গাছে বাঁধা একটা কাঠের বাক্স। ভিতরে ঢোকার জন্য গোল করে খোপ কাটা।
সেই খোপ থেকে ঠোঁট বের করে উঁকি মারছে টিয়া। প্রখর রোদে পাশের গাছটায় বাঁধা একই ধরনের বাক্সয় যুগলবন্দি দুই পেঁচার। একটা-দু’টো নয়, চণ্ডীতলার আঁকুনি গ্রামে বেশ কিছু গাছেই এখন পাখিদের জন্য মানুষের তৈরি এ হেন ফ্ল্যাটবাড়ি, অর্থাৎ কি না কৃত্রিম কোটর।
কিন্তু পাখিদের জন্য মানুষ বাসা গড়ছে কেন?
বেশ কয়েক বছর ধরেই চড়াই, নীলকণ্ঠ, দোয়েল, বসন্তবৌরি, কুঠুরে পেঁচা, কালপেঁচা-সহ বিভিন্ন প্রজাতির পাখি কমে যাওয়ায় চিন্তায় পড়েছিলেন গ্রামেরই হিন্দোল আহমেদ। প্রকৃতিপ্রেমিক তরুণটি সমীক্ষাও করেন এ নিয়ে। বইপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করেন। নানা জনের সঙ্গে কথা বলেন।
সমীক্ষায় উঠে আসা তথ্যে চোখ কপালে ওঠে হিন্দোলের। এমন অনেক পাখি আছে, যারা বাসা বানায় না, মূলত মরা গাছের গায়ে কোটর তৈরি করে (জীবিত গাছের কোটরেও পাখিরা থাকে, কিন্তু স্বাভাবিক নিয়মে সেই সব কোটর বুজে যেতে পারে)। |
কিন্তু বর্তমানে মরা গাছ খুব একটা চোখেই পড়ে না। কেননা কোনও বড় গাছের মৃত্যু হলেই মানুষ তা কেটে নিয়ে যায়। বেঘর হয়ে পড়ে পাখির দল। অন্যত্র পাড়ি জমাতে হয় তাদের। তাতে নিজের এলাকা (হোম রেঞ্জ) হারাতে হতে পারে। অন্যদের সঙ্গে লড়তে হতে পারে। সর্বোপরি না-ও মিলতে হতে পারে পর্যাপ্ত খাবার। দিনের পর দিন এমন হতে থাকলে বিপন্ন হয়ে পড়ে প্রজাতি।
হরেক রকম হিসেব কষে জেলার একটি বন্যপ্রাণ সংগঠনের সদস্য হিন্দোলের মনে হয়েছিল, গাছে-গাছে কৃত্রিম কোটর তৈরি করলে তবেই ফিরতে পারে হারিয়ে যেতে বসা অনেক পাখি। সেই চিন্তা থেকেই বছর তিনেক আগে শুরু হয় পাখিদের জন্য তাঁরা ‘বিনা পয়সার প্রোমোটারি’। প্রথমে মাঝারি মাপের হাঁড়িতে গর্ত করে তা গাছে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। তাতে টিয়া আর শালিক আশ্রয় নেয়। কিন্তু গরমে মাটির হাঁড়ি তেতে ওঠে। মৌমছি চাক বাধে। সর্বোপরি ঝড়ে পড়ে যায় সেই হাঁড়ি। তখন হাঁড়ির বিকল্প হিসেবে বাজার থেকে ফল রাখার কাঠের বাক্স কিনে আনেন হিন্দোল। তাতে খোপ কেটে ঝুলিয়ে দেন কৃষ্ণচুড়া, তেঁতুল, আম, ছাতিম বা কদম গাছে। দু’টি লাগান নিজের বাড়ির ছাদে। মহা আনন্দে সেই বাসায় কূজন শুরু করে চড়াই, শালিক, টিয়া। তাঁর দাবি, এই বাসায় যে কোনও ঋতুতে স্বচ্ছন্দ বোধ করে পাখিরা।
গত দু’বছর ধরে গ্রামের প্রায় ৫০টি গাছে এই ভাবে পাখিদের জন্য কৃত্রিম বাসা তৈরি করে দিয়েছেন হিন্দোল। সঙ্গে পেয়েছেন ভাই এহতেসামউদ্দিন আহমেদকে। সুযোগ পেলেই খাঁচায় পাখি পোষার ক্ষতিকর দিকগুলো মানুষকে বোঝান তাঁরা। আম, ছাতিম এবং ক্ষিরিশ গাছে লাগানো বাক্সে বাসা বেঁধেছে টিয়া। কৃষ্ণচূড়া এবং তেঁতুল গাছে সংসার পেতেছে পেঁচা। কদম গাছে শালিক। ছাদের বাক্সে কিচিরমিচির করতে থাকে চড়াইয়ের দল। তাদের অনুপস্থিতিতে আবার সেই বাসাতেই অলস দুপুরে বিশ্রাম করে যায় লম্বা লেজের কাঠবিড়ালি। নিজের বাসায় খাবার মজুত রাখে বসন্তবৌরি।
বাজার থেকে ৩০ টাকা দিয়ে ফলের পেটি কিনে আনেন হিন্দোল। করাত, হাতুড়ি, ফিতে আর বাটালি দিয়ে নিজেরাই তৈরি করেন ওই সব কৃত্রিম নীড়। কিছু দিনের মধ্যেই আরও ৮০টি গাছে বাসা লাগানোর পরিকল্পনা রয়েছে তাঁদের। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রধান কমল বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “পাখিরা এই কৃত্রিম বাসায় থাকছে মানে এখানে ওরা মানিয়ে নিয়েছে। এই উদ্যোগ প্রশংসনীয়। তবে আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রয়োজন।” গ্রামের বাসিন্দা জায়েদ আহমেদ বলেন, “কয়েকটা বাক্স নিয়ে আমিও লাগিয়েছি। ছাতিম গাছের বাক্সটায় একটা পেঁচা থাকছে। ক্ষিরিশ গাছে দু’টো টিয়া। পেয়ারা গাছেও একটা লাগিয়েছি। তাতে কেউ এখনও আসেনি। আসবে নিশ্চয়ই।”
এই প্রতীক্ষাই এখন ছড়িয়ে পড়ছে আঁকুনির গাছ থেকে গাছে...। |