‘জল ধরো, জল ভরো’ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রিয় প্রকল্প। অথচ তাঁর সরকারই আইন তুচ্ছ করে বুজিয়ে দিচ্ছে একশো বিঘের এক জলাধার!
উত্তর ২৪ পরগনার বনগাঁর পেট্রাপোল সীমান্তে অত্যাধুনিক ‘ইন্টিগ্রেটেড চেকপোস্ট’ (আইসিপি) গড়ার জন্য ট্রাকের পর ট্রাক মাটি ফেলে ওই জলাশয় ভরাট করা হচ্ছে। প্রকল্প নির্মাণের দায়িত্বপ্রাপ্ত ঠিকাদার সংস্থার কর্তারা জানিয়েছেন, প্রথম দফায় অধিগ্রহণ হয়েছে ৬৫ একর জমি, যার ৩৩ একর (প্রায় ১০০ বিঘে)-ই জলাভূমি। তার প্রায় আট বিঘে ইতিমধ্যে ভরাট হয়ে গিয়েছে।
এবং এ জন্য ভূমি দফতরের অনুমতিও নেওয়া হয়নি। ভূমি-রেকর্ডের ১ নম্বর খতিয়ানে জমিটি ‘জলা’ হিসেবেই রয়েছে, চরিত্র বদল (কনভারশন) হয়নি। এক ভূমি-কর্তা বলেন, “কনভারশনের আগে হয় মিউটেশন। আইসিপি-র জন্য অধিগৃহীত জমির পাঁচটি প্লটের মিউটেশন হয়নি। তার মধ্যে জলাশয়টি রয়েছে।” ভূমি দফতরের তরফে জেলা প্রশাসনকে চিঠি লিখে জানানো হয়েছে, জলাশয়টি বোজানো সম্পূর্ণ আইন-বিরুদ্ধ। তাতে অবশ্য কাজ বন্ধ হয়নি। ইন্টিগ্রেটেড চেকপোস্ট ব্যাপারটা কী? |
ঠিকাদার সংস্থা এসভিইসি-র কর্তারা জানাচ্ছেন, এখানে অভিবাসন থেকে পাসপোর্ট এবং শুল্ক থেকে মালপত্র পরীক্ষা করে এক বারেই যাত্রীরা দু’দেশে যাতায়াত করতে পারবেন। তবে এখন যে অংশে কাজ চলছে, সেটা পণ্য পরিবহণের জন্য। দু’দেশের ট্রাক এখানে মাল খালাস ও ভর্তি করবে। থাকবে বড় স্ক্যানার। ২০১১-য় কেন্দ্র-রাজ্য যৌথ প্রকল্পটির শিলান্যাস করেছিলেন তৎকালীন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদম্বরম ও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ছিলেন বাংলাদেশের বিদেশমন্ত্রী রেহানাও। এ হেন ‘অভিজাত’ প্রকল্পে আইন ভেঙে জলা ভরাট হচ্ছে দেখেও ভূমি দফতর নিরূপায়। “গোটা কাজটাই বেআইনি। এ ক্ষেত্রে থানায় জামিন-অযোগ্য ধারায় এফআইআর করা নিয়ম। কিন্তু কার বিরুদ্ধে করব?” আক্ষেপ এক ভূমি-কর্তার। জেলা প্রশাসন কী বলে?
জেলাশাসক সঞ্জয় বনসলের জবাব, “এমন কিছু জানি না। খোঁজ নিচ্ছি।” ঠিকাদার সংস্থাটির এক কর্তা সুরজ শ্রীবাস্তবের ব্যাখ্যা, “জলাভূমি থাকলেও জমি তো সরকারের। সরকার উন্নয়নের জন্য নিয়েছে।”
অতএব, কাজ চলছে। এ দিকে শুকনো মাটি চাপা পড়ে ছটফটিয়ে মরছে মাছ। বিপন্ন আড়াইশোটি মৎস্যজীবী পরিবার। জলাশয়ের একপাশে এসে মিশেছে বিভূতিভূষণের সাধের ইছামতীর একাংশ, অন্য পাশে প্রত্নতাত্ত্বিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাধের নাওভাঙা নদী। ২০০০ সালে বিধ্বংসী বন্যায় গোটা সীমান্ত জলের তলায় চলে গিয়েছিল। সীমান্তরক্ষীরা নালা কেটে সেই জল ফেলেছিলেন এই জলাশয়ে, যাকে কেউ ডাকেন পেট্রাপোল বাঁওড় বলে, কারও মুখে তা পিরোজপুর বাঁওড়। নদী-বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্রের কথায়, “গোটা ব্যাপারটাই বেআইনি। আর এত বড় জলশায় বোজালে প্রাকৃতিক ভারসাম্যে বড় ক্ষতি হয়ে যাবে।” জলাশয় লাগোয়া পিরোজপুর-পেট্রাপোল মৎস্যজীবী সমবায়ের ম্যানেজার, তথা তৃণমূল পরিচালিত বনগাঁ পঞ্চায়েত সমিতির মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ দফতরের কর্মাধ্যক্ষ গণেশ বিশ্বাস বলেন, “মৎস্যচাষে প্রথম হওয়ায় সরকার আমাদের পুরস্কার দিচ্ছে, আবার আমাদের জলই কেড়ে নিচ্ছে!”
কোনও প্রতিবাদ হয়নি? বাসিন্দাদের একাংশ জানাচ্ছেন, প্রথমে কেউ কেউ প্রতিবাদ করলেও টেকেনি। আবার অনেকের কাছে ব্যাপারটাই অজানা। “ইছামতীতে বার বার বাধা সৃষ্টির পরে ২০০০ সালের বন্যার দুঃসহ স্মৃতিটা মনে হচ্ছে ফিকে হয়ে আসছে। টের পাওয়া যাবে পরে।” মন্তব্য স্থানীয় এক প্রবীণ শিক্ষকের। |