পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণ-কাণ্ডের পরে পাক্কা এক বছর গড়িয়ে গেল। মূল অভিযুক্ত কাদের খানের নাগাল এখনও পেল না পুলিশ। শিগগিরই সে ধরা পড়বে এমন আশ্বাসও দিতে পারছেন না একদা ‘প্রাচ্যের স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড’ হিসেবে খ্যাত কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দারা। এমন একটি সাড়া জাগানো, গুরুত্বপূর্ণ মামলায় মূল অভিযুক্তের বছরভর অধরা থাকাটাকে কলকাতা পুলিশের সাম্প্রতিক ইতিহাসে বিরল ঘটনা হিসেবে অভিহিত করছেন লালবাজারের প্রাক্তন ও বর্তমান বহু অফিসার। মূল অভিযুক্ত গ্রেফতার না-হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করে অভিযোগকারিণীর কৌঁসুলি অনির্বাণ গুহঠাকুরতা সোমবার বলেন, “অভিযোগকারিণীর নিরাপত্তা নিয়ে আমরা চিন্তিত।”
অভিযোগ, গত বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি রাতে পার্ক স্ট্রিটের এক হোটেলের সামনে থেকে ওই মহিলাকে গাড়িতে তুলেছিল কাদের ও তার সঙ্গীরা। তাঁকে গাড়িতে ধর্ষণ করে এক্সাইড মোড়ের কাছে ফেলে দেওয়া হয়। তিন দিন পরে তিনি পার্ক স্ট্রিট থানায় অভিযোগ জানাতে গেলে পুলিশ প্রাথমিক ভাবে গুরুত্ব দেয়নি। পরে বিষয়টি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হলে লালবাজার নড়েচড়ে বসে, তদন্তভার নেয় গোয়েন্দা-বিভাগ। কাদেরের ভাই নাসের খান-সহ তিন জন গ্রেফতার হয়। তৎকালীন গোয়েন্দা-প্রধান জানিয়ে দেন, মহিলা সত্যিই ধর্ষিতা হয়েছেন। |
ফিরে দেখা |
২০১২ |
• ৫ ফেব্রুয়ারি মহিলাকে মাঝরাতে গাড়িতে তুলে ধর্ষণ
• ৮ ফেব্রুয়ারি থানায় গিয়ে হেনস্থা। জেনারেল ডায়েরি
• ৯ ফেব্রুয়ারি এফআইআর দায়ের
• ১৫ ফেব্রুয়ারি তদন্তে গোয়েন্দা বিভাগ। হোটেলের সিসিটিভি হার্ড ডিস্ক বাজেয়াপ্ত
• ১৬ ফেব্রুয়ারি মুখ্যমন্ত্রী বললেন, সাজানো ঘটনা।এক সুর সিপি’র। মহিলার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন মন্ত্রীদের
• ১৮ ফেব্রুয়ারি তিন অভিযুক্ত গ্রেফতার। গোয়েন্দা-প্রধান দময়ন্তী সেন জানালেন, ধর্ষণ হয়েছে
• ২০ ফেব্রুয়ারি দময়ন্তীকে মহাকরণে তলব।
রাজনৈতিক চাপের অভিযোগ
• ৪ মে দময়ন্তীকে অন্য পদে বদলি
• ১০ মে দুই ফেরার-সহ পাঁচ জনের নামে চার্জশিট
• ১৯ সেপ্টেম্বর সিসিটিভি ফুটেজের ফরেন্সিক রিপোর্ট কোর্টে
• ২৮ ডিসেম্বর ধর্ষিতা সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য তৃণমূল
সাংসদ কাকলি ঘোষদস্তিদারের |
২০১৩ |
• ২২ জানুয়ারি অভিযোগকারিণীর নিরাপত্তা চেয়ে হাইকোর্টে আর্জি
• ২৪ জানুয়ারি ত্রুটিপূর্ণ নথি দেওয়ায় সুপ্রিম কোর্টে রাজ্য ভর্ৎসিত
• ২৯ জানুয়ারি যান্ত্রিক গলদে কোর্টে সিসিটিভি ফুটেজ
দেখা গেল না
• ৩১ জানুয়ারি আদালতে ঘোষণা, ১৯ ফেব্রুয়ারি চার্জ গঠন |
|
কিন্তু মূল অভিযুক্ত কাদের স্বয়ং ধরা পড়েনি। আর এক অভিযুক্ত মহম্মদ আলিও ফেরার। পুলিশ-সূত্রের খবর: মহিলা অভিযোগ জানানোর আগে যে ক’দিন ঘটনাটি ধামাচাপা ছিল, কাদের তখন কলকাতাতেই ঘুরে বেরিয়েছে। পুলিশ তৎপর হতেই সে শহর ছেড়ে চম্পট দেয়। তার পর থেকে হরেক সূত্রে হরেক সময়ে হরেক জায়গায় কাদেরের ‘উপস্থিতি’ টের পেলেও তার নাগাল পেতে পুলিশ ব্যর্থ। কী রকম?
লালবাজারের খবর, তদন্তের গোড়ায় অভিনেত্রী-প্রেমিকাকে করা ফোনের সূত্র ধরে গোয়েন্দারা
জানতে পেরেছিলেন, কাদের মুম্বইয়ে লুকিয়ে রয়েছে। কিন্তু সেখানে অভিযান চালিয়ে লাভ হয়নি। গোয়েন্দারা মুম্বই থেকে খালি হাতে ফিরতে না-ফিরতেই আর এক মোবাইল নম্বরের সূত্রে বিহারে কাদেরের গতিবিধি নজরে আসে। সেখানেও অভিযানই সার হয়েছে।
এবং তার পরে উত্তরপ্রদেশ, পঞ্জাব-সহ নানা রাজ্যে, এমনকী একাধিক পড়শি দেশে গিয়ে কাদেরের পদার্পণের খবর গোয়েন্দাদের কাছে এসেছে। কোনও বারই তাকে জালে ফেলা যায়নি। “ও এত ঘন ঘন ফোন আর সিম বদলাচ্ছিল যে, তাল রাখাই মুশকিল হয়ে পড়ে। পিছু পিছু
গিয়ে প্রতি বারই দেখা যায়, পাখি উড়ে গিয়েছে।” মন্তব্য লালবাজারের এক কর্তার।
ঠিক যেমন হয়েছে গত অক্টোবরে। এক তদন্তকারী জানাচ্ছেন, কাদেরের ঘনিষ্ঠদের থেকে পাওয়া একটি ফোন নম্বরের ভিত্তিতে খবর মিলেছিল, সে গুজরাতে রয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে কলকাতার গোয়েন্দারা গুজরাত পাড়ি দেন। সে রাজ্যের পুলিশের সাহায্য নেওয়া হয়। কিন্তু পুলিশের হাত এড়িয়ে কাদের চম্পট দেয়। লালবাজারের দাবি, কাদের খান সম্পর্কে সেটাই সর্বশেষ নির্দিষ্ট তথ্য। যদিও অক্টোবরে সে কলকাতায় এসেছিল বলে খবর রটে। কিন্তু কোনও সূত্রেই তার কোনও সমর্থন মেলেনি।
তবে যেখানেই গা ঢাকা দিয়ে থাক, কাদের যে কলকাতায় পরিবারের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলেছে, সে ব্যাপারে গোয়েন্দারা বিলক্ষণ ওয়াকিবহাল। লালবাজারের এক অফিসার বলছেন, “প্রথম দিকে ও বাড়ির লোকজনকে ফোন করত। পুলিশ ফোনে আড়ি পেতেছে বুঝে অন্য রাস্তা ধরে। অনেক সময়ে ইন্টারনেটের সাহায্যে পরিবারের সঙ্গে সে যোগাযোগ করছে বলে আমরা খবর পেয়েছি।” তা হলে সেই সূত্র ধরে এগোনো হচ্ছে না কেন?
পুলিশের দাবি: ফোনের মতো ইন্টারনেট ট্র্যাক করা অত সহজ নয়। সময়সাপেক্ষও বটে। যতক্ষণে হদিস মিলবে, ততক্ষণে কাদের ডেরাও বদলে ফেলবে। উপরন্তু যখন সে বিদেশের মাটিতে রয়েছে, তার নাগাল পাওয়া দুষ্কর। বস্তুত আন্তর্জাতিক অপরাধচক্রের যোগসাজশে কাদের বারবার সীমান্ত এলাকা দিয়ে নেপাল ও বাংলাদেশে আস্তানা বদলাচ্ছে বলে ইঙ্গিত পেয়েছেন তদন্তকারীরা। লালবাজারের একাংশের দাবি, আরব মুলুকেও কাদেরের যাতায়াত আছে। দেশ-বিদেশে ঘোরাফেরার খরচ বাবদ এ রাজ্য থেকে তার কাছে হাওয়ালা মারফত টাকাও দিব্যি পৌঁছে যাচ্ছে।
এত কিছু জানা সত্ত্বেও ওকে ধরা যাচ্ছে না কেন?
“হাতের নাগালে পেলে তো ধরব!” জবাব দিচ্ছেন এক গোয়েন্দা-কর্তা। কিন্তু ঘটনা হল, এ প্রসঙ্গে পুলিশের একাংশের বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগও উঠছে। প্রশ্ন জেগেছে গোয়েন্দা বিভাগের ‘সোর্স নেটওয়ার্ক’ নিয়ে। পাশাপাশি পার্ক স্ট্রিট কাণ্ডের প্রেক্ষিতে যে ভাবে তদানীন্তন গোয়েন্দা-প্রধান দময়ন্তী সেনের মতো দুঁদে আইপিএস অফিসারকে বদলি হতে হয়েছে, তার রেশও পুরো কাটেনি বলে লালবাজারের একাংশের দাবি। কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা-প্রধান পল্লবকান্তি ঘোষ অবশ্য এ দিন বলেন, “কাদেরকে ধরার চেষ্টা চলছে। লুক-আউট নোটিসও জারি রয়েছে।” |