শিল্পের দাবি উঠছে তৃণমূলের তৃণমূলেই
প্রস্তাবিত তিন ইস্পাত কারখানার মধ্যে একটি ইতিমধ্যেই বানচাল হয়ে গিয়েছে। বাকি দু’টিও কবে চালু হবে কেউ জানে না। এই পরিস্থিতিতে পুরুলিয়ার রঘুনাথপুরে তৃণমূলেরও তৃণমূল স্তর থেকে দাবি উঠছে, শিল্প চাই। কারখানা না গড়লে জমি ফেরতের স্লোগান দিয়ে মাঠে নামতে চাইছে শাসকদলের একটা বড় অংশ। পুরুলিয়ার অর্থনৈতিক ভরকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত রঘুনাথপুরে তৃণমূল নেতা-কর্মীদের এই অবস্থানের পিছনে রাজ্য নেতৃত্বেরও স্পষ্ট সায় রয়েছে। মঙ্গলবার দলের মহাসচিব তথা রাজ্যের শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “এলাকার নেতারা তো ঠিকই বলছেন। জয় বালাজি এত দিনে কী করেছে? ওরা হয় শিল্প করুক, নয় জমি ছাড়ুক। আমি বুদ্ধবাবু (প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য) নই।” জয় বালাজি অবশ্য দাবি করছে, ইতিমধ্যেই জমির দাম ও তার পরবর্তী কাজে তারা মোটা টাকা খরচ করে ফেলেছে। লিজ-চুক্তি না হলে ব্যাঙ্কঋণ পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে কাজও এগোচ্ছে না। এই টানাপোড়েনে শিল্প আটকে যাওয়ায় পড়ে পাওয়া সুযোগ পেয়ে গিয়েছে বিরোধীরা। তাদের কটাক্ষ, পঞ্চায়েত নির্বাচন বড় বালাই। অধিগৃহীত জমিতে শিল্প না হওয়ায় যে এলাকায় ক্ষোভের বারুদ জমেছে, তা বুঝেই তৃণমূলের তরফে মাঠে নামার ‘কৌশল’ নেওয়া হচ্ছে। গত বছর ৩ ডিসেম্বর পুরুলিয়ায় প্রকাশ্য সমাবেশে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “রঘুনাথপুরে ইন্ডাস্ট্রিয়াল টাউনশিপ হবে। জয় বালাজি শিল্প করছে, শ্যাম স্টিল এসেছিল। আরও অনেক কোম্পানি আসছে, তাদেরও ছাড়পত্র দেওয়া হবে। কিছু প্রকল্পে কাজ শুরু হয়েছে, আরও হবে।” পশ্চিমবঙ্গ শিল্পোন্নয়ন নিগমের ওয়েবসাইটেও লেখা রয়েছে, ‘রঘুনাথপুর ইজ হোম টু জয় বালাজি ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, শ্যাম স্টিল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড’।
স্থানীয় তৃণমূল নেতা-কর্মীদেরই একাংশের মতে, মানুষ এখন বুঝতে পারছেন, মুখ্যমন্ত্রীর দাবির সঙ্গে বাস্তবের ফারাক কতটা। ইন্ডাস্ট্রিয়াল টাউনশিপ তো দিবাস্বপ্ন! রঘুনাথপুরে হয়েছে শুধু একটি শিল্প পার্ক। সেখানে যে তিন ইস্পাত সংস্থাকে জমি দেওয়া হয়েছিল তাদের অন্যতম শ্যাম স্টিল ইতিমধ্যেই ৬০০ একর জমি ফিরিয়ে দিয়েছে। ১০৯৪.৮৯ একর জমি পেয়েও এখনও রাজ্যের সঙ্গে লিজ-চুক্তি করতে পারেনি জয় বালাজি। তারা যে সাড়ে সাত কিলোমিটার সীমানা প্রাচীর তুলেছে, তা থেকেও ইট খুলে নিয়ে যাচ্ছেন জমিদাতারা। প্রকল্পস্থলে চলছে চাষবাসও। তৃতীয় সংস্থা আধুনিক পেয়েছে ৫০৫ একর, কিন্তু একটি ইটও গাঁথা হয়নি। উল্টে রঘুনাথপুর শহর থেকে তারা অফিস গুটিয়ে নিয়েছে।
রঘুনাথপুরে এই মুহূর্তে শুধু দু’টি বিদ্যুৎ প্রকল্প আশা জিইয়ে রেখছে। এক, ১৫৫ একর জমিতে ডিসেরগড় পাওয়ার সাপ্লাই কর্পোরেশনের ২৭০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্র। দুই, বাম জমানায় নির্মাণকাজ শুরু হওয়া ডিভিসি-র তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। যদিও সেই প্রকল্পও লক্ষ্যমাত্রা থেকে দু’-তিন বছর পিছিয়ে চলছে। শিল্পমহলের খবর, ইস্পাত শিল্পে বিশ্বজোড়া মন্দার কারণে চালু কারখানাও উৎপাদন ক্ষমতার ৩০-৩৫ শতাংশের বেশি উঠতে পারছে না। নতুন কারখানা শুরু করার পক্ষে সময়টা অনুকূল নয়। লিজ-চুক্তি এক বার হয়ে গেলে তিন বছরের মধ্যে উৎপাদন শুরু করতেই হবে। ব্যাঙ্কঋণ নেওয়া হলে তার সুদও গুনতে হবে। জমি হাতে পেয়েও অনেকে তাই সময় ‘নষ্ট’ করছেন। জয় বালাজি ও শ্যাম স্টিলের প্রকল্প যেখানে হওয়ার কথা ছিল, রঘুনাথপুর ১ ব্লকের সেই নতুনডি পঞ্চায়েত এলাকার বাসিন্দা তথা আইএনটিটিইউসি তথা তৃণমূল নেতা সোমনাথ মিশ্র বলেন, “শিল্প চেয়ে এ বার রাস্তায় নামব। জমি ও জীবিকা রক্ষা কমিটি গড়ে রঘুনাথপুরের মহকুমাশাসককে স্মারকলিপি দেব। সরকারের ইতিবাচক পদক্ষেপের জন্য সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হবে। শিল্প না হলে জমি ফেরতের দাবিও জানাব।” পঞ্চায়েত ভোটের প্রচারে তাঁদেরই এলাকাবাসীর প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে জানিয়ে তিনি বলেন, “মানুষ এখনই জানতে চাইছে, শিল্প কবে হবে? আমাদের কাছে জবাব নেই।”
শাসকদলের উপরে চাপ বেড়েছে ‘নতুনডি অঞ্চল জমিহারা কমিটি’ জমি ফেরতের দাবিতে জনস্বার্থের মামলা করার হুমকি দেওয়ায়। জমিহারাদের আক্ষেপ, শিল্পের জন্য জমি দিয়ে তাঁরা জীবিকা হারিয়েছেন। শিল্পও হয়নি। কমিটির নেতা শ্রীলোক মাজি বলেন, “নতুন সরকার আসায় ভেবেছিলাম, দ্রুত কারখানা গড়া হবে। তা না হওয়ায় ছ’মাস আগেই জেলাশাসককে স্মারকলিপি দিয়ে জমি ফেরত চাই। সময়সীমাও বেঁধে দিয়েছিলাম। কিন্তু প্রশাসনের হেলদোল নেই। এ বার হাইকোর্টে জনস্বার্থের মামলা করে জমি ফেরতের আবেদন জানাব।” পরিবর্তনের হাওয়ায় রঘুনাথপুর বিধানসভা আসনটি তৃণমূলের দখলে এলেও রঘুনাথপুর ১ পঞ্চায়েত সমিতি এবং নতুনডি গ্রাম পঞ্চায়েত এখনও সিপিএমের দখলে রয়েছে। তৃণমূলের একাংশের আশঙ্কা, শিল্প নিয়ে নির্দিষ্ট বার্তা দিতে না পারলে আসন্ন নির্বাচনে সেগুলির দখল পাওয়া মুশকিল। সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য, রঘুনাথপুরের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রদীপ রায় স্পষ্টই বলছেন, “শিল্প না হওয়ার বিষয়টা তো আমরা পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রচারে আনবই। ওরা আর কোন মুখে ভোট চাইব?” প্রদীপবাবুর দাবি, “আমরা ক্ষমতায় থাকাকালীন শিল্পের অগ্রগতি খতিয়ে দেখতে মহকুমাস্তরে একটি মনিটরিং কমিটি হয়েছিল। বিধানসভা ভোটের আগে তার শেষ বৈঠক হয়। খাতায়-কলমে আজও কমিটি আছে, এটুকুই।” স্থানীয় সিপিএম সাংসদ তথা দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য বাসুদেব আচারিয়ার বক্তব্য, “এই সরকারের শিল্প গড়ার সদিচ্ছা নেই। বাম আমলে যে সম্ভাবনার সূচনা হয়েছিল, সেটা নষ্ট করে দিয়েছে তৃণমূল। সেই ক্ষোভ বিপক্ষে যাবে বুঝেই ওরা এখন লোক দেখাতে রাস্তায় নামার কথা বলছে।”
পার্থবাবু পাল্টা বলেন, “জানি, এখন জয় বালাজিকে জমি ফেরত দিতে বললে বুদ্ধবাবুরা বলবেন, ওঁদের আনা প্রকল্প আমরা তাড়িয়েছি। কিন্তু ২০০৭ সাল থেকে জমি নিয়ে ওরা কী করেছে? রানিগঞ্জে দু’টো কোল ব্লকও তো ওদের পাইয়ে দেওয়া হয়েছিল। কী কাজ হয়েছে, তা আগে ওরা লিখে দিক। দু’দিন আগেই ওদের ডেকে তা জানিয়ে দিয়েছি।” কিন্তু যে কারণেই হোক, শিল্প না হওয়ায় রাজনৈতিক চাপ যে ক্রমশ বাড়ছে, তা তৃণমূলের কোনও নেতাই অস্বীকার করতে পারছেন না। জন্মলগ্ন থেকে দলের সঙ্গে থাকা প্রবীণ স্থানীয় নেতা বিষ্ণুচরণ মেহেতা বলেন, “শিল্প কবে হবে, আদৌ হবে কি না, তার জবাব ভোটের আগে আমাদের পেতেই হবে। না হলে মানুষের কাছে গিয়ে দাঁড়ানোর মুখ থাকবে না।” তাঁর মতো অনেকেই মনে করছেন, শিল্পের জন্য নেওয়া জমি ফেরতের দরকার নেই। বরং জয় বালাজি, শ্যাম স্টিল বা আধুনিক যদি কারখানা না করে, অন্য কেউ করুক। নতুন সরকারকেই সে ব্যাপারে উদ্যোগী হতে হবে।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.