খেলোয়াড়-ফেডারেশনে যুদ্ধ হয়, ভারতীয় টেনিসের প্রাণ যায়! গত অলিম্পিক থেকে এই ডেভিস কাপসাত মাস যাবৎ, একই লজ্জার ট্র্যাডিশন চলছে!
দায়ী কোন পক্ষ? দেশের সেরা এগারো প্লেয়ারের বিদ্রোহী জোট, না এআইটিএ? খেলোয়াড়মহল আর ফেডারেশনের মধ্যেই স্পষ্ট বিভাজন দেখা গেল আজ খোদ স্টেডিয়ামেই। দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে রবিবার দু’টো রিভার্স সিঙ্গলসই হেরে ভারত ১-৪ কচুকাটা হওয়ার পর।
জয়দীপ মুখোপাধ্যায়: এই টাইয়ের আগেই এআইটিএ-র উচিত ছিল, যে কোনও ন্যূনতম সমঝোতার ভিত্তিতেও সোমদেবদের সঙ্গে সমস্যা মিটিয়ে ফেলা। তা হলে কোরিয়ানদের মতো তিনশো-চারশো র্যাঙ্কিংয়ের প্লেয়ারদের হাতে নিজের দেশে লজ্জাজনক হার হজম করতে হত না। দু’তরফের ইগোর লড়াইয়ের করুণ পরিণতি এটা।
আখতার আলি: প্লেয়ারদের জোটের একগুঁয়েমির জন্য ভারতকে হারতে হল। ওই এগারোর যে কোনও তিনজন লিয়েন্ডারের সঙ্গে এখানে খেললে ভারত হেসেখেলে জিতত। কোরিয়া কোনও টিম হল?
কার্তি চিদম্বরম: এআইটিএ-র একজন শীর্ষ কর্তা হিসেবে বলতে খুব খারাপই লাগছে যে, ফেডারেশনের বাস্তববুদ্ধির অভাবেই এ রকমটা হল। ওই এগারো প্লেয়ারের কথা ছেড়েই দিলাম। বাকি প্লেয়ার যারা পড়ে ছিল, তাদের মধ্য থেকেও কি সেরাদের নিয়ে এই ডেভিস কাপ দলটা গড়া হয়েছে? আমি কিছু বুঝতে পারছি না, আমাদের ফেডারেশন কী চাইছে!
হিরণ্ময় চট্টোপাধ্যায়: এটাই তো ওই এগারো জন প্লেয়ার চেয়েছিল! দেশের সম্মান যারা ইচ্ছে করে ডোবায়, তাদের দেশদ্রোহী বললে কি খুব অন্যায় হবে?
অলৌকিকের চেয়েও বেশি কিছু যদি থাকত ভারতের আজ ১-২ থেকে ৩-২ করার জন্য, সেটার দরকার ছিল। রঞ্জিত প্রথম দিন যে অবিশ্বাস্য রকমের ভুলভাল টেনিস খেলেছিলেন, সেটার ভিডিও তুলে বোধহয় ‘হাউ নট টু প্লে টেনিস’ নামের ম্যানুয়াল বার করে ফেলা যায়! সেই ছেলে মাত্র আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে বিপক্ষের এক নম্বর প্লেয়ারকে হারিয়ে টাইয়ে সমতা ফেরাবেন, অতি বড় ভারতীয় সমর্থকও আশা করেনি। তা সত্ত্বেও আর কে খন্না স্টেডিয়ামে দিনভর খুলে রাখা ‘ফ্রি টিকিট কাউন্টার’-এর দৌলতে ছুটির দিনে গ্যালারিতে বেশ ভাল ভিড় জমেছিল। |
লিয়েন্ডার অক্লান্ত ভাবে সারাক্ষণ রিজার্ভ বেঞ্চ থেকে জাতীয় পতাকা উড়িয়ে গেলেন। গ্যালারিতে ঢোল-করতাল বাজনার পাশাপাশি ভাংরা চলল। দিল্লির টেনিস কোর্টকে এক-এক সময় মনে হচ্ছিল পঞ্জাবিদের বিয়েবাড়ি! তেতে ওঠার এত উপকরণ দেখেই হয়তো রঞ্জিত সত্যিই এ দিন আপ্রাণ লড়লেন। আগের ম্যাচে ৮৩ মিনিটে উড়ে গিয়েছিলেন। আজ সুকের কাছে ৪-৬, ৪-৬, ২-৬ হারা ম্যাচে প্রথম সেটই টেনে নিয়ে গেলেন ৫৮ মিনিট। প্রথম সাত গেমের মধ্যেই যতগুলো পয়েন্ট বা গেম জিতেছেন, প্রথম দিনের সেই অভিশপ্ত সিঙ্গলসে গোটা ম্যাচে তা জিততে পারেননি।
কিন্তু নির্মম সত্য হল, রঞ্জিত-বিজয়ন্তদের ডেভিস কাপের মতো বিশ্ব পর্যায়ের টেনিস ম্যাচে যোঝার মতো শারীরিক শক্তিই নেই। স্কিল-টিল তো পরের কথা। প্রথম দিন বিজয়ন্ত দু’সেট খেলেই পায়ে বীভৎস ক্র্যাম্প ধরিয়ে বসে রিটায়ার করেছিলেন। আজ সেই অবস্থাই প্রায় হতে যাচ্ছিল রঞ্জিতের। দ্বিতীয় সেটে ৪-৪ অবস্থায় নিজের সার্ভিসে মোক্ষম সময় ডান কাঁধে (সেটাই তাঁর প্লেয়িং-হ্যান্ড) যন্ত্রণা শুরু হয় তাঁর। প্রথমে কোর্টের ধারে তার পরে লকাররুমে ফিরে গিয়ে দু’দফা ‘ইনজুরি টাইম-আউট’ নিয়ে ম্যাচে কোনও রকমে ফিরলেও বাকি সময়টা খেলা থেকে প্রত্যাশিত ভাবেই সম্পূর্ণ হারিয়ে গেলেন। টাইয়ের ভাগ্যের ওখানেই ইতি। শেষ সিঙ্গলসে ‘ডেড রাবার’-এ বিজয়ন্তকে ‘বেস্ট অব থ্রি সেট’-এ ৬-২, ৬-৪ হারান কোরিয়ার রিজার্ভ প্লেয়ার নাম।
মজার হল, কোরিয়ার কাছে নিজের দেশে ভারত এর আগেও ১-৪ হেরেছে। ঊননব্বইয়ে বারুচে। এখনকার দলের কোচ জিশান আলি সেই টিমের এক নম্বর সিঙ্গলস প্লেয়ার ছিলেন। তার পরের টাইতেই লিয়েন্ডারের ডেভিসে আবির্ভাব। ২০১৩-র হার যাঁর হয়তো দিল্লিতে শেষ ডেভিস কাপ হয়ে থাকল। কিন্তু টেনিস কর্তাদের অন্য অঙ্ক। কয়েক জনকে দেখা গেল, বারুচকে ঢাল করে দিল্লির কলঙ্কের হারকে সামলাতে ব্যস্ত। কিন্তু আজকের পর এই প্রশ্ন উঠলে অবাক হওয়ার নেই যে, দেশের হয়ে খেলতে অস্বীকার করে সোমদেব-মহেশ-রোহনরা যদি ঐতিহাসিক অন্যায় করে থাকেন, তা হলে ফেডারেশন অন্তত সনম-বিষ্ণু-য়ুকির মতো জুনিয়রদের বোঝাতেও ব্যর্থ হল কেন? যে তরুণ গ্রুপটা চণ্ডীগড়ে কয়েক মাস আগেই নিউজিল্যান্ডকে ৫-০ হারিয়েছিল! ভারতের ভালমানুষ নন-প্লেয়িং ক্যাপ্টেন এস পি মিশ্র পর্যন্ত আজ টাইয়ের শেষে বলে দিলেন, “কোনও সিনিয়র প্লেয়ার ছাড়াই আমাদের ছ’জনের যে দলটা নিউজিল্যান্ডকে হারিয়েছিল, ওরাই ভারতীয় টেনিসের ভবিষ্যৎ। ওই ছ’টা ছেলের জন্য আমার সত্যিই খারাপ লাগছে।”
ভবিষ্যৎ যে কী ভারতীয় টেনিসের সেটা ভবিষ্যতের গর্ভেই রয়েছে। এই মুহূর্তে এটুকুই বলা সম্ভব যে, প্রথমে ইন্দোনেশিয়াকে ৫-৭ এপ্রিল ঘরের মাঠে (সম্ভবত মুম্বইয়ে সিসিআই-এ নবনির্মিত হার্ডকোর্টে খেলা) হারাতে হবে। তার পর ১৩-১৫ সেপ্টেম্বর প্লে-অফেও জিততে হবে ভারতকে, অন্তত এশিয়া-ওশেনিয়া এক নম্বর গ্রুপে টিকে থাকার জন্য। নইলে আঞ্চলিক পর্বেরও দু’নম্বর গ্রুপে নেমে গিয়ে হংকং, শ্রীলঙ্কার মতো বালখিল্য টেনিস-দেশের সঙ্গে কাঁধ ঘষাঘষি করতে হবে তিন বারের ডেভিস কাপ ফাইনালিস্ট দেশকে।
দেখা যাক, নিজের নাক কেটে নিজেরই যাত্রা ভঙ্গ আরও কত দিন চলে ভারতীয় টেনিসে! |