হাসপাতালের সিঁড়ি দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে নামছে বছর চারেকের শিশুটি। পিছনে দৌড়চ্ছেন তার মা এবং ওয়ার্ডের নার্সরা। শিশুটি পালাতে চায়। কেমোথেরাপির জন্য তার হাতে চ্যানেল করা দরকার। কিন্তু বার বার সূচ ফুটিয়েও সফল হননি নার্সরা। উল্টে নড়াচড়া করতে গিয়ে তার কপালে জুটেছে কড়া ধমক। এর পরে কেমো চলাকালীনও হাজারো যন্ত্রণা। লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত শিশুটি এর আগে যত বার কেমো নিয়েছে, তত বারই তাকে এমন যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। তাই চিকিৎসা থেকে নিষ্কৃতি পেতেই দৌড়ে হাসপাতাল থেকে বেরোতে চেয়েছিল সে। কলকাতার এক বেসরকারি হাসপাতালের ক্যানসার বিভাগের ঘটনা।
কলকাতার এক মেডিক্যাল কলেজে বছর দশেকের একটি মেয়ের রেডিয়েশনের পরে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক আক্ষেপ করলেন, “মান্ধাতার আমলের যন্ত্র। চিকিৎসার আলাদা কোনও প্রোটোকলও নেই। বাচ্চাটা বেঁচে গেলেও ভবিষ্যতে আরও হাজারো জটিলতার শিকার হবে।”
আজ, ৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ক্যানসার দিবস। রাজ্য জুড়ে হাজারো অনুষ্ঠানের মাঝে চাপা পড়ে গিয়েছে শিশু ক্যানসার রোগীদের অধিকারের প্রশ্নটি। প্রতি বছর এ রাজ্যে প্রায় ৭০ হাজার মানুষ ক্যানসারে আক্রান্ত হন। এর মধ্যে দুই থেকে আড়াই হাজার শিশু। কিন্তু তাদের চিকিৎসার জন্য কোনও পৃথক পরিকাঠামো সরকারি-বেসরকারি কোনও স্তরেই গড়ে ওঠেনি। ক্যানসার চিকিৎসকেরা অধিকাংশই মানছেন, মুম্বই, চেন্নাই বা দিল্লির মতো রাজ্যে পেডিয়াট্রিক অঙ্কোলজির পৃথক পরিকাঠামো থাকলেও পশ্চিমবঙ্গে এখনও তেমন ভাবনা পর্যন্ত নেই।
এসএসকেএম হাসপাতালের রেডিওথেরাপি বিভাগের প্রধান চিকিৎসক অনুপ মজুমদার বলেন, “কিছু কিছু কেমো এবং রেডিয়েশন আছে, যা থেকে ফের ক্যানসার হতে পারে। বড়দের ক্ষেত্রে আমরা বিষয়টা নিয়ে ভাবি না। কারণ সেই মুহূর্তে প্রাণ বাঁচানোটাই জরুরি। কিন্তু একটা বাচ্চার সামনে লম্বা জীবন পড়ে থাকে। তার যাতে দ্বিতীয় বার ওই রোগ না হয় কিংবা গুরুতর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া না ঘটে, সে জন্য বহু ভাবনাচিন্তা এবং ‘ডেডিকেটেড’ চিকিৎসক দল দরকার। এ রাজ্যে কোথাও তা নেই।”
একই কথা জানিয়েছেন ক্যানসার শল্য চিকিৎসক গৌতম মুখোপাধ্যায়ও। তাঁর কথায়, “শিশুদের কেমোর ব্যাপারটা খুব জটিল। রেডিয়েশনও তাই। এ জন্য অভিজ্ঞ চিকিৎসক দল দরকার। এখানে বড়দের যাঁরা চিকিৎসা করেন, তাঁরাই শিশুদের দেখেন। আর শিশুদের ক্যানসারের অস্ত্রোপচার করেন শিশু শল্যচিকিৎসকেরা, ক্যানসার সম্পর্কে তাঁদের অনেকেরই সম্যক ধারণা নেই। তাঁরা অ্যাপেন্ডিক্সও অস্ত্রোপচার করছেন, আবার মস্তিষ্কের টিউমারও অস্ত্রোপচার করছেন।” ক্যানসার শল্য চিকিৎসক সৈকত গুপ্ত অবশ্য দাবি করেছেন, “শিশু শল্যচিকিৎসকেরা আমাদের পরামর্শ নিয়ে অস্ত্রোপচার করেন। এতে কোনও সমস্যা নেই। আর শিশুদের সবচেয়ে বেশি যে ক্যানসার হয় অর্থাৎ লিউকেমিয়া, তার উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা এখানে রয়েছে।” কথাটা পুরোপুরি মানতে পারেননি হেমাটো-অঙ্কোলজিস্ট আশিস মুখোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “শিশুদের ক্যানসার চিকিৎসার প্রোটোকলই আলাদা। এখানে সেটা মানাই হয় না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই শিশুদের ক্যানসার সঠিক সময়ে ধরা পড়লে পুরোপুরি সারিয়ে তোলা সম্ভব। কিন্তু তার জন্য পৃথক নজরদারি ও যত্ন প্রয়োজন। পশ্চিমবঙ্গে তেমন কোনও ব্যবস্থাই গড়ে ওঠেনি।”
আরজিকর মেডিক্যাল কলেজের ক্যানসার বিভাগের প্রধান সুবীর গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, “ছোটদের রেডিয়েশন দেওয়ার সময়ে তারা নড়াচড়া করে। ফলে বহু সুস্থ কোষ নষ্ট হয়। এখানে যে সব পুরনো আমলের যন্ত্র ব্যবহার হয়, তাতে সমস্যা আরও বেশি। দক্ষ অ্যানাস্থেটিস্ট থাকলে অ্যানাস্থেশিয়া প্রয়োগ করে রেডিয়েশন দেওয়া যেত। সেই ব্যবস্থাও নেই। শিশুদের ক্যানসার চিকিৎসায় প্রশিক্ষিত চিকিৎসক বা নার্স সবই অমিল। শিশুদের ক্যানসার বাড়ছে, অথচ তাদের নিয়ে আলাদা কোনও ভাবনাই নেই।”
কী বলছে স্বাস্থ্য দফতর? ক্যানসারের মতো মারণ রোগ নিয়ে সরকারি তরফে উদাসিনতা এমনই যে, এই মুহূর্তে ক্যানসারের দায়িত্বে কোনও পূর্ণ সময়ের আধিকারিক পর্যন্ত নেই। নভেম্বরে ক্যানসার বিভাগের উপ স্বাস্থ্য অধিকর্তার পদ থেকে সরেছেন কমলাকান্ত পতি। তার পরে এখনও পর্যন্ত ওই পদে স্থায়ী ভাবে কাউকে আনা হয়নি। শিশুদের চিকিৎসার কোনও পৃথক পরিকাঠামোর ভাবনা রয়েছে কি? উত্তরে কমলাকান্তবাবু স্পষ্ট জানিয়ে দেন, অদূর ভবিষ্যতেও তেমন কোনও পরিকল্পনা নেই। তিনি বলেন, “শুধুমাত্র মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগুলিতে ক্যানসারের পৃথক বিভাগ রয়েছে। এখন ধাপে ধাপে জেলা হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা চালু করার কাজ চলছে। দীর্ঘ পথ। এ সব শেষ না হলে অন্য কিছু ভাবার প্রশ্নই নেই।” |