রূপে সে যতই কালো হোক, গুণেই বাজিমাত
রূপে নয়, গুণেই তার আসল কদর। তাই রঙে কালো হয়েও শিউলি ফুলের মতো ঝরঝরে সাদাকে সে অনায়াসে টেক্কা দিয়েছে। পাল্লা টানছে সুবাসেও।
কালো চালের ভাতের উপকারিতা দেখে পুষ্টি-বিজ্ঞানীরা মোহিত।
কুচকুচে ওই কালো চাল ফুটিয়ে যে ভাত হয়, আপাতদৃষ্টিতে তা-ও যেন কৃষ্ণবর্ণ। তবে ভাল ভাবে ঠাহর করলে বোঝা যাবে, ভাত ঠিক কালো নয়। বরং গাঢ় বেগুনি। যা কি না সাদা ভাতের তুলনায় পুষ্টিগুণ ও রোগ প্রতিরোধক উপাদানে অনেক বেশি সমৃদ্ধ। বিশেষত, ক্যানসার প্রতিরোধে কালো ভাত যথেষ্ট সহায়ক বলে পুষ্টি-বিজ্ঞানীদের একাংশের দাবি।
তাই সরকারি উদ্যোগে সুগন্ধী কালো চালের খরিফ চাষ পশ্চিমবঙ্গেও শুরু হয়ে গিয়েছে।
কোনও চাল বা তার ভাতের রং কালো হয় কী করে?
ধান গবেষক তথা রাজ্য কৃষি দফতরের ফুলিয়া কৃষি-প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সহ-অধিকর্তা অনুপম পালের ব্যাখ্যা, “মূলত অ্যান্থোসায়ানিন নামে এক বিশেষ যৌগের উপস্থিতির সুবাদে চাল কালো হয়।” অ্যান্থোসায়ানিন-ই ক্যানসার ঠেকাতে বিশেষ ভূমিকা নেয় বলে গবেষণায় প্রকাশ। “উপরন্তু বার্ধক্য, স্নায়ুরোগ, ডায়াবেটিস, এমনকী ব্যাক্টেরিয়া-সংক্রমণ প্রতিহত করতেও অ্যান্থোসায়ানিনের জুড়ি মেলা ভার। এই চালে আয়রন ও ফাইবার বেশি, অথচ শর্করা কম।” জানাচ্ছেন অনুপমবাবু।
কালো চালের ইতিহাস অবশ্য অনেক পুরনো। মিং যুগের চিনে চতুর্দশ-সপ্তদশ শতকে এর চাষ হতো। কিন্তু রাজা ও রাজ পরিবারের সদস্যেরা ছাড়া কালো ভাত মুখে তোলার অধিকার কারও ছিল না। প্রজাদের জন্য তা ছিল নিষিদ্ধ। তাই এর এক নাম নিষিদ্ধ চাল (ফরবিডন রাইস)। পরবর্তী কালে জাপান ও মায়ানমারের (তদানীন্তন বর্মা) মতো কিছু দেশেও তার প্রচলন হয়। আর বাংলায়?
গবেষকেরা জেনেছেন, পশ্চিমবঙ্গে রেওয়াজ না-থাকলেও অবিভক্ত বাংলার চট্টগ্রামে কালো চালের চাষ হতো। এখনও হয়। কক্সবাজারে কালো চাল বিক্রি হয় ‘পোড়া বিন্নি’ নামে। এ ছাড়া মণিপুরে কালো চাল ফলে, সে রাজ্যে তার পরিচয় ‘চাখাও আমুবি।’ অন্ধ্র-ওড়িশায় আদিবাসী অধ্যুষিত তল্লাটে বহু বছর ধরে কালো ভাত খাওয়ার চল রয়েছে। ওড়িশা থেকেই ওই ধানের কিছু বীজ নমুনা হিসেবে পশ্চিমবঙ্গে আনা হয়েছিল বছর তিনেক আগে। ফুলিয়ার কৃষি-প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে সেই বীজ বুনে প্রায় চার কেজি বীজ পাওয়া যায়। কৃষি-কর্তারা কিছু উৎসাহী কৃষকের হাতে তা তুলে দেন।
এ ভাবে গত খরিফ মরসুমে পশ্চিমবঙ্গে কালো চালের চাষ অল্প পরিমাণে শুরু হয়েছে। বর্ধমান, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, নদিয়া ও হুগলির কিছু চাষি পরীক্ষামূলক ভাবে অল্প জমিতে আশানুরূপ ফলন পেয়েছেন। পুরুলিয়া-কোচবিহারেও ফলন মিলেছে। ওষধি হিসেবে শহরাঞ্চলে এর চাহিদা যথেষ্ট। কৃষি-কর্তারা জানিয়েছেন, বেঙ্গালুরুতে কালো ভাতের চাল অন্তত ১৬০ টাকা কেজি দরে বিকোচ্ছে, ফলাচ্ছেন কর্নাটকের চাষিরাই। এর প্রেক্ষিতে পশ্চিমবঙ্গ কৃষি দফতরও কালো চালের দিকে কৃষকদের নজর টানতে প্রচারে নেমেছে। রাজ্যের কৃষি-সচিব সচিব সুব্রত বিশ্বাস জানাচ্ছেন, ২০১২-র খরিফে তাঁরা পরীক্ষামূলক চাষ চালিয়ে ফলন সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছেন। তাই আগামী খরিফে চাষের এলাকা বাড়ানো হবে।
চাষিরা কী বলছেন? দক্ষিণ ২৪ পরগনার পাথরপ্রতিমার বনশ্যামনগর গ্রামের দেবাশিস ঘড়ুই বলেন, “সরকার আমাকে কালো ধানের বীজ নিখরচায় দিয়েছে। খরিফে অনেকটা জুড়ে চষব।” দেবাশিসবাবু জানান, কালো চালে ফলন পেতে সময় লাগে ১০০-১১০ দিন। বিঘে-পিছু সাড়ে পাঁচ কুইন্টাল ধান ওঠে, ভাতের গন্ধ অনেকটা গোবিন্দভোগের মতো। বর্ধমানের আউশগ্রামের চাষি অভ্র চক্রবর্তীর কথায়, “বিঘে-পিছু সাড়ে পাঁচ কুইন্টাল আসবেই। আমি দু’কেজি ধান রেখে দিয়েছি। এই খরিফে পুরোটা বীজ হিসেবে লাগাব।”
অন্য অন্ন
আয়রন বেশি, ফাইবারে ভরপুর
শর্করা কম, তাই ডায়াবেটিসে পথ্য
অ্যান্থোসায়ানিন থাকায় রং কালো
অ্যান্থোসায়ানিন ক্যানসার রোখে
গন্ধে যেন গোবিন্দভোগ
চট্টগ্রামে নাম ‘পোড়া বিন্নি’
মণিপুরে ‘চাখাও আমুবি’
ফলন যে বিকোবে, সে নিশ্চয়তা কতটা?
বস্তুত যতই ‘রোগ প্রতিরোধক’ বা ‘পুষ্টি সহায়ক’ হোক না কেন, আম বাঙালির রোজকার পাতে কালো ভাত কতটা সমাদর পাবে, তা নিয়ে কৃষি ও কৃষি বিপণন কর্তাদের মনে সংশয় রয়েছে। তাই আপাতত কালো চালকে মূলত এ রাজ্যে ও ভিন্ রাজ্যে ‘ওষধি চাল’ হিসেবে বিপণন করাই তাঁদের লক্ষ্য। সচিব সুব্রতবাবুর আশ্বাস, “বাজার নিয়ে চাষিদের ভাবতে হবে না। ওঁদের পুরো ফলনটা কৃষি বিপণন দফতরই কিনে নিয়ে বেচবে।” পাথরপ্রতিমার দেবাশিসবাবুও বলছেন, “কর্তারা ভরসা দিয়েছেন, দরকারে পুরো ফলনটাই কৃষি দফতর সরাসরি কিনে নেবে। চাষ বাড়াতে ক্ষতি কী?”
কিন্তু শুধু সরকারি সংগ্রহে ভর করে অনির্দিষ্ট কাল চাষ চালিয়ে যাওয়া তো আর্থিক ভাবে বাস্তবসম্মত নয়! কৃষি-কর্তাদের অনেকেও মানছেন যে, ‘স্বাস্থ্য সচেতন’ উচ্চ মধ্যবিত্তের হেঁসেলের গণ্ডি ছাড়িয়ে সাধারণ গেরস্থের রসনায় ছাড়পত্র না-পেলে কালো চালের বাজারি ভাগ্য উজ্জ্বল হওয়া কঠিন। কী ভাবে সেটা হতে পারে?
দেশের এক প্রথম সারির রেস্তোরাঁ গোষ্ঠীর কর্ণধার অঞ্জন চট্টোপাধ্যায় বলেন, “চিনের কুনমিং প্রদেশে দাই সম্প্রদায়ের মানুষ মূলত এই কালো চালেরই ভাত খান। কিন্তু এখানে আচমকা কালো ভাত যত্রতত্র চালু করলে লোকে ভয় পেয়ে যাবে। তাই বিশেষ বিশেষ পদের মাধ্যমে এর প্রসার ঘটাতে হবে।” উদাহরণও দিচ্ছেন তিনি “আমাদের চিনে খাবারের রেস্তোরাঁয় কালো চাল দিয়ে পাইনঅ্যাপল রাইস নামে একটা বিশেষ পদ উৎসবের মরসুমে তৈরি হয়। এ বার কালো চালে চিংড়ি পোলাও করার কথা ভাবছি।” অঞ্জনবাবুরা রেস্তোরাঁর জন্য কালো চাল সরাসরি চিন থেকে আমদানি করেন। “পশ্চিমবঙ্গে চাষ হলে সুবিধাই হবে।” বলছেন তিনি।
কালো হলেও ‘ভাল’র গুণে বাজার বাড়বে, এমন আশা তা হলে করাই যায়।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.