জঙ্গি শ্রমিক আন্দোলনে বন্ধ বাণিজ্য
লদিয়ায় এবিজি-র পর এ বার উত্তর ২৪ পরগনার ঘোজাডাঙার আন্তর্জাতিক চেকপোস্ট। ফের জঙ্গিপনার অভিযোগ উঠল শ্রমিক সংগঠনের বিরুদ্ধে। হলদিয়ায় অভিযুক্ত ছিল তৃণমূল কংগ্রেসের শ্রমিক সংগঠন (আইএনটিটিইউসি)। আর ঘোজাডাঙার ক্ষেত্রে আইএনটিটিইউসি-র সঙ্গে হাত মিলিয়েছে আইএনটিইউসি এবং সিটু-ও। রফতানি ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, ওই আন্দোলনের জেরে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের ওই এলাকা দিয়ে ১৯ জানুয়ারি থেকে পণ্য যাতায়াত বন্ধ। প্রতিদিন পাঁচ কোটি টাকার ব্যবসা মার খাচ্ছে বলে সরকারি সূত্রের দাবি।
ব্যবসায়ীদের আরও দাবি, গত দু’সপ্তাহে ৭০ কোটি টাকার ব্যবসায়িক ক্ষতি হলেও প্রশাসনের হেলদোল নেই। রফতানিকারী সংস্থা কিংবা ক্লিয়ারিং এজেন্টরা সরকারের দ্বারস্থ হলেও অচলাবস্থা কাটাতে উদ্যোগী হয়নি কেউ।
ঘোজাডাঙা আর্ন্তজাতিক চেক পোস্ট (আইসিপি) দিয়ে বাণিজ্য বন্ধ কেন? শুল্ক বিভাগ সূত্রে খবর, ঘোজাডাঙা স্থল-বন্দর দিয়ে বড় লরি (১০ চাকা বা তার বেশি) যাতায়াত করা নিয়ে রফতানিকারকদের সঙ্গে শ্রমিক সংগঠনের বিরোধের জেরেই বন্ধ হয়ে গিয়েছে যাবতীয় কারবার। ওই সীমান্ত দিয়ে মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, হিমাচলপ্রদেশ, অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে ফল, সব্জি, কাঁচা ও শুকনো লঙ্কা এবং নানা ধরনের মাছ বাংলাদেশে রফতানি হয়। সে জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বড় লরিতে পণ্য আসে। কিন্তু সেই বড় লরি ঘোজাডাঙা সীমান্ত দিয়ে পারাপারে আপত্তি তুলেছে আইএনটিটিইউসি, আইএনটিইউসি এবং সিটু। আগে বড় লরি থেকে ছোট লরিতে পণ্য তুলে সীমান্তের ওপারে পাঠানো হত। তাতে যুক্ত ছিলেন বহু শ্রমিক। এখন বড় লরিতেই পণ্য বাংলাদেশে পাঠাতে উদ্যোগী হয়েছেন ব্যবসায়ীরা। ঘোজাডাঙা সীমান্তের কাছে কয়েকটি জায়গায় বড় লরি থেকে পণ্য নামিয়ে ছোট লরিতে তুলতে তাদের বাধ্য করা হচ্ছে বলে রফতানিকারকদের দাবি। অভিযোগের আঙুল শ্রমিক সংগঠনগুলির দিকে।
ঘোজাডাঙার সেই শুনশান সেতু। —নিজস্ব চিত্র
কিন্তু ছোট লরিতে মাল পাঠাতে আপত্তি কোথায়? রফতানিকারকদের অভিযোগ, মাঝপথে পণ্য নামানো-ওঠানোর ফলে পচনশীল বহু সামগ্রী নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। একাধিক বার পণ্য ওঠানো-নামানোতে অতিরিক্ত খরচও হচ্ছে। নজরদারির অভাবে মাঝপথে মাল এক লরি থেকে অন্য লরিতে তোলার সময়ে বহু পণ্য চুরিও হয়ে যায় বলে অভিযোগ রফতানিকারীদের। সম্প্রতি বাংলাদেশের রফতানিকারীরা ছোট লরিতে পণ্য পরিবহণে আপত্তি তোলেন। ফলে, ভারতীয় রফতানিকারকেরা ১০ চাকার লরিতে পণ্য পরিবহণের কাজ শুরু করতে উদ্যোগী হন। আর তখনই শ্রমিক সংগঠনগুলি বাধা দিতে শুরু করে বলে অভিযোগ। ঘোজাডাঙার ১০ কিলোমিটার আগে সংগ্রামপুর এবং ঢ্যামঢেমিয়া এলাকায় আইএনটিটিইউসি এবং আইএনটিইউসি শক্তিশালী। ঘোজাডাঙা সীমান্তে শক্তিশালী সিটু। বড় লরি আটকে মারধরের অভিযোগ উঠেছে আইএনটিটিইউসি-র বিরুদ্ধে।
ঘোজাডাঙা ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরওয়ার্ডিং এজেন্ট এমপ্লয়িজ কার্গো ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের তরফে রাজ্যের কাছে চিঠি দিয়ে কারবার চালুর জন্য উদ্যোগী হতে বলা হয়েছে। সংগঠনের সহ-সভাপতি গোলাম মোস্তাফার দাবি, শ্রমিকদের জুলুমবাজির জন্য রফতানি বন্ধ হয়ে গেল। যদি বড় লরিতে পণ্য নিয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকে তা হলে সরকার বেশি রাজস্ব পাবে। বাংলাদেশে বেশি পণ্য পাঠানো যাবে। পচনশীল বস্তুও অবাধে পাঠানো যাবে। কিন্তু জুলুমবাজির জন্য রফতানি এবং শ্রমিকদের আয় দুটোই বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
ঘোজাডাঙার দায়িত্বপ্রাপ্ত শুল্ক বিভাগের অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার অর্জুনকুমার জাঠ জানিয়েছেন, খুবই খারাপ অবস্থা। কোটি কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। তাঁর দাবি, যা হচ্ছে, তা শুল্ক বিভাগের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। রফতানিকারী সংস্থাগুলির সঙ্গে শ্রমিক সংগঠনের সমস্যা হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসনকেই যা করার করতে হবে। শুল্ক বিভাগের বক্তব্যের সঙ্গে উত্তর ২৪ পরগনার জেলাশাসক সঞ্জয় বনশল একমত নন। তাঁর দাবি, বসিরহাটের মহকুমাশাসক উভয় পক্ষকে নিয়ে বৈঠকে বলেছিলেন। নিজেরা সমস্যা মিটিয়ে নিতে চেয়ে তারা কয়েক দিন সময় চায়। তার পরে আর তারা প্রশাসনের কাছে আসেনি। শুল্ক দফতরের এ নিয়ে উদ্যোগী হওয়া উচিত। শুল্ক দফতর সূত্রে বলা হয়েছে, সীমান্তের ১০ কিলোমিটার আগেই যদি কেউ পণ্য নামিয়ে নেয়, তার দায়িত্ব তারা নেবে না।
প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তার বিরুদ্ধে সম্প্রতি বসিরহাটের ইছামতী সেতুর কাছে বিক্ষোভ দেখায় দুটি লরি সমিতি, ট্রান্সপোর্ট ইউনিয়ন, ঘোজাডাঙা ক্লিয়ারিং ফরওয়ার্ডিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের যৌথ ইন্দো-বাংলা বৈদেশিক বাণিজ্য সমন্বয় কমিটি। কমিটির পক্ষে গোপাল সরকার বলেন, “আমরা চাই ছোট-বড় সব ধরনের লরি সরাসরি পণ্য নিয়ে বাংলাদেশের ভোমরাতে যাক। বাণিজ্য বন্ধে বহু মানুষের রুজি-রুটিতে টান পড়েছে।”
আমদানি ও রফতানি ব্যবসা ঘোজাডাঙার প্রাণ। দিনে গড়ে ২৫০-৩০০ লরি যাতায়াত করে। বেশ কয়েকটি পার্কিং জোন তৈরি হয়েছে। কয়েক হাজার মানুষ পণ্য ওঠানো-নামানোর কাজে যুক্ত। গাড়ি বন্ধের ফলে চালক, খালাসি এবং ব্যবসার সঙ্গে যুক্তদেরও দেখা নেই। ফলে ওল্ড সাতক্ষীরা রাস্তার দু’পাশের চা, পানবিড়ির দোকান, হোটেল সব বন্ধ।
রাজস্বের ক্ষতি করে এমন জঙ্গি আন্দোলন কেন? শ্রমিক নেতাদের দাবি, বড় লরিতে মাল পাঠানো হলে মাল ওঠানো-নামানোর কাজে যুক্ত শ্রমিকদের স্বার্থে ঘা লাগবে। তৃণমূলের বসিরহাট (দক্ষিণ) কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত তৃণমূল নেতা নারায়ণ গোস্বামী। তিনি জানিয়েছেন, প্রায় ২ হাজার শ্রমিক মাঝপথে পণ্য ওঠানো-নামানোর কাজের সঙ্গে যুক্ত। এটা তাঁদের রুজি-রুটির ব্যাপার। বৈদেশিক বাণিজ্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনই স্থানীয়দের স্বার্থও দেখতে হবে। কারণ, এখানে তো অন্য শিল্প নেই। জুলুমবাজির অভিযোগ মানতে চাননি তিনি।
আইএনটিটিইউসি-র মহকুমা সম্পাদক কৌশিক দত্তর মতে, আগে ঘোজাডাঙা ও মেরুদণ্ডী সেতুর উন্নতি দরকার। কোথাও দু’লেনের রাস্তা নেই। পুরনো ব্যবস্থা (ছোট লরিতে মাঝপথে পণ্য নামানো ওঠানো) চালু রেখে পরিকাঠামোর উন্নতি করতে হবে। না হলে হঠাৎ করে শ্রমিকদের পেটে লাথি মারলে আইন-শৃঙ্খলার অবনতি হতে পারে।
সিটু ইউনিয়নের ঘোজাডাঙা অঞ্চলের সভাপতি আলি বৈদ্য জানিয়েছেন, সীমান্ত বাণিজ্য শুরুর সময়ে স্থানীয় মানুষকে কাজ দেওয়া হয়েছিল। এখন হঠাৎ করে এক পক্ষ আলোচনা ছাড়াই যে ভাবে বাণিজ্য বন্ধ করে দিল, তা সমর্থনযোগ্য নয়। এত দিন যে ব্যবস্থা ছিল, তা সেতু সংস্কার না হওয়ার অভিযোগ প্রশাসন মানতে চায়নি। তাদের দাবি, সেতু মেরামত হয়ে গিয়েছে। বাণিজ্য বন্ধ থাকায় সেই সেতু এখন শুনশান। যার উপর দিয়ে দিনে ২৫০ থেকে ৩০০ পণ্যবোঝাই লরি যাতায়াত করত।
হলদিয়ার ছায়া এ বার ঘোজাডাঙায় সমস্যার সীমান্ত
বাংলাদেশে পণ্য সরবরাহের পদ্ধতি নিয়ে বিরোধ রফতানিকারী ও শ্রমিকদের।
বড় থেকে ছোট লরিতে মাল তোলেন শ্রমিকরা। সেই মাল যায় বাংলাদেশে।
লরি বদলালে ক্ষতি, তাই সরাসরি বড় লরিতে পণ্য পরিবহণ চান ব্যবসায়ীরা।
শ্রমিকদের দাবি, লরি বদল বন্ধ হলে তাঁদের রোজগার কমবে।
ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, শ্রমিক-জুলুমে দু’সপ্তাহে ক্ষতি প্রায় ৭০ কোটি টাকা।
জুলুমবাজির এই অভিযোগ মানতে নারাজ শ্রমিকরা।
রাজ্য সরকারের দ্বারস্থ রফতানিকারীরা। অভিযোগ, প্রশাসন নিষ্ক্রিয়।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.