বিশ্বের দরবারে আবার ‘সদম্ভে’ হাজির গড়াপেটার ‘ক্যানসার’। এবং ক্রিকেট নয়, কবলে এ বার বিশ্বের জনপ্রিয়তম খেলা, ফুটবল। চ্যাম্পিয়ন্স লিগ সমেত গোটা ইউরোপীয় ফুটবল তো বটেই, লাতিন আমেরিকা-এশিয়া-আফ্রিকার ফুটবলেও গড়াপেটার ‘ক্যানসার’ কী ভাবে থাবা বসিয়েছে, তা সোমবার গোটা বিশ্বকে জানিয়ে দিলেন ইউরোপের পুলিশ সংস্থা ইউরোপোলের কর্তারা।
মাঝে ‘লর্ডসগেট’ দেখেছে ক্রিকেট-দুনিয়া। মহম্মদ আমের, মহম্মদ আসিফরা শাস্তি পেয়েছেন গড়াপেটার দায়ে। কিন্তু তার পরে ধীরে হলেও শান্তি ফিরেছে বিশ্ব-ক্রিকেটের সংসারে। দু’একটা খুচরো অভিযোগ যে ওঠেনি, এমন নয়, কিন্তু তা বিশেষ পাত্তা পায়নি। ফুটবল দুনিয়ার জুভেন্তাসের ম্যাচ গড়াপেটা কেলেঙ্কারিও প্রায় ভুলতে বসেছিলেন সমর্থকরা।
বোঝা যায়নি, ফের গড়াপেটার বুলেটে এ ভাবে ঝাঁঝরা হবে খেলার দুনিয়া। |
দ্য হেগ-এ ইউরোপোল-প্রধান রব ওয়েনরাইট, বোখুম পুলিশের মুখ্য তদন্তকারী ফ্রিডহেলম্
আলথানস ও বোখুম প্রসিকিউশন সার্ভিসের আনদ্রিয়াস বাখমান। সোমবার। ছবি: এএফপি |
সন্দেহ-তালিকায় থাকা ম্যাচের সংখ্যা শুনলে চমকে উঠতে হবে। এশিয়া-ইউরোপ-আফ্রিকা-আমেরিকা মিলিয়ে ছ’শো আশি! যার মধ্যে শুধু ইউরোপেই খেলা হয়েছে তিনশো আশিটি ম্যাচ! এর পাশে ক্রিকেটের কলঙ্ক?
সোমবার ইউরোপোলের রিপোর্ট জমা পড়তেই তীব্র উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বজুড়ে। দেড় বছর ধরে তদন্ত চালিয়ে ফুটবলের এই বৃহত্তম কেলেঙ্কারি প্রকাশ্যে আনার জন্য নিঃশব্দে অপারেশন চালিয়ে গিয়েছেন ইউরোপোলের কর্তারা। যে তদন্তের সাংকেতিক নাম ছিল ‘অপারেশন ভেটো’। তাদের রিপোর্টে পরিষ্কার লেখা, ইউরোপের পনেরোটা দেশে হওয়া তিনশো আশিটা ম্যাচে গড়াপেটা হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে! পুলিশি রিপোর্টে ছাড় পায়নি ইউরোপীয় ক্লাব ফুটবলের বৃহত্তম টুর্নামেন্ট চ্যাম্পিয়ন্স লিগও। সন্দেহের তালিকায় আছে দু’টো ম্যাচ, যার একটা হয়েছে ইংল্যান্ডে। বলা হচ্ছে, গত তিন চার বছরের মধ্যে ওই ম্যাচ দু’টো হয়েছে। আছে প্রাক-বিশ্বকাপ, প্রাক-ইউরো কাপের ম্যাচও।
বিস্ফোরণের জন্য এটুকু বারুদই বোধহয় যথেষ্ট ছিল!
ফুটবলে গড়াপেটা নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরেই সন্দেহ দানা বাঁধছিল পুলিশ-গোয়েন্দাদের একটা বড় অংশের মধ্যে। শুরু হয় খোঁজ। হাতে আসে দু’একটা সূত্র। আর সেই সূত্র ধরেই শুরু হয় তদন্ত। তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ্যে আসার পরে ফিফা প্রেসিডেন্ট সেপ ব্লাটার সাফ জানিয়ে দেন, “ম্যাচ গড়াপেটাকে সমস্ত দেশের সরকারেরই গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত। কড়া শাস্তির ব্যবস্থা দরকার।” ইউরোপীয় ফুটবল সংস্থা উয়েফাও বিবৃতি দিয়ে দেয়, ‘‘ইউরোপোলের রিপোর্টের ব্যাপারে জানা গিয়েছে। গোটা ইউরোপ জুড়ে ম্যাচ গড়াপেটার অভিযোগ উঠেছে। গড়াপেটার সঙ্গে আপস আমরা কখনওই করিনি। তদন্তের পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট পাওয়ার পরই যা করার করা হবে।”
ফুটবল সংস্থার কর্তারা যা-ই বলুন, তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ্যে আসার পরে আর চুপ করে বসে থাকেনি সংবাদমাধ্যম। তারাও নিজেদের মতো করে তদন্ত শুরু করেছে। রেকর্ডবুক ঘেঁটে দেখা যাচ্ছে, গত তিন-চার বছরে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ খেলেছে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ছ’টা ক্লাব। ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড। আর্সেনাল। লিভারপুল। চেলসি। ম্যাঞ্চেস্টার সিটি। এবং টটেনহ্যাম। তা হলে এদের মধ্যে কেউ...?
আজ পর্যন্ত ইউরোপীয় ফুটবলে গড়াপেটার কলঙ্ক যা লেগেছে, সিংহভাগই ইতালির গায়ে। জুভেন্তাসের মতো ক্লাবকেও সিরি-এ থেকে নেমে যেতে হয়েছিল গড়াপেটার কোপে পড়ে। কিন্তু তা বলে ব্রিটিশ ফুটবল? রাত পর্যন্ত সঠিক উত্তর জানা যায়নি। ইউরোপোল জানিয়ে দিয়েছে, পুরো ব্যাপারটা যে হেতু এখনও তদন্তাধীন, তাই কে বা কারা অপরাধী এখনই বলা যাবে না।
তাদের রিপোর্ট থেকে জানা গিয়েছে, গড়াপেটা কেলেঙ্কারিতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জার্মান ফুটবল। সোয়াইনস্টাইগার, ফিলিপ লাম, ফ্র্যাঙ্ক রিবেরির ফুটবল সম্ৃদ্ধ বুন্দেশলিগায় গড়াপেটা করতে ম্যাচ পিছু কত খরচ হয়েছে, তার হিসেবও দিয়েছে একটি ওয়েবসাইট। তাদের মতে, অঙ্কটা ৮৬ হাজার পাউন্ড! গোয়েন্দাদের দাবি, এই বিশাল বেটিং-সিন্ডিকেটের শেকড় এশিয়ায়! সিঙ্গাপুরে। যে চক্রটা সেখানে বসে এই কাজ করত, তারা না কি ফুটবলার, রেফারি ও ক্লাব কর্তাদের ‘কিনতে’ ম্যাচ পিছু এক লক্ষ ইউরো খরচেও পিছু হঠত না। যারা আজ পর্যন্ত ১৭ লক্ষ পাউন্ড খরচ করেছে ঘুষ-বাবদ! আর গড়াপেটা করে লাভের খতিয়ান? ৬৯ লক্ষ পাউন্ড! ইউরোপোলের প্রধান রব ওয়েইনরাইট বলছেন, “ইংল্যান্ড নয়, নজরটা অন্যান্য দেশের দিকে বেশি। তবে এই নয় যে, কেলেঙ্কারিটা ইংল্যান্ড বাদে বাকি ইউরোপে হয়েছে।” সঙ্গে তাঁর সংযোজন, “গড়াপেটা নিয়ে এর চেয়ে বড় তদন্ত ইউরোপে কখনও হয়নি।” কী ভাবে হবে? মাত্র একজন ফুটবলার ‘কিনতে’ ঘুষ দেওয়া হয়েছে ১ লক্ষ ২১ হাজার পাউন্ড! ফুটবলার-রেফারি-কর্তা মিলিয়ে গোটা ঘটনায় জড়িত ৪২৫। বুন্দেশলিগাতেই গড়াপেটায় খরচ প্রায় ১৪ লক্ষ পাউন্ড!
জুয়াড়িরা কী ভাবে কাজ সারত? সে গল্প শুনলে চোখ কপালে উঠতেই পারে। একটা বিশেষ টিমই ছিল দুর্নীতিগ্রস্ত ফুটবলার এবং কর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার জন্য। যারা বিশাল টাকার ‘টোপ’ ফেলে ফুটবলার, রেফারি, কর্তাদেরও কিনত। জুয়াড়িদের টিমের অন্যতম মস্তিষ্ক ছিলেন হাঙ্গেরির একজন। যাঁর কাজ ছিল হাঙ্গেরির রেফারিদের প্রভাবিত করা। গড়াপেটা কী ভাবে হবে, একবার জানা গেলেই চলত ফোন-ইন্টারনেটের মাধ্যমে বাজি ধরা। ইউরোপে বসে এমন কুকর্ম চালানো কঠিন। অতএব ‘বেস ক্যাম্প’ এশিয়া। তেরো হাজার ই-মেল কাটাছেঁড়া করে পুরো কর্মকাণ্ডের খোঁজ মিলেছে। আশিটা সার্চ ওয়ারেন্ট বের হয়েছে আপাতত। গ্রেফতার এখনও পঞ্চাশ।
তাঁরা কারা? কোনও বড় টিমের নামকরা কেউ? কোনও বড় কর্তা? মুখে কুলুপ পুলিশ থেকে ফুটবল-কর্তার।
ফুটবল-সমর্থকদের হৃদপিণ্ড স্তব্ধ করে দেওয়ার মতো সব খবর। তথ্য। পুলিশ-কর্তা ওয়েনরাইট সগর্বে বলছেন, “একটা বিশাল কেলেঙ্কারি ফাঁস করে দিলাম।” বলতেই পারেন। কিন্তু একই সঙ্গে উয়েফা প্রেসিডেন্ট মিশেল প্লাতিনির মন্তব্যকেও পরিহাস শোনাচ্ছে। জানুয়ারির শেষ দিকে প্লাতিনি বলেন, “বর্ণবিদ্বেষের চেয়েও বড় অপরাধ গড়াপেটা। আমরা এখন শুধু গড়াপেটা নিয়েই চিন্তিত। কারণ এটাই সবচেয়ে বড় লজ্জা। যদি একটা ম্যাচের আগেই তার ফলাফলটা আমরা জেনে যাই, ধরে নিতে হবে ফুটবল মৃত।”
মাত্র ১৫ দিনেই তাঁর আশঙ্কা যে এ ভাবে বাস্তবের রুক্ষ মাটিতে আছড়ে পড়বে, কে জানত!
|

গড়াপেটার কথকতা |
 |
 |
• গড়াপেটা হয়েছে ইউরোপের ৩৮০ ম্যাচে।
• প্রাক্-বিশ্বকাপ, প্রাক্-ইউরো কাপ, চ্যাম্পিয়ন্স লিগেও।
• সন্দেহে এশিয়া-সহ বাকি বিশ্বের ৩০০ ম্যাচ।
• জড়িত ৪২৫ খেলোয়াড়, রেফারি ও কর্মকর্তা।
• জার্মান লিগে গড়াপেটায় মুনাফা ৬৯ লক্ষ পাউন্ড।
• বিশ্ব জুড়ে ঘুষ ১৭ লক্ষ পাউন্ডের বেশি।
• অস্ট্রিয়ায় এক জনকেই ঘুষ ১ লক্ষ ২১ হাজার পাউন্ড। |
অপারেশন ভেটো |
• ইউরোপোলের তদন্ত ১৮ মাস ধরে ৩০ দেশে।
• পুলিশের হাতিয়ার ১৩ হাজার ই-মেল, ৮০টি তল্লাশি পরোয়ানা। |
চক্রান্তের জাল |
• গড়াপেটার জাল ছড়ায় সিঙ্গাপুর সিন্ডিকেট।
• সিন্ডিকেটের দু’নম্বর, হাঙ্গেরির এক সদস্য। সে দলে টানত নিজ দেশের রেফারিকে।
• ওই রেফারির মাধ্যমে জুয়াড়িরা যোগাযোগ করত রেফারি-কর্মকর্তা, খেলোয়াড়দের সঙ্গে।
• গড়াপেটা পাকা হলে ফোন বা নেটে বেটিং।
• ইউরোপে সম্ভব নয় বলে বাজি ধরা হত এশিয়ায়। |
|