সিপিআইএম-এর অভ্যন্তরে একটি বিরল প্রশ্ন উঠিয়াছে পর পর দুই দিন ধর্মঘটের ডাক দেওয়া কি রাজনৈতিক বিচক্ষণতার পরিচয়? যে মেহনতি মানুষের স্বার্থরক্ষা তাঁহাদের রাজনীতির ঘোষিত লক্ষ্য, ৪৮ ঘণ্টার ধর্মঘট কি তাহাদেরই স্বার্থবিরোধী নহে? এই প্রশ্নগুলির জন্য ২০১৩ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করিতে হইল কেন, তাহা বোঝা সম্ভব যত দিন ক্ষমতার দাপট ছিল, তত দিন ভুল-ঠিক লইয়া মাথা ঘামাইবার কথা স্মরণে আসে নাই। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এক বার ধর্মঘটের বিরোধিতা করিয়াছিলেন বটে, কিন্তু দলের চাপে সেই প্রশ্ন গিলিতেও বাধ্য হইয়াছিলেন। তবে, অতীতচর্চা থাকুক। বিলম্বে হইলেও পার্টির অভ্যন্তরে এই প্রশ্ন উঠিয়াছে, ইহা সুলক্ষণ। তবে, প্রশ্নটি গভীরতর হওয়া উচিত ছিল আদৌ কেন ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হইবে, এই প্রশ্নটি তুলিবার সময় বহিয়া যাইতেছে। ধর্মঘট রাজনীতির শেষ অস্ত্র হিসাবেই পরিচিত ছিল। অতিব্যবহারে সেই অস্ত্রটিকে ভোঁতা করিয়া ফেলিবার ঐতিহাসিক দায়টি বামপন্থীদেরই। যেহেতু নামে সর্বভারতীয় হইলেও বামপন্থীরা মূলত তিনটি রাজ্যে সীমাবদ্ধ, এবং তাহারও মধ্যে পশ্চিমবঙ্গেই সর্বাধিক দাপুটে ছিলেন, তাঁহাদের ধর্মঘটের বাড়াবাড়িতে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্তও এই রাজ্যটিই হইয়াছে। এই রাজ্যের নেতারাই যে ধর্মঘটের যৌক্তিকতা লইয়া প্রশ্ন তুলিয়াছেন, তাহা পশ্চিমবঙ্গের পক্ষে একটি বিরল সুসংবাদ।
লক্ষণীয়, এই প্রশ্নেরও একটি ‘শ্রেণিচরিত্র’ আছে যাঁহারা দুই দিনব্যাপী ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত করিয়াছেন, তাঁহারা পলিটব্যুরো নামক গজদন্তমিনারের বাসিন্দা, নির্বাচনী রাজনীতি বা প্রশাসনের সহিত সম্পর্কহীন। আর যাঁহারা প্রশ্ন তুলিতেছেন, তাঁহারা মাঠের রাজনীতির মানুষ। তাঁহাদের নির্বাচনে লড়িতে হয়, হইবে। ফের জিতিলে সরকার চালাইতেও হইবে। বামপন্থী রাজনীতির ক্ষেত্রে এই দ্বন্দ্বটি অতি তাৎপর্যপূর্ণ। সংসদীয় গণতন্ত্রের পরিসরে বামপন্থীরাই সম্ভবত একমাত্র দল, যেখানে নীতিনির্ধারকরা নির্বাচনী রাজনীতির ত্রিসীমানায় থাকেন না। তাঁহারা তত্ত্ব করেন কোথায় দাঁড়ি, কোথায় সেমিকোলন পড়িলে দাস ক্যাপিটাল অশুদ্ধ হইবে, সেই বিচারেই তাঁহাদের দিন কাটে। আর যাঁহারা ‘রাজনীতি’-র সহিত জড়িত, নীতি নির্ধারণ তাঁহাদের নাগালের বাহিরে। ভারতীয় রাজনীতিতে বামপন্থীরা ইতিমধ্যেই ‘অতি বিরল’ শ্রেণিভুক্ত হইয়াছেন। দলের এই চরিত্রবৈশিষ্ট্যটি না বদলাইলে বিলুপ্ত হইতে বিলম্ব হইবে না। এই বদল প্রসাধনের বদল নহে, একেবারে ডি এন এ-র পরিবর্তন। সনাতন বামপন্থী পার্টি যে পথে হাঁটিতে অভ্যস্ত, এই পথ তাহার বিপ্রতীপ। কিন্তু ভিতরে বদল না আসিলে যে আসলে কিছুই বদলায় না, পরিবর্তনোত্তর পশ্চিমবঙ্গকে দেখিবার পর আর সে বিষয়ে সংশয় থাকিবার কথা নহে। কাজেই, বামপন্থীদের যদি টিকিয়া থাকিতে হয়, এই বদলের পথেই হাঁটিতে হইবে। তাঁহারা ব্রিটেনের নিউ লেবার পার্টির কথা স্মরণে রাখিতে পারেন। টোনি ব্লেয়ারও সনাতন সমাজপন্থার পথ হইতে সরিয়া আসিয়াছিলেন। এবং তাহাতেই লেবারদের অস্তিত্বরক্ষা হইয়াছে। ভারতেও একই পথ। যত দিন রেজ্জাক মোল্লাদের প্রকাশ কারাটদের কথায় চলিতে হইবে, বামপন্থীদের পুনরুজ্জীবনের সম্ভাবনা নাই।
অচলায়তনে ঘা দিবার কাজটি চিরকালই কঠিন। আর কেহ জানুন বা না-ই জানুন, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বিলক্ষণ জানেন। তিনি বিনিয়োগের প্রশ্নে যেমন বাস্তববাদী ছিলেন, ধর্মঘটের প্রশ্নেও। সম্ভবত তিনি বুঝিয়াছিলেন, ধর্মঘট নামক তরবারির দুই দিকই ধারালো তাহা শ্রমজীবী মানুষের রুজি যেমন কাড়ে, বিনিয়োগকারীদের বিশ্বাসও নষ্ট করে। ধর্মঘটে কাহারও লাভ নাই। এই কথাগুলি বুঝিবার এবং বলিবার পরেও তাঁহাকে দলের গতেই ফিরিতে হইয়াছিল। ইতিহাস সম্ভবত তাঁহাকে এক ব্যর্থ প্রশাসক হিসাবেই মনে রাখিবে। কিন্তু তাঁহার ব্যর্থতার দুইটি দিক আছে—
এক, তিনি অন্তত চেষ্টা করিয়াছিলেন;
দুই, দলের ডি এন এ-তে বদল আনিবার কাজটি কত কঠিন, তাঁহার ব্যর্থতাই তাহার প্রমাণ। কিন্তু সিপিআইএম-এর অভ্যন্তরে এই চেষ্টা ফুরাইয়া গেলে চলিবে না। সদর দফতরে কামান দাগিতেই হইবে। |