|
|
|
|
|
|
রবিবাসরীয় প্রবন্ধ ২...
কত অজানারে |
|
|
শংকর
|
আমার জন্মের পর মা’কে দেখতে এসে অনেকে বললেন, মা এত ফর্সা, আর ছেলে কেন এত কালো! তার পর এক দিন আমার দাদু এলেন। নাতির মুখ দেখে ছোট্ট এক কৌটো জার্মান পাউডার উপহার দিয়ে মেয়েকে বললেন, দুঃখ করিস না, তোর ছেলে আশু মুখুজ্যে হয়ে তোর সমস্ত দুঃখ মুছে দেবে। স্যর আশুতোষের কথা তখন বাংলার ঘরে ঘরে। তিনি শুধু হাইকোর্টের জজ নন, ভারতবিদিত অঙ্কশাস্ত্রবিদ। এক বার অঙ্কের পরীক্ষায় হাওড়া বিবেকানন্দ ইস্কুলে মা’কে বললাম, অন্তত বিরাশি পাব। কিন্তু রেজাল্ট যখন বের হল, দেখা গেল ২২ পেয়েছি! এর পর অনেক কষ্টে তুলি ও রং কিনে এক অঙ্কন প্রতিযোগিতায় নাম দিলাম। সেখানে একটা মানুষের মুখ আঁকতে বলল, আমি অজ্ঞাত কারণে একটা পেঁপে এঁকে চলে এলাম। শেষ চেষ্টা গানে। বেলুড় মঠে সমবেত সংগীতের জন্য ছাত্রদের আমন্ত্রণ ছিল, সেখানেও বেসুরো কণ্ঠের জন্য দলে স্থান পাওয়া গেল না। কান্নাকাটি করায় ভক্তদের জুতোচুরি বন্ধের কাজ পেলাম উৎসবের সময়। এই কাজে বিপুল নাম ও অভিজ্ঞতা হল। কিন্তু মায়ের প্রত্যাশা পূরণ করতে না পেরে ভীষণ দুঃখ।
আরও দুঃখ তোলা ছিল। বাবার অকালমৃত্যু। আটটি নাবালক ভাই-বোনের সংসার। মা মুখে কিছু বলেন না, কিন্তু বুঝতে পারি, এই বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য আমার মুখের দিকেই তাকিয়ে আছেন। সে এক কঠিন সংগ্রাম। চাকরির খোঁজে অতি অল্প বয়সে দ্রুতলিখন ও টাইপরাইটিং শিক্ষা এবং এক সময় ভাগ্যক্রমে হাইকোর্টে ইংরেজ ব্যারিস্টার নোয়েল ফ্রেডরিক বারওয়েল মহোদয়ের চেম্বারে চাকরি, মাইনে আশি টাকা। উকিলের যেমন মুহুরি, ব্যারিস্টারের তেমন বাবু।
বিন্দুমাত্র ইংরিজি না-জেনে কী ভাবে সায়েবের প্রিয় বাবু হলাম, তার বর্ণনা ‘কত অজানারে’-তে আছে। বারওয়েল সায়েবের তখন পড়তি অবস্থা। কয়েক জন স্বার্থপর ইংরেজ সায়েবের ভারতবিরোধী কাজের প্রকাশ্য প্রতিবাদ করায় ডালহৌসিপাড়ার ইংরেজ বণিকরা তাঁকে প্রায় পরিত্যাগ করেছে। সেই সঙ্গে শরীরও ভাল নয়। তবু সে এক অপূর্ব অভিজ্ঞতা, পরম স্নেহে এবং আশ্চর্য নিপুণতায় তিনি অপরিণতবয়স্ক বালকের চোখ খুলে দিলেন, আমার সঙ্গে ইংরিজি সাহিত্যের পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমার যেন নবজন্ম হল। দক্ষিণ ভারতে একটা মামলা করতে যাওয়ার আগে আমাকে সস্নেহে অত্যন্ত ধীর ভাবে বললেন, মাই ডিয়ার বয়, কখনও ভুলো না ইউ আর অ্যান একসেপ্শনাল পার্সন। আমি হয়তো নিজের চোখে দেখে যাব না, কিন্তু তুমি কখনও ভুলবে না যে ইউ আর অ্যান একসেপ্শনাল পার্সন। সেই আমাদের শেষ দেখা, মামলা করতে করতেই তাঁর হার্ট অ্যাটাক ও শেষ নিশ্বাস ত্যাগ। |
|
শোকের ঢেউ কমলে মনে হল, এই দয়াহীন মায়াহীন পৃথিবীতে এমন এক জন ছিলেন, যিনি হাওড়ার কানাগলির পরিচয়হীন, বিত্তহীন, শিক্ষাহীন এক মানুষের মধ্যে মহত্তর এক মানুষের সন্ধান পেয়ে তাকে সজাগ করে দিতে চেয়েছিলেন। কী করে এই আশ্চর্য মানুষটিকে শ্রদ্ধা জানানো যায়? মর্মর মূর্তি বা বার লাইব্রেরিতে তৈলচিত্র স্থাপন আমার সাধ্যের বাইরে। এক সময় আশঙ্কা হল, আদালতি পাড়ায় এক আশ্চর্য বিদেশির যে অমৃতসান্নিধ্য লাভ করেছিলাম, তা আমার নিজেরই মনে থাকবে না। নিজেকেই এক দিন যাতে অবিশ্বাস না হয়, তার জন্য কিছু লিখে রাখা প্রয়োজন। তখন আমার পেন ছিল না, কিন্তু দোয়াত-কলম ছিল, কাগজও ছিল ছিল না টেবিল-চেয়ার, ছিল না বিদ্যুৎ। চৌধুরীবাগানে আমাদের পাশের বাড়িতে আলো ছিল, টেবিল ছিল। সেই বাড়ির বউদি সস্নেহে আমাকে তাঁদের বাইরের ঘরের টেবিল-চেয়ার ব্যবহারের অনুমতি দিলেন। আর ছিল মধ্যরাতের হ্যারিকেন লণ্ঠন কাজ শুরু হয়ে গেল।
তখন ডালহৌসি পাড়ায় বেঙ্গল চেম্বারে কাজ করতাম। সেখানে কেরানিমহলে সাহিত্যচর্চার রেওয়াজ। এর মধ্যমণি ভবানী ঘোষ এক বিকেলে তাঁর বন্ধু খ্যাতনামা রূপদর্শী-র সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন। কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউসে লম্বা আড্ডা হল। রূপদর্শীর খিদিরপুরের জাহাজিয়াদের কথা উঠল। আমি বললাম, আমিও এমন এক কর্মহীন জাহাজিয়াকে চিনতাম। গল্পটা শুনে রূপদর্শী বললেন, হয় গল্পগুলো আপনি নিজেই লিখুন, না-হয় আমাকে দিন। জানালাম, কয়েকটা লিখে ফেলেছি। রূপদর্শীর উপদেশেই, বর্মন স্ট্রিটের আনন্দবাজার দফতরে ‘দেশ’ পত্রিকার অন্যতম প্রধান সাগরময় ঘোষের সঙ্গে দেখা। বললেন, ‘পাণ্ডুলিপি রেখে যান, কিন্তু দু’মাস জ্বালাতন করবেন না।’ নির্ধারিত দু’মাস খোঁজ করিনি, তার পরেও কয়েক সপ্তাহ বাদ দিয়ে আবার বর্মন স্ট্রিটে হাজির হলাম। সাগরবাবু বললেন, ‘আপনি তো বেশ লোক মশাই, ম্যানুস্ক্রিপ্ট-টা দিয়েছেন অথচ ঠিকানা দেননি।’ ঠিকানা দেওয়ার কথা সত্যিই আমার মাথায় ঢোকেনি। সাগরবাবু বললেন, ‘এই লেখাটা অবশ্যই আমি ছাপব, এ বার আপনি ঝটপট বাকিটা লিখে ফেলুন।’
অসম্ভব ব্যাপার ঘটে গেল। প্রথম প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই আমি লেখক বনে গেলাম। এক দিন জানাশোনা এক ভদ্রলোক অটোগ্রাফও নিয়ে গেলেন।
কিছু বিপদও ঘটল। এক কর্তাব্যক্তি ডেকে পাঠিয়ে বললেন, ‘আমার জানাশোনা অমুক প্রকাশকের অমুক বাবুকে আপনার বইটা, এখনই যান, সই করে আসুন।’ আমার লেখক-ঔদ্ধত্য না মাতামহের বিদ্রোহী ভাব মনের মধ্যে জেগে উঠল (তিনি সায়েবি সদাগরি অফিসে ভাল কাজ করতেন, এক ছোকরা ইংরেজ তাঁর চেয়ারে পা দিয়েছিল বলে ঠাস করে চড় মারেন), বললাম, ‘একটু ভেবে দেখতে হবে।’ কর্তাব্যক্তি এমনই বিরক্ত হলেন যে তার পর বহু বছর আমাকে চিনতেই পারতেন না। শুভানুধ্যায়ীরা চিন্তিত হলেন, আমার সাহিত্য-ভবিষ্যৎটাই না নষ্ট হয়ে যায়। বাংলার নবাগত লেখকদের ভাগ্য যে স্থান থেকে নির্ধারিত হত, তাঁরা ঘোষণা করলেন, ‘এই লোকটি জাত লেখক নয়, ওয়ান বুক অথর, অর্থাৎ এর ভবিষ্যৎ বলে কিছু নেই।’
চরম দারিদ্রের সঙ্গে তখনও প্রবল লড়াই চলেছে কেরানিগিরি, ওভারটাইম, গোটা কয়েক প্রাইভেট টিউশন, রাস্তার টিউবওয়েল থেকে মধ্য রাত্রে বাড়ির জন্য জল তুলে আনা। চরম অভিমানে তখন মন্দিরে গিয়ে মা কালীকে বলছি আমি খ্যাতি চাই না, অর্থ চাই না, আমাকে কেবল ওয়ান বুক অথরের গ্লানি থেকে মুক্ত করো।
সমকালের লেখকদের স্নেহ ভালবাসা এবং উপদেশ পেয়ে কিন্তু ধন্য হয়েছিলাম। এক জন ধারাবাহিক রচনাটির নাম দান করলেন ‘কত অজানারে’। আরও এক জন প্রথম পরিচ্ছেদের প্রথম লাইনটি লিখে দিলেন এবং আর এক জন শুধু প্রকাশক খুঁজে দিলেন তা নয়, ‘লেখকের নিবেদন’ অংশটি নিজের কলমে ঠিক করে দিলেন। এক প্রবীণ সম্পাদককে একখানা বই দিতে গিয়েছিলাম, তিনি নিলেন, কিন্তু যেমনি শুনলেন আমার প্রথম সৃষ্টি, অমনি ফতুয়া থেকে সাড়ে চার টাকা আমার হাতে গুঁজে দিয়ে বললেন, নতুন লেখকের নতুন বই তিনি বিনামূল্যে কখনও গ্রহণ করেন না।
সেই যে শুরু হল সাহিত্যযাত্রা, তার অনেকটাই নিঃসঙ্গতায়, কিছুটা অভিমানে ভরা। ওয়ান বুক অথরের গ্লানি মুছতে সক্ষম হলাম কয়েক বছর পরে ‘চৌরঙ্গী’ দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিক শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে।
তার পর কোনও ক্রমে তো বেঁচে আছি। বঙ্গসরস্বতী হিরের নাকছাবি না দিলেও সাহিত্যের অঙ্গন থেকে বিতাড়িত করেননি। প্রথম বই নিয়ে আজও যখন ভাবি, তখন একটা গল্প মনে পড়ে যায়। বারওয়েল সায়েব রসিকতা করে বলতেন, ‘পরের জন্মে বাঙালি মেয়ে বিয়ে করব। সুন্দরী বাঙালি মেয়েরা পদ্মলোচনা বলে নয়! আমার নজর বাঙালি শাশুড়ির দিকে, সারা দুনিয়ায় তাঁদের তুলনা নেই। দশ টাকা দিয়ে প্রণাম করলে তাঁরা জামাইকে কুড়ি টাকা ফেরত দেন। আমি বিয়ের পরেই লাখ টাকা ধার করে শ্বশুরবাড়ি যাব এবং বিকেলে লাখ টাকা শোধ করে দিয়ে বাকি জীবন সুখে কাটিয়ে দেব।’ প্রথমে ভেবেছিলাম এটা রসিকতা, পরে বুঝলাম এটাই সত্য! আমি এক জনকে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে নিজেই শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে উঠলাম। এখন দুঃখ একটাই! যদি আমি চেষ্টা করে আমার প্রথম রচনায় তাঁকে আরও শ্রদ্ধা জানাতে পারতাম, তা হলে আরও কত ভালবাসা ফেরত পেতাম কে জানে? |
|
|
|
|
|