াশার মাঝে ফুটে উঠছে আবছা ছবি। পাহাড়ের উপর থেকে দেখা যাচ্ছে পরিপাটি করে সাজানো শহর। বহুতল বাড়ির ছড়াছড়ি। শহরের গায়ে এসে ধাক্কা মারছে নোনা জলের স্রোত।
এখানে কুয়াশা যেন নেশা ধরিয়ে দেয়। সেই নেশা নিয়েই ট্রামে চেপে নেমে যাওয়া যায় সোজা নীচে। তার আগে ঘুরেটুরে ঝকঝকে শপিং মলে টুকিটাকি জিনিস কেনাকাটা।
এক সময়ে এই তল্লাটেই ছিল জেলেদের একটি গ্রাম, স্ট্যানলে। শোনা যায়, জাপানিরা এই এলাকা ছিনিয়ে নিয়েছিল ব্রিটিশদের কাছ থেকে। সেখানে এখন নিয়মিত বসে খাবার আর সঙ্গীত মেলা। হঠাৎ এক এক দিন বিশ্বের তাবড় পাচকদের এনে তাঁদের দিয়ে রাঁধিয়ে-বাড়িয়ে হুলস্থূল বাঁধিয়ে দেওয়া হয়। অবিরাম বৃষ্টি, জমাট ঠান্ডাতেও সেই উৎসবের বিরাম থাকে না। এত প্রাণ চারদিকে! এ দিক ও দিক ঘুরলেই মন ভাল হয়ে যায়।
বিকেলের চায়ের পরে দু’জনে আবার হাঁটতে বেরল। তখনই ইন্তিখাব আলমের সঙ্গে দেখা, কিমবারলি রোডে। হালকা বৃষ্টি। ফুটপাতের ধার ঘেঁষে, মাথা বাঁচিয়ে দাঁড়িয়েছিল ইন্তিখাব।
হংকং-এ এই জায়গাটার নাম সিম-সা-সুই। রাস্তার পাশে বড় বড় হোটেল। নামী-দামি সংস্থার বড় বড় বিপণি। নিয়নের আলো ঝলমল করছে প্রশস্ত রাস্তার দু’পাশে। তার মাঝেই ছোট এক ফালি ঘরে বসে এক যুবক ‘মানি এক্সচেঞ্জ’ করছে। ১০০ মার্কিন ডলার দিলে হাতে-গরম ৭৫০ হংকং ডলার। এ কাজে ভারতে পাসপোর্ট লাগে। বড় কাগজে সই-সাবুদ করতে হয়। সে সবের বালাই নেই হংকং-এ।
রাস্তার পাশে ছোট ছোট দোকানে অ্যাকোয়ারিয়াম নিয়ে বসে রয়েছে দোকানি। অ্যাকোয়ারিয়ামে জ্যান্ত চিংড়ি, শামুক, সামুদ্রিক মাছ সাঁতরে বেড়াচ্ছে। স্থানীয়রা এসে পছন্দমতো মাছ কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। রান্নার পরে সেই মাছের স্বাদ যা দাঁড়ায়, তার সঙ্গে বাঙালির রসনার কোনও মিল নেই। জিরে-বাটা, তেল-হলুদ-লঙ্কা না থাকলে যা হয় আর কী! |
|
পাথরে বাঁধানো ফুটপাথ। রাস্তাও পাথরের। ঝকঝকে। সেখান দিয়ে সাঁ-সুই করে ছুটে যায় পোরশে, বেন্টলে, মার্সিডিজ, বিএমডব্লিউ। দুম-দাম করে কেউ রাস্তা পেরোয় না। দোতলা বাসের ছড়াছড়ি। শহরের পাতাল দিয়ে চলে চার স্তরের মেট্রো। মাটির তলায় সারা শহরকে যেন সাপের মতো পেঁচিয়ে রয়েছে। সিম-সা-সুই-এর পথে কয়েক পা হাঁটলে সহজেই বোঝা যায়, এই দেশটা বেশ বড়লোকের। বেশ খরচসাপেক্ষ।
পাশ থেকে কে যেন বলে উঠল, “স্যুট বানাবেন নাকি স্যার?” অবাক হল শান্তনু। পরে শুনল, সারা পৃথিবীতেই নাকি হংকং-এর থ্রি-পিস স্যুটের কদর রয়েছে। বহু ভারতীয় এই পেশায় জড়িয়ে। শুধু স্যুট বানানোর ব্যবসা করতে তাঁরা হংকং-এ এসেছেন।
সিম-সা-সুই থেকে মেট্রো ধরে ভিক্টোরিয়া হারবারে এল সুমৌলিরা। সন্ধ্যায় ভিক্টোরিয়া হারবার-এর দু’পাশে আকাশ-চুম্বী সব অট্টালিকার মধ্যে আলোর প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। কোথাও উপর থেকে নীচে আলো জ্বলতে জ্বলতে নামছে, কোথাও অট্টালিকার গায়ে আলোয় ফুটে উঠছে বিভিন্ন ছবি।
সন্ধ্যা হলেই পর্যটকদের ভিড়। সমুদ্র থেকে অনেকটা খাঁড়ির মতো বেরিয়ে এসেছে। তারই দু’পাশে গগনচুম্বী অট্টালিকার সারি। মায়াবী আলোয় ছবি তৈরি হয় জলের উপরে। এই আলো, ভিক্টোরিয়া হিলস, ডিজনি-ল্যান্ড, লন্ডনের মাদাম-তুসোর আদলে মোমের পুতুল ঘর, সমুদ্র-ভ্রমণ, চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়া শপিং-মল পর্যটকদের টেনে আনছে হংকং-এ।
এত দিন ধরে কলকাতা থেকে যাঁরা আসতেন, তাঁদের হয় ব্যাঙ্কক বা চিনের কুনমিং ঘুরে আসতে হত। সম্প্রতি হংকং-এর সঙ্গে কলকাতার সরাসরি বিমান যোগাযোগ শুরু করেছে ড্রাগন এয়ার। সপ্তাহে চার দিন। হংকং-এর প্রধান বিমানসংস্থা ক্যাথে-প্যাসিফিকের সহযোগী তারা। সংস্থার চিফ এগ্জিকিউটিভ অফিসার প্যাট্রিক ইয়াং-এর কথায়, “মাত্র এক মাসেই কলকাতা থেকে ভাল যাত্রী পেয়েছি আমরা। এই হারে যাত্রী পেলে খুব তাড়াতাড়ি সপ্তাহে সাত দিন উড়ান চালাব।” বিমানে শতকরা ৬০ শতাংশ উচ্চ-শ্রেণির যাত্রী পাচ্ছেন বলেও প্যাট্রিক জানালেন।
কলকাতার এক ট্র্যাভেলসের জিএম দিব্যেন্দু ঘোষ বলছেন, দমদম থেকে আমেরিকামুখী অনেকে এখন হংকং ঘুরে যেতে চাইছেন। সময় কম লাগছে। তাঁর কথায়, “গত এক মাসে প্রচুর যাত্রী পেয়েছে ড্রাগন। শীতের ছুটিতে বেড়াতে যাওয়ার হুজুগও রয়েছে। সিঙ্গাপুর, ব্যাঙ্কক অনেকেরই ঘোরা।” তার ওপর, হংকং গেলে চিন যেতে বেশি খরচ হয় না।
মাইকেল পন হংকং-এর ট্যুর গাইড। সিম-সা-সুই-এর রাস্তায় তাঁর সঙ্গে আলাপ শান্তনুর। মাইকেল বলছিলেন, “এখানে জায়গার খুব অভাব। দু’কামরার ফ্ল্যাট ভাড়া আপনাদের টাকায় প্রায় ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা।” এ রকমই এক গগনচুম্বী ১৩৪ তলা প্রাসাদের ১০০ তলায় ওয়াচ-টাওয়ার করা হয়েছে। হংকং-এ বেড়াতে আসা মানুষকে লিফটে মাত্র ৬০ সেকেন্ডে ১০০ তলায় তুলে শহরের ছবি দেখানো হয়। ১০০ তলায় কাচের বারান্দা থেকে দেখা যায়, সমুদ্রের গা থেকেই উঠে এসেছে রানওয়ে। হংকং-এ নামার সময়ে বিমানের জানালার পাশে বসে সুমৌলির মনে হয়েছিল, এই বুঝি বিমান হুড়মুড়িয়ে নেমে পড়ল সমুদ্রেই।
হিসেব বলছে, গত বছরে প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ ভারতীয় হংকং গিয়েছেন। কলকাতা থেকে যাঁরা যাচ্ছেন, তাঁদের অনেকেই ছোট ব্যবসায়ী। হংকং-এর অনতিদূরে ম্যাকাও দ্বীপে মনোরঞ্জনের ছড়াছড়ি। হংকং থেকে যাতায়াত নিয়ে প্রায় আট হাজার টাকা লাগবে। সেখানে ক্যাসিনো বিশ্ব-খ্যাত। অনেকেই হংকং-এ থাকার সময়ে রাতের ফেরি ধরে ম্যাকাও পৌঁছোন। সেখানে সারা রাত ক্যাসিনো এবং লাস্যময়ীদের মাঝে সময় কাটিয়ে ভোরের ফেরিতে ফিরে আসেন হংকং।
অনেকে আবার দিন দুই ম্যাকাও-তে থেকেও যান। হোটেলের ছড়াছড়ি সেখানে। হংকং-ম্যাকাও-এ ভাল, উচ্চ শ্রেণির হোটেলের ঘর ভাড়া দিনে ১২ থেকে ১৪ হাজার টাকা। তবে, কম খরচের হোটেলও রয়েছে।
পিচরাস্তার উপরেই সস্তার হরেক-রকম জিনিসের সম্ভার রয়েছে লেডিজ-মার্কেট-এ। মাইকেলের কথায়, “মহিলারা বেশি কেনাকাটা করতে ভালবাসেন বলেই ওই নামকরণ।” এ রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলাচল নিষিদ্ধ।
এখানে মার্কেটের গায়ে ছোট ছোট হোটেলে থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। একটি কামরার ভাড়া তিন হাজার টাকা। ছোট্ট একটি ঘর। দুই শয্যার। লাগোয়া একটি ছোট শৌচাগার।
হংকং পর্যটন দফতরও জানাচ্ছে, মধ্যবিত্তদের কথা ভেবেই শহর জুড়ে প্রায় ৭৮টি সস্তার হোটেল ও ৬৪৬টি গেস্ট-হাউস রয়েছে। হোটেলের বারে বসে মাইকেল গল্প শোনাচ্ছিলেন শান্তনুদের। পর্যটকদের ৭০ শতাংশই চিনের মূল ভূখণ্ড থেকে আসে। এক সময়ে হংকংও মূল ভূখণ্ডে ছিল। সমুদ্র-বন্দর মারফত ব্যবসার সুবিধার জন্য পরে ব্রিটিশরা এর দখল নিয়ে নেয়। হালে, ১৯৯৭ সালে ১৫৬ বছরের ব্রিটিশ শাসনের অবসান হলেও তা সরাসরি চিনের হাতে যায়নি।
চিনের সঙ্গে ব্রিটেনের চুক্তি অনুযায়ী হংকং এখন শাসন করে ‘স্পেশাল অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ রিজিয়ন’ বা বিশেষ প্রশাসনিক অঞ্চল। হংকং-এর প্রতিটি গলির বাঁকে, রাস্তার মোড়ে, অট্টালিকায়, সেতুতে, সাগরের তীরে তাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ইংরেজ স্থাপত্যের নিদর্শন।
সম্প্রতি চিনে নাকি শিল্পায়নের জেরে চাষিরা দেদার জমি বিক্রি করে দিচ্ছেন। হাতে কাঁচা টাকাও আসছে। মাইকেল বলছিলেন, “তাঁদের হংকং আসার প্রবণতাও বাড়ছে। চিনের নিয়ম-কানুন একটু বেশিই কড়া। কিন্তু, একবার হংকং বা ম্যাকাও পৌঁছতে পারলে তিন-চার দিনের জন্য ফুতির্র্ করে নেওয়া যায়।”
প্রধানত এই সব যাত্রীর কল্যাণেই ড্রাগন এয়ারের এত বাড়বাড়ন্ত। প্যাট্রিকের হিসেব অনুযায়ী, ২০০৬ সালে যে সংস্থা ৮৮ লক্ষ মার্কিন ডলারের ব্যবসা করেছিল, ২০১২ সালে সেই অঙ্কটা লাফিয়ে পৌঁছে গিয়েছে ১০০ কোটি ডলারে। মাত্র ছ’বছরে!
সমুদ্র হাতছানি দেয় সুমৌলি-কে। বালিতটে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সমুদ্রের দিকে সে চেয়ে থাকতে ভালবাসে। হংকং শহরের উপান্তে সমুদ্র-সৈকতে বসে ডিঙি নৌকা, স্পিড বোটের আনাগোনা দেখতে দেখতে সুমৌলি হাত চেপে ধরে শান্তনু-র। ছেলেমানুষের মতো বলে ওঠে, “এই মূহূর্তটা ‘গো গো গো স্ট্যাচু’ বলে থামিয়ে দেওয়া যায় না? চিরকালের মতো...” |
চেকলিস্ট |
• হংকং যাওয়ার সবচেয়ে ভাল সময় অক্টোবর থেকে জুন মাস
• পাঁচ রাত থাকলে ভাল করে ঘোরা সম্ভব। তার মধ্যে চাইলে তিন
রাত হংকং ও দু’রাত ম্যাকাও থাকা যেতে পারে
• পাঁচ রাতের জন্য দু’জনের যাতায়াতের বিমান ভাড়া,
থ্রি-স্টার হোটেলে থাকার (ব্রেকফাস্ট সহ) খরচ প্রায়
১ লক্ষ ১৫ হাজার টাকা |
|
যোগাযোগ: ৩০২২০০৩৭-৩৯, ২২৪৯৪৭৬৩, ৯৮৩০২৬৫২৯৬ |
|
|
|
|
|