|
|
|
|
|
|
|
মুখোমুখি... |
|
ক্রিকেট আছে টাইগার নেই
পদ্মভূষণের খবর শুনে নির্ঘাত ‘জোক’ বলতেন পটৌডি। কলকাতায় এলে
বেশি করে মনে পড়ে তাঁকে। বললেন শর্মিলা ঠাকুর। মুখোমুখি ইন্দ্রনীল রায় |
পত্রিকা: ‘পদ্মভূষণ শর্মিলা ঠাকুর’ কিন্তু শুনতে বেশ ভাল লাগছে...
শর্মিলা: (হেসে) ধন্যবাদ। আমি খুবই খুশি। ভাল লাগছে সম্মানটা পেয়ে। আমার কাছে এটা এত দিনের কাজের একটা স্বীকৃতি। তবে একটা কথা আপনাকে খোলাখুলি বলি, আমি কিন্তু পদ্মভূষণ পাওয়ার জন্য কোনও লবি করিনি।
পত্রিকা: তার মানে লোকে লবি করে বলুন?
শর্মিলা: তাই তো শোনা যায়। সেটাই পারসেপশন। কিন্তু আমি করিনি একেবারেই।
পত্রিকা: পদ্মভূষণের পরই ‘জয়পুর লিটারারি ফেস্ট’-এ লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট...
শর্মিলা: দেখুন, এত বছর পরে আমি অন্তত এগুলো নিয়ে বেশি ভাবি না। লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট-এর থেকেও জয়পুরে যেটা ভাল লাগল সেটা হচ্ছে, দশ মিনিটের একটা ছোট ছবি দেখলাম ‘জন গণ মন’ বলে। ছোট, কিন্তু খুব ভাল ছবি। পারলে দেখবেন।
পত্রিকা: নিশ্চয়ই।
শর্মিলা: তবে লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট পেয়েও আমি খুব খুশি। ওখানে সবার মধ্যেই একটা আন্তরিকতা লক্ষ করলাম, যেটা আমার বেশ ভাল লেগেছে। এমনিতে অন্য অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানে শুনি,“আপনি যদি আসেন, তা হলেই আপনাকে পুরস্কার দেব।” ওখানে তেমন কিছু হয়নি।
পত্রিকা: হ্যাঁ। অ্যাওয়ার্ড শোগুলো-তে অ্যাওয়ার্ড শো কম, টেলিভিশন শো বেশি হয়ে যাচ্ছে।
শর্মিলা: একেবারেই। সবাইকে খুশি করে চলছে এই অ্যাওয়ার্ড শোগুলো। আমার কাছে সত্যিকারের পুরস্কারের আজও মূল্য আছে। তবে এই সব নিয়ে আমি খুব একটা ভাবি না। আমার অনেক কাজ। বিশেষত ইউনিসেফ-এর।
পত্রিকা: আপনি কলকাতায় এলেন ‘কলকাতা লিটারারি ফেস্টিভাল’-এ। যেখানে সলমন রুশদিকে নিয়ে বিতর্ক এখনও চলছে।
শর্মিলা: কিন্তু সত্যিটা কেউ জানে না। নো বডি নোজ দ্য ট্রুথ। তাই এই নিয়ে কোনও কথা বলতে চাই না।
পত্রিকা: একটু টাইগার-এর ব্যাপারে আসছি...
শর্মিলা: বলুন।
পত্রিকা: দেড় বছর হয়ে গেল টাইগার নেই...
শর্মিলা: হ্যাঁ। দেখতে দেখতে দেড় বছর কেটে গেল প্রায়। তেতাল্লিশ বছর একসঙ্গে কাটিয়েছি দু’জনে। না না, তেতাল্লিশ বছর নয় জানেন...
পত্রিকা: তা হলে?
শর্মিলা: আরও চার বছর যোগ করুন। সাতচল্লিশ বছরের পরিচয় ছিল ওর সঙ্গে। খুব মিস করি টাইগারকে। কলকাতায় এলে তো আরও বেশি করে মিস করি। এখানেই তো প্রথম আলাপ হয়েছিল ওর সঙ্গে।
বাকি জীবনটা ওকে মিস করতে করতে কেটে যাবে আমার। আর কত দিনই বা বাঁচব...
পত্রিকা: এ রকম করে কেন বলছেন?
শর্মিলা: যা সত্যি তাই বলছি। আই অ্যাম সেইং দ্য ট্রুথ।
পত্রিকা: টাইগার চলে যাওয়ার পরে ক্রিকেট ম্যাচ দেখতে খারাপ লাগে না?
শর্মিলা: এটাই সবচেয়ে আশ্চর্যের জানেন...
পত্রিকা: কোনটা?
শর্মিলা: এই যে, আমি ক্রিকেট দেখার সময় একেবারেই মিস করি না টাইগারকে। এটাই একমাত্র সময় যখন আমার মনে হয় যে, ও আমার পাশেই রয়েছে।
পত্রিকা: তাই?
শর্মিলা: হ্যাঁ। ক্রিকেট দেখতে দেখতে ভাবি এই বলটা দেখে বা এই শটটা দেখে টাইগার কী বলত? ওর মৃত্যুর পর ক্রিকেট আমাকে ওর কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। যখন ক্রিকেট দেখি ও আমার সঙ্গেই থাকে।
পত্রিকা: আপনি পদ্মভূষণ পেয়েছেন শুনলে টাইগার আপনাকে কী বলতেন?
শর্মিলা: যাঁরা টাইগারকে চিনতেন তাঁরা আমার কথার সঙ্গে একমত হবেন। এই খবরটা পাওয়ার পর ও একটা জোক বলতই বলত। ও খুব বাস্তববাদী এক জন মানুষ ছিল। তবে আমি জানি ও মনে মনে খুব খুশিও হত। হি হ্যাজ অলওয়েজ বিন সাপোর্টিভ। সব সময় পাশে থেকেছে আমার।
পত্রিকা: একটা প্রশ্ন অনেক দিন ধরেই আপনাকে করার ইচ্ছা...
শর্মিলা: বলুন।
পত্রিকা: টাইগারের মৃত্যুটা আপনারা খুবই কমনীয় ভাবে সামলেছেন। কোনও কান্নাকাটি নেই। চুপচাপ। শোকের সময় ব্রিটিশরা যে রকম ভাবে প্রতিক্রিয়া দেখান, অনেকটা সে রকম। এটাই কি ‘ব্লু ব্লাড’-এর নিয়ম?
শর্মিলা: আমি সত্যিই সেটা জানি না। তবে টাইগারের মৃত্যু আমাদের পারিবারিক একটা ক্ষতি, সেটা সবার সঙ্গে ভাগ করে নেওয়াও যায় না। তা বোধহয় ঠিকও নয়। তবে সেই সময় আমাদের কিছু বন্ধুবান্ধব ছিলেন, যাঁরা আমাদের, বিশেষ করে আমার পাশে ছিলেন। তবে প্রথম প্রথম টাইগারকে খুব মিস করতাম।
পত্রিকা: বুঝতেই পারছি।
শর্মিলা: আর কী বলুন তো, প্রথমে মিস করাটাই প্রাধান্য পায়। তার পর যত দিন যায় তত ফাঁকা লাগতে থাকে। তখন আস্তে আস্তে একাকীত্ব গ্রাস করে। ফাঁকা লাগে। কিন্তু জীবন তো আটকে থাকে না। চলতেই থাকে।
পত্রিকা: ‘পটৌডি’তে থাকলে একা লাগে না?
শর্মিলা: না। আমার ভালই লাগে। ওখানে জীবনটা খুব শান্তিপূর্ণ।
পত্রিকা: টাইগারকে নিয়ে বইও বেরোল...
শর্মিলা: হ্যাঁ। বইটাতে অনেকের লেখা রয়েছে। সানি লিখেছে। রাহুল লিখেছে। বেদি লিখেছে। তবে টাইগারের আত্মজীবনীর কাজটা এখনও বাকি।
পত্রিকা: টাইগার যে দলের অধিনায়ক ছিলেন, সেই দলের কেউ আপনার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন?
শর্মিলা: বিষেণ (বেদি) রাখে। ও টাইগারকে অসম্ভব শ্রদ্ধা করত। আজও করে। টাইগার চলে যাওয়ার পর ও আমাদের পরিবারের খুব কাছের মানুষ হয়ে গেছে। আজও টাইগারকে প্রায় পুজো করে।
পত্রিকা: বাড়িতে টাইগারের ব্যাট, ব্লেজার, গ্লাভস...
এ সব স্মৃতিচিহ্ন দেখে খারাপ লাগে না?
শর্মিলা: টাইগারের কিন্তু সে রকম স্মৃতিচিহ্ন বিশেষ কিছু ছিল না। সবই প্রায় দিয়ে দিয়েছিল টাইগার। তবুও ওর প্রথম টেস্টের ভারতের জাতীয় দলের ব্লেজার আর শেষ টেস্টের ব্লেজার, দু’টোই আমি রাহুল বসুকে দিয়েছিলাম, ওর ফাউন্ডেশনের জন্য।
পত্রিকা: এত বড় একটা লস-এর পরেও তো দাঁড়িয়ে থেকে একা হাতে ছেলের অত হাই প্রোফাইল বিয়ে দিলেন...
শর্মিলা: খুব একটা একা ছিলাম না। অনেকেই খুব সাহায্য করেছিলেন এই সময়। তবে অতিথি তালিকা আমি নিজেই বানিয়েছিলাম। বানাতে গিয়ে, কিছু মানুষকে ভুলেও গিয়েছিলাম। সেটা অবশ্যই একটা গুরুতর ভুল ছিল।
পত্রিকা: টাইগার থাকলে সইফ আর করিনার বিয়েতে কী করতেন?
শর্মিলা: টাইগার থাকলে? (খুব হেসে) ও থাকলে বিয়েতে অল্প কিছুক্ষণ থেকে ডাব্বুকে (করিনার বাবা রণধীর কপূর) নিয়ে অন্য কোথাও বসে ড্রিংক করত। ওকে কোথাও খুঁজেই পাওয়া যেত না।
পত্রিকা: তাই?
শর্মিলা: হ্যাঁ। ঠিক চলে যেত। পাঁচ জনের বেশি লোক থাকলেই ও সেখান থেকে পালাতে পারলে বাঁচত।
পত্রিকা: ছেলের বৌ হিসাবে করিনাকে কেমন লাগছে?
শর্মিলা: খুবই ভাল। ও খুব ভদ্র। যখনই কোনও দরকার হয়, ওকে আমি ফোন করতে পারি। খুব ভাল মেয়ে করিনা।
পত্রিকা: টাইগারের মৃত্যুর পর কখনও আপনি আর করিনা পটৌডি এস্টেটে প্রাতর্ভ্রমণে বেরিয়েছেন?
শর্মিলা: পটৌডি এস্টেটে আসতে করিনা খুব ভালবাসে। যখনই এসেছে আমরা ঘুরেছি একসঙ্গে। তবে করিনাও খুব ব্যস্ত। আমিও খুব ব্যস্ত। একসঙ্গে থাকা আর কোথায় হয় আমাদের। তবে যখনই আমার কোনও দরকার হয়, আমি জানি করিনা আমার পাশে আছে।
পত্রিকা: আর সইফ?
শর্মিলা:সইফ তো টাইগার চলে যাওয়ার পর এখন হেড অব দ্য ফ্যামিলি।
পত্রিকা: সইফ তা হলে এখন অনেক দায়িত্ববান?
শর্মিলা: অনেক। একটা সময় থাকে যখন সব ছেলেই বাবাদের বিরুদ্ধে চলে যায়। খুব বড় কোনও কারণ নয়। কিন্তু ওই। বাবার সঙ্গে তর্ক বাঁধত মাঝে মধ্যে, যেমন বেশির ভাগ ছেলে করে। তার পর একদিন নিজে বাবা হল।
তখন টাইগারের খুব কাছে চলে এসেছিল ও।
পত্রিকা: আপনার সঙ্গে কখনও তর্ক হত না সইফের?
শর্মিলা: ওই বাবা না থাকলে কখনও কখনও হত। কিন্তু বাবাকে ভালবাসত খুব। শ্রদ্ধা করত টাইগারকে। এক কালে সইফ নিজে নিয়ম ভাঙত। আর আজ হি ইজ দ্য রুল।
পত্রিকা: বাঙালিরা খুব দুঃখের সময় রবীন্দ্রনাথের শরণাপন্ন হন। আপনি কি তার ব্যতিক্রম?
শর্মিলা: না না। একদমই নই।
পত্রিকা: টাইগারের মৃত্যুর পর রবীন্দ্রনাথ পড়তেন?
শর্মিলা: আমি কিন্তু কেবল দুঃখ পেলেই রবীন্দ্রনাথ পড়ি না। আনন্দেও রবীন্দ্রনাথ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় পড়ি। বৃষ্টি হলে তো আজও আমি খুব রাবীন্দ্রিক। |
|
|
|
|
|