মানুষ আর মানুষ। স্বামী বিবেকানন্দের হৃদয় জুড়ে ছিল মানুষ। মানুষই ভগবানের শ্রেষ্ঠ আধার। তাঁর মতে, ঠিক ঠিক মানবসেবা করতে পারলে মুক্তি-করকলায়তে। সেবা এখানে পূজায় রূপান্তরিত। মানবসেবাকেই তিনি বলেন, ঈশ্বরের পূজা। সে জন্য এই সন্ন্যাসী নররূপী নারায়ণের সেবায় উৎসর্গীকৃতপ্রাণ। সমগ্র বিশ্বের মানুষ এক ঈশ্বরের সন্তানএই বোধ জাগরণেই তাঁর আত্মবলিদান!
বিবেকানন্দ চেয়েছিলেন, মানুষের অন্তর্নিহিত শক্তির উদ্বোধন। যে শক্তির জাগরণে উত্তরণ হয় পূর্ণত্বের দিকে। প্রকাশ ও বিকাশ হয় আত্মশক্তির। এই শক্তি উন্মোচনের দিশারি হয়ে তাঁর আহ্বান , ‘‘তোমরা ঈশ্বরের সন্তান, অমৃতের অধিকারী, পবিত্র ও পূর্ণ। তুমি নিজেকে দুর্বল বল কী করে? ওঠো, সাহসী হও, বীর্যবান হও।...জেনে রাখ, তুমি তোমার অদৃষ্টের সৃষ্টিকর্তা। তুমি যে শক্তি বা সাহায্য চাও তা তোমার ভিতরেই রয়েছে।’’ আমাদের আত্মবিশ্বাস বলীয়ান করে তোলেন তিনি। সুপ্ত, নিদ্রিত মানবকে জাগরিত করেন। অনুভব করেন আমাদের দুর্বলতা, কাপুরুষতা। তিনি চেয়েছিলেন ‘আশিষ্ট, দ্রঢ়িষ্ট, বলিষ্ঠ, মেধাবী’ মানুষ। যারা দেশ ও দশের সেবায় বলিপ্রদত্ত। যেখানে নিষ্ঠা, সততা আর আত্মনির্ভরতায় উৎসর্গীকৃত জীবন। স্বামীজির কথায়, ‘‘মানুষ চাই, আর সব হয়ে যাবে।...কে কোথায় দেখেছে, টাকায় মানুষ তৈরী করে? সর্বত্র মানুষই টাকা তৈরী করে।’’ মানুষের স্বরূপ উন্মোচন করতে চেয়েছিলেন তিনি। অন্তরের সুপ্ত দিব্যভাব জাগ্রত হোক। যার দ্বারা সুবৃত্তির প্রকাশ ঘটবে। মননে আসবে আধ্যাত্মিক চেতনা। কর্মে আসবে প্রেরণা। নব চেতনার হবে অভ্যুদয়।
স্বামীজি বিশ্বাস করতেন মানবের অনন্ত সম্ভাবনার কথাঅফুরন্ত আত্মশক্তির কথা। এক বক্তৃতায় তিনি বলেছেন: ‘‘জনসাধারণকে চিরকাল বলা হয়েছেতোমরা মানুষ নও। শত শত শতাব্দী ধরে তাদের এ ভাবে ভয় দেখানো হয়েছেক্রমশ তারা সত্যসত্যই পশুস্তরে নেমে গিয়েছে। তাদের কখনও আত্মতত্ত্ব শুনতে দেওয়া হয়নি। তারা এখন আত্মতত্ত্ব শ্রবণ করুক, তারা জানুক যে, তাদের মধ্যেনিম্নতম ব্যক্তির হৃদয়েও আত্মা আছেন, সেই আত্মার জন্ম নেই, মৃত্যু নেই।...তিনি অবিনাশী অনাদি অনন্ত শুদ্ধস্বরূপ সর্বশক্তিমান ও সর্বব্যাপী।’’ আত্মশক্তির জাগরণেই সমস্ত দুর্বলতার অপসারণ। বলতেন, ‘‘চাই অগ্নিময় আত্মবিশ্বাস, উন্নতিলাভের এই একমাত্র উপায়। যদি তোমার আত্মবিশ্বাস না থাকে, তবে কিছুই হবে না।’’ মানবজীবনের সব থেকে বড় অলঙ্কার আত্মবিশ্বাস। এই নিজের ওপর বিশ্বাসেই জাগ্রত হয় আত্মচৈতন্য। উদ্যমহীন মানুষকে তিনি আত্মশক্তিতে ভরপুর করে তুলতে চেয়েছিলেন। দুর্বলকেও দিয়েছিলেন প্রেরণাউজ্জীবনের স্বপ্ন! মানুষ জানুক, সে আত্মিক শক্তির অধিকারী। |
আজ স্বামী বিবেকানন্দের ১৫১তম জন্মতিথি |
বিবেকানন্দের প্রাণস্পন্দিত আহ্বানে যে উদ্বুদ্ধ ভারতবাসীএ কথা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথও স্বীকার করেছেন এ ভাবে, ‘‘তাঁর (বিবেকানন্দের) বাণী মানুষকে যখনই সম্মান দিয়েছে, তখনই শক্তি দিয়েছে। সেই শক্তির পথ কেবল একঝোঁকা নয়। তা কোনও দৈহিক প্রক্রিয়ার পুনরাবৃত্তির মধ্যে পর্যবসিত নয়, তা মানুষের প্রাণ-মনকে বিচিত্র ভাবে প্রাণবান করেছে। বাংলাদেশের যুবকদের মধ্যে যে-সব দুঃসাহসিক অধ্যবসায়ের পরিচয় পাই, তার মূলে আছে বিবেকানন্দের সেই বাণী যা মানুষের আত্মাকে ডেকেছে, আঙুলকে নয়।’’ আত্মবিস্মৃত মানবের তিনি আশাভরসা ও প্রেরণাদাতা। নব প্রাণশক্তিতে উজ্জীবিত করার আশ্রয়স্থল।
স্বামীজি মানুষকে মানুষের পাশে দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন, যাঁরা হবেন পরহিতব্রতে নিবেদিত। হৃদয়বৃত্তির রুদ্ধদ্বার হবে উন্মোচিত। সেই সব ভাবী দেশসেবকের প্রতি স্বামীজির আহ্বান: ‘‘তোমরা কি প্রাণে প্রাণে অনুভব করছ, কোটি কোটি লোক অনাহারে মরছে? কোটি কোটি লোক শত শত শতাব্দী ধরে অর্ধাশনে দিন কাটাচ্ছে? তোমরা কি এই সব ভেবে অস্থির হয়েছ, তোমার সুখনিদ্রায় কি ব্যাঘাত ঘটায়?...ওঠো, জাগো, যত দিন না লক্ষ্যে পৌঁছাচ্ছ, থেমো না। দীর্ঘ রজনী প্রভাত প্রায়। দিনের আলো দেখা যাচ্ছে। মহাতরঙ্গ উঠেছে। কিছুতেই তার বেগ রোধ করতে পারবে না।...আর ভয় কোরো না, সবচেয়ে গুরুতর পাপভয়।’’ তিনি আমাদের নির্ভয় হতে প্রেরণা দেন। অভয় দেন, সাহস জোগান প্রাণে। উৎসাহ দেন মনে। জীবনে এগিয়ে যাওয়ার পথে আসে অনুপ্রেরণা। অস্থির এই বর্তমান সময়েও স্বামীজি আমাদের পাশে আছেন। তাঁর কথায় ‘‘যতদিন না মানুষ চৈতন্যের দিকে অগ্রসর হয়, ততদিন আমি অনুপ্রেরণা দিয়ে যাব।’’
মানবপ্রেমী বিবেকানন্দ মানুষ চেয়েছিলেন। যে মানুষ হবে সত্যিকারের মানুষচরিত্রবান, হৃদয়বান। বলতেন, ‘বি অ্যান্ড মেক’। নিজে হও ও অপরকে তৈরি করো। আজকের দিনে এমন মানুষেরই বড় অভাব। প্রয়োজন আদর্শ মানবেরযাঁরা হবেন মানবাত্মার পূজারি, স্বামীজির মতো। এ প্রসঙ্গে বিপ্লবী হেমচন্দ্র ঘোষ এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন এ ভাবে: ‘‘এই অসাধারণ মানুষটিকে আমি দেখেছি। জীবনে আর দ্বিতীয় একজন মানুষকেও দেখিনি, যাকে স্বামীজির পাশে দাঁড় করাতে পারি। বিবেকানন্দ আমার চোখে পৃথিবীর সর্বকালের ইতিহাসে একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষসর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ।’’ মানবতার পূজারি বিবেকানন্দের ধ্যান-গহ্বর থেকে উত্থিত মানবপ্রেম। আর্ত-অবহেলিত অসহায়-অজ্ঞ মানুষের দুঃখমোচন করাই তাঁর লক্ষ্য। দীন-দরিদ্র নিপীড়িত-নির্যাতিত মানুষকে তিনি আহ্বান জানান ‘ভাই’ বলে। তাদের সেবায় ও মর্যাদাদানে নিজেকে নিয়োজিত রাখাই তাঁর ব্রত। পদদলিত মানুষের প্রতি এই নিষ্কাম প্রেম দেখে বিদগ্ধজনেরা তাঁকে বলেন ‘মানবতাবাদী’। মানুষই সেখানে সেবার শীর্ষে বিরাজিত। মানবসেবাই তাঁর কাছে মানবিকতা। আজকে বহুবাদের মধ্যে মানবতাবাদের বিশেষ প্রয়োজন। তাঁর এই মানবতাবাদ যদি জগতে প্রতিষ্ঠিত হত, তা হলে অনেক বাদ আরও পরিশুদ্ধ হতে পারত। সব বাদের মধ্যমণি হওয়া উচিত মানবতাবাদের। এবং সমস্ত বাদীর পরিচিত হওয়া উচিত মানবতাবাদী বিবেকানন্দের দর্শনের সঙ্গে। |