এক কর্মীর কার্যত অসহায় মৃত্যু দেখিয়ে দিল কলকাতা বিমানবন্দরে এয়ার ইন্ডিয়ার চিকিৎসা পরিষেবার বেহাল অবস্থা। বুধবার দুপুরে ডিউটি শেষ হওয়ার মুখে হঠাৎ অসুস্থ বোধ করছিলেন এয়ার ইন্ডিয়ার এক বিমানকর্মী। সঙ্গে সঙ্গেই বিমানবন্দরের চিকিৎসা কেন্দ্রের দিকে রওনা হন তিনি। যাওয়ার পথে টার্মিনাল থেকে বেশ কিছুটা দূরে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। সহকর্মীরা ধরাধরি করে কোনও মতে বেশ কিছুটা দূরের চিকিৎসা কেন্দ্র পর্যন্ত নিয়ে গেলেও শেষরক্ষা হল না। দেখা মিলল না দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসকের। বারংবার ফোন করে সাড়াও পাওয়া গেল না তাঁর। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন সেখানকার ফার্মাসিস্ট। স্থানীয় এক নার্সিংহোমে পৌঁছে জানা যায়, পথেই মৃত্যু হয়েছে ওই বিমানকর্মীর। হেনস্থার শেষ নয় এখানেও। চিকিৎসক না থাকায় লেখা হল না ওই কর্মীর ডেথ সার্টিফিকেটই। তাই বিমানবন্দর থানা চত্বরে মৃতদেহ পড়ে রইল সারা রাত। শেষে বৃহস্পতিবার সকালে মৃতদেহ চালান হয়ে গেল মর্গে ময়না-তদন্তের জন্য।
বিমানবন্দর সূত্রের খবর, কার্যত বিনা চিকিৎসায় মারা যাওয়া ওই কর্মীর নাম তালাগানা দুর্গা রাও (৪৭)। আদতে তামিলনাড়ুর বাসিন্দা তালাগানা বহুদিন ধরে কলকাতায় কর্মরত ছিলেন। ইঞ্জিনিয়ারদের সহকারী হিসেবে কাজ করতেন তিনি। থাকতেন দমদমের মল রোডে সংস্থার কোয়ার্টার্সে। এয়ার ইন্ডিয়া সূত্রের খবর, বুধবার দুপুর সওয়া ১টা থেকে রাত ৯টা ২০ মিনিট পর্যন্ত তাঁর ডিউটি ছিল। ওই সময়েই ঘটনাটি ঘটে।
মৃতের সহকর্মীদের আক্ষেপ, বিমানবন্দরের ভিতরে ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ওই চিকিৎসা কেন্দ্রে সেই সময়ে চিকিৎসক থাকলে তালগানার চিকিৎসা যেমন করা যেত, তেমনই সারা রাত তাঁর মৃতদেহ নিয়ে এমন অসহায় ভাবে থানার বাইরে বসে থাকতে হত না। বিমানবন্দরের নতুন টার্মিনাল হল এই সে দিন। আশা করা হচ্ছে, বিমানবন্দর দিয়ে যাত্রী চলাচল বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়বে বিমানকর্মীদের সংখ্যাও। কিন্তু চিকিৎসা কেন্দ্রের পরিকাঠামো এমন হলে আরও কোনও বড় বিপর্যয় যে কোনও দিন ঘটে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন কর্মীরা।
বুধবার রাতে কেন কোনও চিকিৎসক ছিলেন না ওই কেন্দ্রে? এয়ার ইন্ডিয়ার পক্ষে জানানো হয়েছে, ওই চিকিৎসা কেন্দ্রে না থাকলেও বিমানবন্দরের টার্মিনালে চিকিৎসক ছিলেন। যেখানে তালাগানা অসুস্থ হয়ে পড়েন, তা টার্মিনাল থেকে অনেকটা দূরে। তাই চিকিৎসক পৌঁছনোর আগেই দুর্গাকে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। বিমানবন্দর সূত্রের খবর, বিমান সংস্থার তরফে এত বড় একটি বিমানবন্দরে বেশ কিছু চিকিৎসা কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকেন এক জন মাত্র চিকিৎসক। কয়েকটি বিভাগে ২৪ ঘণ্টা চিকিৎসক থাকার ব্যবস্থাও নেই।
শুধু চিকিৎসা পরিকাঠামোর অভাবই নয়, তালাগানার সহকর্মীদের অভিযোগ, সারা রাত থানায় দুর্গার দেহ পড়ে থাকার পরেও কর্তা-ব্যক্তিদের কেউ সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেননি। মৃত কর্মীর পরিবারের পাশে এসে দাঁড়াননি কেউ।
প্রায় ১১ ঘণ্টা থানার সামনে, গাড়ির মধ্যে দেহটি পড়ে থাকার পরে বৃহস্পতিবার সকালে সেই মরদেহ পুলিশ পাঠিয়ে দেয় ময়না-তদন্তের জন্য। পরে দেহটি তুলে দেওয়া হয় পরিবারের হাতে।
এক সহকর্মীর কথায়, “বারবার চিকিৎসককে ফোন করেও সাড়া পাওয়া যায়নি। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরে আমাদেরই একটি গাড়িতে চাপিয়ে কাছের একটি নার্সিংহোমে নিয়ে যাওয়া হয় তালাগানাকে। কিন্তু সেখানে চিকিৎসকেরা জানান, ইতিমধ্যেই মারা গিয়েছেন তিনি।” সেখান থেকে ডেথ সার্টিফিকেট দিতে না চাওয়ায় তাঁরা তালাগানার দেহ নিয়ে বিমানবন্দরে ফেরেন। গাড়ির ভিতরে মৃত এক ব্যক্তিকে নিয়ে বিমানবন্দরের ভিতরে ঢোকা যাবে না বুঝে তাঁরা থানায় যান। সহকর্মীদের অভিযোগ, থানায় পৌঁছনোর পরেও ডেথ সার্টিফিকেটের জন্য সেখান থেকে বারবার চিকিৎসককে ফোনে ডাকা হয়। অভিযোগ, তখনও সাড়া মেলেনি তাঁর। রাতেই বিমানবন্দর থানার পুলিশ অস্বাভাবিক মৃত্যুর অভিযোগ রুজু করে।
কর্তৃপক্ষের যুক্তি, বেসরকারি নার্সিংহোম থেকে তালাগানার দেহ বার করে নিয়ে আসা উচিত হয়নি সহকর্মীদের। কারণ, সেই নার্সিংহোমের তরফেই দায়িত্ব নিয়ে সমস্ত ব্যবস্থা করার কথা ছিল। নার্সিংহোম কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, নিয়ম অনুযায়ী কোনও অসুস্থ ব্যক্তি নার্সিংহোমে আনার পথেই যদি মারা যান, তা হলে বিষয়টি স্থানীয় বাগুইআটি থানাকে জানানো হয়। পুলিশ এসে মৃতদেহ নিয়ে যায়। পুলিশ জানিয়েছে, সন্ধ্যার পরে মৃতদেহের দায়িত্ব হাসপাতাল নেয় না। তাই নার্সিংহোম দায়িত্ব নিলেও বিমানবন্দর থানার পরিবর্তে সারা রাত দুর্গার দেহ পড়ে থাকত বাগুইআটি থানায়। |