সঙ্গীর চম্পট, উদ্ধার ৩ তরুণী
স্টেশনে ঝটিকা হানায় ধৃত নারী পাচারের চাঁই
নিশুত রাতের হাওড়া স্টেশন। নতুন কমপ্লেক্সের ২১ নম্বর প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছে আমদাবাদগামী পোরবন্দর এক্সপ্রেস। ক’মিনিটের মধ্যে ট্রেন ছাড়বে। অসংরক্ষিত (জেনারেল) কামরার সামনে যাত্রীদের জটলা।
আচমকা কোথা থেকে উদয় হল এক দল যুবক-যুবতী। তারা সেই যাত্রী-জটলার মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ল। এবং কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগে ভিড় থেকে টেনে-হিঁচড়ে নিমেষে আলাদা করে ফেলল একটি পুরুষ ও তিনটি মেয়েকে। বাকি যাত্রীরা আকস্মিকতার ঘোর কাটিয়ে উঠতে না-উঠতে চার জনকে ঘিরে আগন্তুকেরা প্রায় স্টেশনের বাইরে!
যেন অ্যাকশন ফিল্মের দৃশ্য!
শনিবার রাতে এ হেন সিনেমার কায়দাতেই পুলিশ পাকড়াও করল আন্তর্জাতিক নারী পাচার-চক্রের এক পাণ্ডাকে। ধৃতের নাম বাবু ভাই, সে আদতে বাংলাদেশের লোক। সঙ্গের তিনটি তরুণী তার ‘শিকার।’ পুলিশের দাবি: চাকরির টোপ দিয়ে বাংলাদেশি মেয়ে তিনটিকে গুজরাতে পাচার করার তালে ছিল বাবু। তাই শনিবার রাতে ওদের নিয়ে সে পোরবন্দর এক্সপ্রেস ধরতে হাওড়ায় আসে, সঙ্গে ছিল মহম্মদ শাহিন নামে এক শাগরেদও। তবে শাহিনকে ধরা যায়নি।
বাবু ভাইয়ের খোঁজ মিলল কী ভাবে?
পুলিশ-সূত্রের খবর: ১৪ জানুয়ারি রামরাজাতলা স্টেশনের কাছে লাইনের পাশে এক বাংলাদেশি তরুণীকে জখম অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল। তাঁরই মুখে বাবু ভাইয়ের সুলুক-সন্ধান মেলে। গোয়েন্দা-সূত্রের দাবি: মেয়েটি পুলিশকে জানান, বাবু তাঁকে বাংলাদেশ থেকে এনে বসিরহাটের ইটিন্ডার একটা বাড়িতে রেখেছিল। জানুয়ারির গোড়ায় সেখান থেকে তাঁকে আমদাবাদে নিয়ে গিয়ে যৌনপল্লিতে বিক্রি করে দেয় এক যুবক। মেয়েটি সেই ‘দালালের’ নামও জানিয়েছেন মনিরুল। সে ইটিন্ডারই বাসিন্দা। তরুণীটি তদন্তকারীদের বলেন, সপ্তাহখানেক বাদে তিনি আমদাবাদ থেকে কলকাতায় পালিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু তাতেও নিস্তার পাননি, ফের মনিরুলের খপ্পরে পড়ে যান।
হাওড়া আদালতে ধৃতেরা। —নিজস্ব চিত্র
কী ভাবে?
তরুণীর দাবি: আমদাবাদের ওই নিষিদ্ধপল্লি থেকে আর একটি মেয়ের সঙ্গে তাঁকে বার করে আনার ছক কষেছিল ‘জন’ নামে একটি যুবক। গোয়েন্দাদের ধারণা, মনিরুলদের সঙ্গে জনের আগে যোগাযোগ ছিল। তরুণীর বয়ান অনুযায়ী, পালিয়ে আসার দিন অন্য মেয়েটি আমদাবাদ স্টেশনে দুষ্কৃতী-চক্রের হাতে ধরা পড়ে গেলেও জনের সাহায্যে তিনি ফিরে আসেন। কিন্তু জনই ফের তাঁকে মনিরুলের হাতে তুলে দেয় বলে তাঁর অভিযোগ। তদন্তকারীদের অনুমান, মনিরুলদের কাছ থেকে শাসানি পেয়েই জন পিছিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছিল।
জনের খোঁজও চালাচ্ছে পুলিশ। কিন্তু মনিরুল দ্বিতীয় বার তাঁকে কোথায় আটকে রেখেছিল, মেয়েটি তা পুলিশকে বলতে পারেননি। শুধু এটুকু জানাতে পেরেছেন, তাঁকে আবার ট্রেনে চাপিয়ে ‘কোথাও’ নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। শেষমেশ তিনি চলন্ত ট্রেন থেকে ঝাঁপ দেন। সে দিনই (১৪ জানুয়ারি) রামরাজাতলা স্টেশনের কাছে তাঁকে উদ্ধার করে শালিমার জিআরপি। পুলিশ জানিয়েছে, তিনি মুম্বই মেল থেকে ঝাঁপ দিয়েছিলেন। গোয়েন্দাদের অনুমান, তাঁকে পুণেতে পাচার করা হচ্ছিল। আহত মেয়েটি পুলিশকে কয়েকটা মোবাইল নম্বর দেন। সেগুলোর মধ্যে বাবু ও মনিরুলের নম্বরও ছিল। তার সূত্র ধরে সিআইডি তদন্তে নামে। যার পরিণতিতে শনিবার বাবু ভাইকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়েছে। কী ভাবে? সিআইডি-সূত্রের খবর: ফোনে বাবু-মনিরুলকে মেয়ে বিক্রির টোপ দেওয়া হয়। তারা ফাঁদে পা-ও দেয়। মনিরুলের ইটিন্ডার ডেরার হদিস মেলে। শনিবার পুলিশ সেখানে হানা দেয়। মনিরুল ধরা পড়ে, সঙ্গে পাকড়াও হয় চক্রের আর এক চাঁই মুন্না ভাই। মুন্না আদতে গুজরাতের লোক বলে পুলিশ জানিয়েছে। মনিরুল-মুন্নাকে নাগাড়ে জেরা করে জানা যায়, ওই রাতেই পোরবন্দর এক্সপ্রেসে বাবু ও শাহিন তিনটি বাংলাদেশি মেয়েকে কলকাতা থেকে পাচার করবে।
সঙ্গে সঙ্গে ‘অপারেশন’-এর প্রস্তুতি শুরু হয়। সিআইডি-র হিউম্যান ট্র্যাফিকিংয়ের ইন্সপেক্টর শর্বরী ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে গড়া হয় বিশেষ দল। সঙ্গে নেওয়া হয় হাওড়া জিআরপি’র বাছাই কিছু অফিসারকে। রাত এগারোটা নাগাদ ওই বাহিনী হাওড়া স্টেশনে হানা দেয়, একুশ নম্বর প্ল্যাটফর্মে। অভিযানে বাবু ধরা পড়লেও শাহিন চম্পট দেওয়ায় গোয়েন্দা-কর্তারা কিছুটা আফশোস করছেন। “ওকে হাতে পেলে তদন্তে আরও সুবিধে হতো। হয়ত পাচার হওয়া আরও কিছু মেয়ের সন্ধান মিলত।” আক্ষেপ এক অফিসারের।
বাবু-মুন্নার দল কারবার চালাত কী ভাবে? ধৃতদের জেরা করে তদন্তকারীরা জেনেছেন, চাকরি দেওয়ার নাম করে বনগাঁ-বসিরহাট-গাইঘাটা-ঘোজাডাঙা সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশি মেয়েদের এ দেশে নিয়ে আসত বাবু ও শাহিন। সীমান্ত অঞ্চলে তাঁদের রাখা হতো মনিরুলের মতো কিছু ‘এজেন্ট’-এর আস্তানায়। সেখান থেকে তাদের পাচার করা হতো ভিন্ রাজ্যে। ডিআইজি সিআইডি (স্পেশ্যাল) শঙ্কর চক্রবর্তী এ দিন বলেন, “এরা মৃলত বাংলাদেশ থেকে মেয়েদের এনে পুণে-আমদাবাদ-মুম্বই-দিল্লিতে পাঠাচ্ছিল। বেশ কয়েক বছর ধরে চক্রটি সক্রিয়। চক্রের ক’জন এখনও পলাতক। তাদের খোঁজ চলছে।”
ধৃতদের এ দিন হাওড়া আদালতে তোলা হলে বিচারক বাবু ও মনিরুলকে পুলিশি হেফাজতে পাঠান। মুন্নার জেল হেফাজত হয়েছে। উদ্ধার হওয়া মেয়েদের রাখা হয়েছে সরকারি হোমে।
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.