বিনোদন
ভাবের ঘরে সিঁদ দিচ্ছে অভাব
জয় তো আগে ‘ভাবসাগর’ ছিল গো! সেই অজয়ে এখন ঢেউ কোথায়? ভাবও উধাও!
কথাগুলো বলছিলেন তরুণ খ্যাপা। বীরভূমের এই প্রবীণ বাউল দীর্ঘ দিন ধরেই অজয়ের তীরে জয়দেব-কেঁদুলির মেলায় আখড়া গড়েন। বাউলের সহজ সুরে মেতে বহু মানুষ ভিড় জমান সেখানে। কিন্তু তালটা যেন কেটে গিয়েছে বলে মনে হয় তরুণের। ‘সাধক’ বাউলের দেখা মেলা ভার। সমঝদারও কমছে।
শীতের মরসুমে দক্ষিণবঙ্গের নানা জায়গায় বাউল-ফকিরদের ঘিরে মেলা বসে। ক’দিন আগেই মারা গিয়েছেন বহু মানুষের ভালবাসার গৌর খ্যাপা। বাউল গানকে শহুরে শ্রোতার ঘরে তো বটেই, বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রেও তাঁর ভূমিকার কথা মানেন সকলে। প্রচারের আলো মুখে নিয়েও তাঁর নিভৃত জীবনচর্যার কথাও ফেরে মুখে-মুখে।

নিজস্ব চিত্র
কিন্তু ইদানীং বদলে যাচ্ছে ছবিটা। মেলায় বাউলের একতারার পাশে ঠাঁই করে নিয়েছে মোবাইল। আলখাল্লার পকেটে ভিজিটিং কার্ড। এক সময়ে যা ছিল শতছিন্ন তালিমারা আলখাল্লা, তা-ই এখন যত্নে বানানো ‘ফ্যাশন স্টেটমেন্ট’। আখড়ার উপরে ত্রিপল, নীচে বিচালি। বিজলি বাতি জ্বলে। “সবটাই ইদানীং কেমন সাজানো-গোছানো” বলছিলেন উত্তর ২৪ পরগনার বারাসতের বাসিন্দা বব পাল, অভীকেরা। বেশ কয়েক বছর ধরে তাঁরা আসছেন মেলায়।
আর এক দল আবার শহর থেকে শুধু নেশাভাঙ করতেই বাউল মেলায় আসেন। হইহুল্লোড় করে চলে যান। গানে তাদের মন নেই। এই যদি হয় শ্রোতার হাল, পাশাপাশি পথে-পথে ফেরা চালচুলোহীন জীবন আজ অচেনা বহু বাউলের কাছেও। অনেকেই পাড়ি দিচ্ছেন বিদেশে। সামান্য কথাবার্তা এগোনোর পরেই সেই ফিরিস্তি দিতে শুরু করেন নির্দ্বিধায়। বিদেশি শ্রোতা পেলেই কথার ফাঁকে জানিয়ে রাখেন, ‘তৈরি আছে পাসপোর্ট।’ লোকসঙ্গীত শিল্পী দেব চৌধুরীর কথায়, “জয়দেবের মেলায় কিছু আখড়ায় এখনও ভাল গান শোনা যায়। কিন্তু অধিকাংশ শিল্পীই তো বাউলের সিডি কিনে ক’টা বাজার চলতি গান শিখে গায়ে বাউলের পোশাক চাপিয়ে নেমে পড়েছেন।” সাধন মার্গের এই সঙ্গীত শোনা-বোঝার জন্য শ্রোতারও অভাব হচ্ছে বলে মনে করেন তিনি। বললেন, “শিক্ষিত শিল্পী-শ্রোতা এখন ক’জন আসেন? বহু ফাঁকি মেলা জুড়ে।”
শিল্পের বিপণনের হাত ধরে শিল্পীর জীবনযাত্রাও যে পাল্টে যাচ্ছে, সেটা মানেন সায়ন্তনী রায়চৌধুরী। তার প্রয়োজন আছে বলেও মনে করেন তিনি। দেশ-বিদেশের লোকশিল্পীদের নিয়ে বেশ কয়েক বছর ধরে কাজ করছে তাঁদের সংস্থা। সায়ন্তনীর কথায়, “কোনও লোকশিল্পের যদিও বিপণনযোগ্যতা থাকে, তবে খারাপ কী? তাছাড়া তত্ত্বসাধনা যাঁরা করেন, কোনও লোকসংস্কৃতিতেই তাঁরা প্রচারের আলোয় বেশি আসেন না।” অজয়ের চরে আখড়ায় বসে হাসতে-হাসতেই নিজের অভিজ্ঞতা শোনাচ্ছিলেন তারকদাস বাউল“একবার হ্যারিকেন নিয়ে মেলায় গিয়েছিলাম। নিমগাছের ডাল, তালপাতা দিয়ে আখড়া বানালাম। কেউ এল না। পরের বার ভাল করে আলো দিয়ে সাজিয়ে বড় আখড়া করলাম। তখন জায়গা দেওয়া দায়!” গৌতমদাস বাউলের আক্ষেপ, “বাউলদের অনেকে শুধু শিল্পী। গুরুর দীক্ষা নেই। বাজার থেকে কাপড়ের ছিট কিনে জামা বানিয়ে মেলায় চলে আসেন। তাঁদের গানের সঙ্গে জীবনের অসঙ্গতি থাকাই স্বাভাবিক। পুরোটাই ভাবের ঘরে চুরি।”
আগের সেই সাধক বাউলেরা গেলেন কোথায়?
গৌতমের উত্তরে দীর্ঘশ্বাস, “অনেকেই শামুকের মতো নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন। প্রকৃত বাউল ক্রমশ কমছে। এখন শুধু জীবিকার জন্যই বাউল শেখা। নিরানব্বই শতাংশই জানে, গান করলে খেতে পাব।” সঙ্গীতশিল্পী শিলাজিতের মতে, “গান গেয়ে যদি কেউ সম্মানজনক ভাবে বেঁচে থাকার রসদ জোটাতে পারে, তা হলে নিঃসন্দেহে ভাল। কিন্তু দেখছি, গায়ক বাউলদের কণ্ঠে গান অনেক বিকৃত হচ্ছে। কোথাও একটা গুণমান বজায় রাখা দরকার।”
পাল্টেছে আরও অনেক কিছু।
জয়দেবের মেলায় বৈষ্ণবেরা বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ। বিশাল এলাকা জুড়ে তাঁদের অসংখ্য আশ্রম। কিন্তু চটুল হিন্দি-বাংলা গানের সুরে পদাবলীর টুকরো কানে ভেসে আসে ইদানীং। অজয়ে স্নানেও সেই ‘সুখ’ আর নেই, আক্ষেপ বীরভূমের প্রবীণ ভক্তরাম জানার। হিংলোর জলাধার থেকে জল না ছাড়লে সংক্রান্তিতে স্নান দূরে থাক, শরীর ভেজানাই দায়। শান্তিনিকেতনের পৌষমেলায় ইদানীং দোকান আলো করছে টিভি-ফ্রিজ-সোফা সেট। আর কেঁদুলিতে এসে পৌঁছেছে ট্রাক্টর।
‘মানবজমিন’ এখন চষছে ট্রাক্টরই!



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.