নিজস্ব সংবাদদাতা • দুবরাজপুর ও কলকাতা |
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, গ্রামবাসীদের দোষ নেই। পুলিশ যা করেছে, তা অন্যায়। মুখ্যমন্ত্রী নিজে আহত গ্রামবাসীদের দেওয়ার জন্য পুলিশ সুপারের হাতে ক্ষতিপূরণের চেক তুলে দিয়েছিলেন।
সেই মুখ্যমন্ত্রীর পুলিশের দায়ের করা মামলাতেই লোবার কৃষিজমি রক্ষা কমিটির আট জন নেতা-সদস্যের জামিনের আবেদন কলকাতা হাইকোর্টে খারিজ হয়ে গেল। বৃহস্পতিবার ইন্দিরা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তরুণ দাসের ডিভিশন বেঞ্চে জামিনের আবেদনের বিরোধিতা করলেন সরকারি আইনজীবী। কমিটির সম্পাদক জয়দীপ মজুমদার, সভাপতি ফেলারাম মণ্ডল, আহ্বায়ক আশিস মিশ্র-সহ আট জনের জামিনের আবেদন খারিজ করল বেঞ্চ। “সরকার বৈঠকে ডাকছে, আবার আমাদের জামিনের বিরোধিতা করছে! এ কেমন দ্বিচারিতা?”প্রশ্ন কমিটি নেতৃত্বের।
বস্তুত, লোবা-কাণ্ড নিয়ে প্রথম থেকেই সরকার অস্বস্তিতে রয়েছে। তড়িঘড়ি বীরভূমের পুলিশ সুপার, দুবরাজপুর থানার ওসি এবং ডিআইজি-কে (বর্ধমান রেঞ্জ) সরিয়ে দিয়ে মুখরক্ষা করার চেষ্টা হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী নিজে এবং তৃণমূলের শীর্ষ নেতা মুকুল রায় লোবায় সভা করেন। বিধানসভায় শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে বৈঠকও করেছেন। তাতেও দু’তরফে সম্পর্কের শীতলতা কাটেনি।
এমন পরিস্থিতিতে কমিটি এ বার পঞ্চায়েত ভোটে লড়ার কথা ভাবছে। এলাকায় কমিটির নেতারা মিটিং-মিছিল করছেন। মঙ্গলবার তাঁদের সভায় লোবা অঞ্চলের কিছু তৃণমূল ও সিপিএম কর্মী-সমর্থক যোগ দিয়েছেন বলেও জানা যাচ্ছে। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, এলাকায় রাজনৈতিক প্রভাব হারানোর আশঙ্কাতেই কমিটির নেতাদের ‘চাপে’ রাখতে চায় তৃণমূল? কারণ, ভোটের আগে কমিটির নেতারা ধরা পড়লে ধাক্কা খাবে লোবার জমি-আন্দোলন। যে কোনও দিন তাঁদের গ্রেফতার করা হতে পারে বলে আশঙ্কা কমিটির নেতাদের।
অথচ এত দিন কমিটির নেতারা প্রকাশ্যেই ঘুরে বেড়িয়েছেন। সিউড়িতে ডিএম অফিস ঘেরাও করেছেন। পুলিশ তখন কেন তাঁদের ধরেনি? বীরভূমের পুলিশ সুপার মুরলীধর শর্মা বলেন, “উপযুক্ত তথ্য-প্রমাণ পেলেই অভিযুক্তদের গ্রেফতার করা হবে।”
কৃষিজমি রক্ষা কমিটির হেফাজতে থাকা একটি খনি সংস্থার মাটি কাটার যন্ত্র ছাড়াতে গত ৬ নভেম্বর পুলিশি অভিযান হয়েছিল লোবা গ্রামে। পুলিশ-গ্রামবাসী সংঘর্ষে আহত হন অনেকে। পাঁচ গ্রামবাসী পুলিশের গুলিতে জখম হন বলে অভিযোগ। ওই দিনই আট জনের বিরুদ্ধে সরকারি সম্পত্তি নষ্ট, সরকারি কর্মীর উপরে সশস্ত্র আক্রমণ ও খুনের চেষ্টা, সরকারি কাজে বাধাদান-সহ একাধিক ধারায় মামলা রুজু করে দুবরাজপুর থানার পুলিশ। এই আট জনের মধ্যে রয়েছেন কমিটির সক্রিয় সদস্য, ঘটনার দিন আহত গৌতম ঘোষও। যাঁকে ইতিমধ্যে ক্ষতিপূরণও দিয়েছে রাজ্য সরকার।
কমিটির আইনজীবী জিতেন পাল ও কিশোর মুখোপাধ্যায় এ দিন বলেন, “সরকার পক্ষের আইনজীবী জামিনের বিরোধিতা করায় আমরা স্তম্ভিত! শিল্পমন্ত্রী ওই ঘটনার পরে যাঁদের
সঙ্গে দু-দু’বার বৈঠক করলেন, তাঁদেরই বিরুদ্ধে এমন গুরুতর অভিযোগে জামিন-অযোগ্য ধারায় মামলা হল কেন? মুখ্যমন্ত্রীই বা কেন অন্যতম অভিযুক্তকে ক্ষতিপূরণ দিতে নিজে লোবায় গেলেন?” হাইকোর্টের রায়ের প্রতিলিপি হাতে পেলে আইনজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করে পরবর্তী পদক্ষেপ ঠিক করবেন বলে ওই আইনজীবীরা জানিয়েছেন।
কমিটির নেতাদের দাবি, তাঁদের মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হয়েছে। জয়দীপবাবুর প্রশ্ন, “ঘটনার পর মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন গ্রামবাসীদের কোনও দোষ নেই। তা হলে মামলা কীসের?” ফেলারামবাবুর বক্তব্য, “গুলি চালাল পুলিশ। আহত হলেন গ্রামবাসীরা। উল্টে আমাদের বিরুদ্ধেই মামলা হল। আমরা বিচারবিভাগীয় তদন্ত দাবি করেছিলাম। সেখানেই স্পষ্ট হত, সেদিন ঠিক কী ঘটেছিল। আমাদের দোষ পেলে তখন না হয় মামলা করতে পারত পুলিশ।”
লোবায় কমিটির আন্দোলনের সহযোগী পিডিএসের রাজ্য সম্পাদক সমীর পূততুণ্ডের মতে, লোবা নিয়ে গোড়া থেকেই সরকার একের পর এক অন্যায় করেছে। তাঁর কথায়, “যে সংস্থা অন্যায় ভাবে লোবায় খননকাজ শুরু করতে চেয়েছিল, তাদের পক্ষে সওয়াল করছে সরকার। বিরোধিতা করছে স্থানীয় মানুষের। জমি অধিগ্রহণে মধ্যস্থতা করতেও সরকার রাজি হয়নি।” তবে, কমিটির নেতৃত্বকে চাপে রাখার পিছনে অন্য কারণও আছে বলে মনে করেন তিনি।
সমীরবাবুর অভিযোগ, “মুখ্যমন্ত্রীর হাত থেকে ক্ষতিপূরণের চেক নেননি কোনও আহতই। এটা তাঁর দম্ভে লেগেছে। রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ার বাইরে থেকে একটা কমিটির নেতৃত্বে গণ-আন্দোলন গড়ে উঠছে এবং তারা পঞ্চায়েতে লড়তে চাইছে, সেটা বুঝেই তৃণমূল কমিটির উপরে এ ভাবে চাপ সৃষ্টি করছে। কিন্তু এতে আখেরে তৃণমূলের উপকার হবে না। বরং তারা মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে।”
বীরভূম জেলা তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের পাল্টা বক্তব্য, “ঘটনার দিন লোবায় পুলিশের উপর হামলা চালিয়েছিল কমিটির সঙ্গে থাকা প্রচুর বহিরাগত। তাদের সঙ্গে আগ্নেয়াস্ত্র ছিল। আমরা সেদিনই পুলিশকে বলেছিলাম, দোষীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে। এ বার আইন আইনের পথে চলবে।” |