মেশিনের মুড়ির দাপটে পথে বসেছে হাঁসুপুর
মুড়ির ঘায়ে মিইয়ে গেছে মুড়ি!
হাতে ভাজা মুড়ি প্রায় ফুত্‌কারে উড়িয়ে গত কয়েক বছরে তার জায়গা নিয়েছে মেশিনে ভাজা সস্তার মুড়ি। তাই বাজার হারিয়ে বিপাকে মুর্শিদাবাদের মুড়ি-গ্রাম ধুলিয়ানের হাঁসুপুর।
সাড়ে তিনশো পরিবারের গ্রামে প্রায় সকলেরই রুজির উপায় মুড়ি ভাজা। গ্রাম লাগোয়া আবাদি মাঠ। সেখানে সামান্য ফসল আর এক ফসলি ধানের পরে সম্বত্‌সরের রোজগার বলতে ওই মুড়ি ভাজা। চাষের কাজ করে সন্ধের বাড়তি সময়টুকুও অভাবী হাঁসুপুর বাড়তি আয়ের জন্য উনোনে মাটির তাওয়ায় মুড়ি ভাজে। দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসা এই চেনা নিয়মেই বেঁচে রয়েছে হাঁসুপুর। পরিবার প্রতি মুড়ি ব্যবসায় আয় দৈনিক ২০০-২৫০ টাকা। সেই বাড়া ভাতেই জল ঢেলেছে মেশিনে ভাজা সস্তার মুড়ি।
তুলসীবালা মণ্ডল হাঁসুপুরের এমনই এক মুড়ি-রুজির জোরে বেঁচেবর্তে থাকা মাঝবয়সী মহিলা। দৈনিক প্রায় ২৫ কিলো চালের মুড়ি ভাজেন। প্রায় ঘণ্টা পাঁচেক সময় ধরে মাটির খোলায় ভাজা সেই মুড়ি রাতেই বস্তাবন্দি করেন। পরের দিন তা নিয়ে শহরে আড়তদারের কাছে বেচে আসেন তাঁর স্বামী বা ছেলেরা। তুলসীদেবী বলেন, “দুশো থেকে দুশো কুড়ি টাকার মতো লাভ থাকে এত খাটুনির পর। চালটা আগে নিজের চাষের জমি থেকে পেতাম। এখন বাজার থেকে কিনতে হয়। জ্বালানি হিসেবে বাড়ির চাষের ফসলের পর পড়ে থাকা তুষের আঁটি। কিন্তু বছর তিনেক ধরে মেশিনে ভাজা মুড়িতেই সামান্য আয়টুকুও মুছে গিয়েছে।” বিকোবে নাই বা কেন মেশিনে ভাজা মুড়ির দাম যে কিলো প্রতি ৫-৬ টাকা।
পার্বতী মণ্ডলের আক্ষেপ, “আগে প্রতি কিলো প্রতি ১০-১২ টাকা আসত। এখন প্রতিযোগিতার বাজারে সেটুকুও পাচ্ছি না।” ফলে একে একে বন্ধ হয়েছে গোয়ালার কাছে দিনান্তে নেওয়া দু-পোয়া দুধ, ছেলের স্কুলের খাতা-পেন্সিল, বদলানো যায়নি সাইকেলের তাপ্পি মারা টায়ার।
ছবিটা ঠিক উল্টো স্থানীয় রঘুনাথগঞ্জ বা জঙ্গিপুরে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে মুড়ি ভাজার মেশিন। জনা দল-বারো কর্মী। আর দিনভর সশব্দে চলছে সেই মেশিন। এমনই এক মেশিন মালিক মইনুল শেখ। তিনি বলেন, “আমি একা নই। এ তল্লাটে এমন কয়েকশো মেঢ়িন চলছে। দিনে গড়ে প্রায় ১২ কুইন্টাল মুড়ি ভাজা হয় আমার কলে। এ মিড়ি ভাজা মুড়ির তুলনায় অনের নরম। খেতেও ভাল। মুড়িতে কোনও দানা থাকে না। বাজারে দিব্যি বিকোচ্ছে ২৫ টাকা কিলোয়।” খুচরো বিক্রি প্রায় ২৮ টাকায়।
মইনুল জানেন এমনই অজস্র মেঢ়িনের ঘায়ে হারিয়ে যাচ্ছে হাঁসুপুরের মতো আরও অনেক মুড়ি ভেজে উপায় খোঁজা গ্রাম। তাঁর স্বগতোক্তি, “জানি ,সবই তবে আমাকেও তো আয়ের মুখটা দেখতে হবে!”
সুজন চৌধুরীর রঘুনাথগঞ্জ বাজারে মুড়ির আড়ত রয়েছে। তাঁর যুক্তি, “মেশিনের মুড়ি প্যারেটে মেলে। লোকে খেন প্যাকেজিং বুজেছে। ফলে ভাজা, খোলা মুড়ি নিতে চায় না। প্যারেটে থাকলে মিইয়ে যাওয়ার সুযোগও নেই। তবে খেতে কোনটা ভাল তা লোকেই বলবে!” তিনি না বলেও বলে দিচ্ছেন স্বাদে অনেক এগিয়ে তাওয়ায় ভাজা হাঁসপুরের মুড়ি। না বলেও কি বলে দিচ্ছেন না, মেশিনে ভাজা মুড়ি মিইয়ে না যাওয়ার কারণ ইউরিয়া।
কলেজ পড়ুয়া দুধকুমার মণ্ডলের বাড়িতে মুড়ি ভাজার রেওয়াজ দীর্ঘ দিনের। তিনি বলেন, “আসলে এটা প্রচারের যুগ। প্যাকেট জাত মেশিনের মুড়ি চোখে ধরছে ক্রেতাদের। আর দেশি মুড়ি বিক্রি হচ্ছে ঠোঙায় ওজন করে। এত দিন গ্রামে মুড়ি ভাজার ব্যবসা চললেও ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তা কখনওই দেখেনি গ্রামবাসীরা।”
ফলে বাজার ধরতে হাঁসুপুরের মানুষকে ছুটতে হচ্ছে মালদহ কিংবা ঝাড়খণ্ডের প্রান্তিক শহরগুলিতে।
আর তাঁদের পিছনে অনর্গল তাড়া করছে মেশিনের সেই কর্কশ আওয়াজ।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.