উৎসবের পরে উৎসব। যাত্রার পরে মাটি। উদ্বোধনের পরে উদ্বোধন।
অথচ বোরো চাষি সেচের।
জল পাচ্ছেন না। ঠিক সেখানেই, যেখানে আজ, শনিবার প্রবল আড়ম্বরে উদ্বোধন হচ্ছে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাধের মাটি উৎসবের।
পানাগড়ের বিরুডিহায় সেই উৎসব চত্বরে মডেল বানিয়ে সরকারের ‘জল ধরো জল ভরো’ প্রকল্পের প্রদর্শনী হচ্ছে। অথচ উৎসবের যে বিপুল খরচ, সেই টাকায় অনায়াসে চাষের খেতে সাবমার্সিবল পাম্প বসানো যেত। করা যেত সত্যিকারের বড় জলাধার, যাতে অসময়ে চাষিদের জল দেওয়া যায়।
ছোট্ট ধানখেত গড়া হয়েছে। মাটি তুলে বাঁধা হয়েছে আল। সেই খেলনা জমিতে ধানের চারা পোঁতা হবে। ঢেঁকিতে পাড় দিয়ে ধান ভেনে দেখাবে কৃষি ও খাদ্য দফতরের লোকজন। মৎস্য দফতরের থিম ‘মাছে ভাতে বাঙালি’। মেলা চত্বরেই খুঁড়ে তোলা পুকুরে মাছচাষ দেখানো হবে। শেখানো হবে জাল বোনা। সব মিলিয়ে যেন বড়সড় ঝুলন!
শুক্রবার বিকেলেই বারাসতের কাছারি ময়দানে যাত্রা উৎসবের উদ্বোধন করেছেন মমতা। যাত্রাশিল্পী শান্তিগোপাল ও তপনকুমারের নামে সদ্য চালু করা লক্ষ টাকার পুরস্কার তুলে দিয়েছেন বেলা সরকার ও মাখনলাল নট্টের হাতে। প্রয়াত শান্তিগোপালের পরিবারের জন্য মাসে ১০ হাজার টাকা এবং ফণীভূষণ ভট্টাচার্যের পরিবারের জন্য মাসে ৫ হাজার টাকা পেনশন ঘোষণা করেছেন। কিছু যাত্রাশিল্পীর এককালীন ভাতা ৬ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭ হাজার করেছেন। এবং জানিয়ে এসেছেন, “কাল থেকেই শুরু হচ্ছে মাটি উৎসব। মাটি কত রকমের হতে পারে, মাটি দিয়ে কী কী হতে পারে, তা আপনারা যাত্রা উৎসবের ফাঁকে পারলে ওখানে গিয়ে দেখবেন।”
সরকারি উৎসবে কী কী হতে পারে, তা দেখিয়ে দেওয়ার জন্য গত কয়েক দিন ধরেই প্রবল ছুটোছুটি করেছেন মন্ত্রী-আমলারা। হুড়মুড় করে খাড়া করে ফেলা হয়েছে বাঁশ-দরমার সার-সার বাড়ি। দেওয়ালে মাটির প্রলেপ, উপরে ঝকঝকে লাল টালি। গুচ্ছ-গুচ্ছ ফ্লেক্স-ব্যানার-হোর্ডিংয়ে ছড়ায়-ছবিতে রকমারি বিজ্ঞাপন। বহু দূর থেকে যে ভাবে বিদ্যুতের লাইন টেনে আনা হয়েছে, মাঠের মাঝে মোরাম ফেলে রাস্তা বানানো হচ্ছে, তা-ও দেখার মতো। কালনায় গিয়ে সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য তথা বিধানসভার বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র টিপ্পনী কাটেন, “মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, উৎসব করব না তো কি শ্রাদ্ধ করব? আমরা বলছি, শ্রাদ্ধই তো করছেন! সাধারণ মানুষের টাকার শ্রাদ্ধ।”
এ দিন সকাল থেকে টিপটিপ বৃষ্টিতে যখন মেলা প্রাঙ্গণে শেষ মুহূর্তের কাজ সারতে কর্মীদের নাভিশ্বাস উঠেছে, দেড়-দুই কিলোমিটার তফাতেই আমলাজোড়া এলাকায় কয়েকশো বিঘা জমিতে চাষ হচ্ছে না সেচের অভাবে। সেখানে সোকনা গ্রামের পাশেই দামোদরের সেচ ক্যানাল। সেখান থেকে সপ্তাহে মোটে এক দিন জল মেলে। নিচু জমিতে কোনও রকমে জল গেলেও উঁচু জমি জল পায় না। সুরাহার জন্য কয়েক বছর আগে গুচ্ছ সেচ প্রকল্পে ৬টি সাবমার্সিবল পাম্প বসানো হয়েছিল। সরকার পরিবর্তনের পরে যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সেগুলিও অচল। এলাকার অমিয় লাহা, হিরেন বাউরিরা জানান, যাঁদের সঙ্গতি আছে তাঁরা নিজেদের জমিতে শ্যালো পাম্প বসিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু অধিকাংশেরই সে সামর্থ্য নেই। আমলাজোড়ার চাষি চঞ্চল লাহার কথায়, “বোরো চাষ বন্ধ। মাটি উৎসব নিয়ে কী করে আগ্রহ থাকবে?”
শুধু পানাগড় বা বর্ধমান নয়, রাজ্যের অ-সেচসেবিত প্রায় সব এলাকাতেই কার্যত একই অবস্থা। কিন্তু ওঁদের কথা ভাবার সময় কার আছে এখন? বরং এলাকার যাঁরা উৎসব প্রাঙ্গণে কাজ পেয়েছেন, তাঁরা কিছুটা স্বস্তি পেয়েছেন। এমনিতে চাষ কম হওয়ায় অনেকের হাতে কাজ ছিল না। আমলাজোড়ার বুধন মুর্মু বা কাঁকসার সোনামনি মুর্মুরা বলেন, “আমরা নিজের হাতে বেড়ার ঘর বানাই। মাটি-গোবর দিয়ে মেঝে বানাই। এখানেও সেই একই কাজ।” ভালো আলপনা দিতে পারেন বিদবিহারের সুধাকর বাস্কে। তিনি স্টলের মাটির দেওয়ালে আলপনা দিচ্ছেন।
পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দফতর বানিয়েছে ঘাট বাঁধানো পুকুর। এ দিনও সাবমার্সিবল পাম্প চালিয়ে তাতে জল ভরা হয়েছে। সূর্যবাবুর কটাক্ষ, “মাটি উৎসবে শুনছি না কি কয়েক কোটি টাকা খরচ হচ্ছে। কত খরচ হচ্ছে, এক দিন ঠিক জানতে পারব। সেখানে পুকুর কেটে পাম্প দিয়ে জল ভরা হয়েছে। সেখানে না কি তিনি জল ধরো জল ভরো প্রকল্পে মাছ ছাড়বেন। আর পুকুর পেলেন না, শেষে কাটতে হল?” |