|
|
|
|
চিরতরে বন্ধের মুখে সংস্থা |
ডানলপের সম্পত্তি বেচে পাওনা মেটাতে নির্দেশ |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
অন্তর্বর্তী রায়ের পরে আশঙ্কা ছিলই। শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত রায়েও ডানলপ সংস্থার যাবতীয় সম্পত্তি বিক্রি করে পাওনাদারদের বকেয়া মেটানোর জন্য অফিশিয়াল লিকুইডেটর বসানোর নির্দেশ দিল কলকাতা হাইকোর্ট। ফলে ১১৭ বছরের পুরনো এই সংস্থার হুগলির সাহাগঞ্জ এবং চেন্নাইয়ের অম্বাত্তুরের দু’টি কারখানাই চিরতরে বন্ধ হওয়ার মুখে।
এক বছর আগে হাইকোর্টের বিচারপতি সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর অন্তর্বর্তী রায়ে লিকুইডেটর বসানোর নির্দেশ দিয়ে জানিয়েছিলেন, ডানলপ কর্তৃপক্ষ দিনেদুপুরে ডাকাতি করছেন। সংস্থার অনেক স্থাবর সম্পত্তি বেনামে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। তাঁর নির্দেশ চ্যালেঞ্জ করে তখন ডিভিশন বেঞ্চে আবেদন করেন ডানলপ কর্তৃপক্ষ। ডিভিশন বেঞ্চ লিকুইডেটরের পরিবর্তে স্পেশ্যাল অফিসার নিয়োগের নির্দেশ দেয়। পাশাপাশি তারা বলে, চূড়ান্ত রায়ের উপরেই সব নির্ভর করবে।
বৃহস্পতিবার সেই চূড়ান্ত রায়ে বিচারপতি সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়ে দিলেন, ডানলপের দু’টি কারখানা ও অন্যান্য সম্পত্তির উপরে কর্তৃপক্ষের আর কোনও এক্তিয়ার রইল না। হাইকোর্ট নিযুক্ত লিকুইডেটরই ডানলপের সব সম্পত্তি দেখাশোনা করবেন, সম্পদের তালিকা তৈরি করবেন, বিক্রির প্রক্রিয়া ঠিক করবেন, নিলাম করবেন এবং সম্পত্তি বিক্রি থেকে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে পাওনাদারদের বকেয়া মেটাবেন। |
|
—নিজস্ব চিত্র |
হাইকোর্টের রায় নিয়ে রাজ্য সরকারের শীর্ষকর্তারা সতর্ক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। ডানলপের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির নিলামে সরকার যোগ দিতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়ে রাজ্যের শ্রমমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসু বলেন, “রায় দেখে আইনজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করে সরকারের অবস্থান ঠিক করা হবে। তবে ডানলপ কারখানার সম্পত্তি নিলাম হলে তাতে রাজ্য শিল্পোন্নয়ন নিগম যোগ দিতেই পারে।” পূর্ণেন্দুবাবুর মতে, ডানলপের সম্পত্তি বিক্রির পরে শ্রমিকদের পাওনাগন্ডা মেটানোয় অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। একই সঙ্গে অবশ্য তাঁরও আশঙ্কা, “অধিকাংশ সম্পত্তি ওখান থেকে আগেই সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।” তাঁর দাবি, “ডানলপ কর্তৃপক্ষকে বলা হয়েছিল, আপনারা কারখানা খুলুন। তার পরে বাকি বিষয় নিয়ে আলোচনা করা যাবে। কিন্তু মালিকপক্ষ কারখানা খোলার সেই শর্ত মানলেন না। ফলে আলোচনাও ফলপ্রসূ হল না।” এ দিন আদালতের রায়ে কারখানার শ্রমিকরা খুশি বলে দাবি করেছেন শ্রমমন্ত্রী। শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “শিল্প দফতরের তরফে বারবার চেষ্টা সত্ত্বেও কর্তৃপক্ষ কারখানা খুলতে রাজি হননি। এখন নতুন পরিস্থিতিতে শ্রমিক ও শিল্পের স্বার্থরক্ষায় পদক্ষেপ করা হবে।”
প্রশাসনের একাংশের বক্তব্য, দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় রাজ্য সরকারের গলার কাঁটা হয়ে ছিল ডানলপ। কোনও ভাবেই পবন রুইয়াকে বাগে এনে কারখানা চালু করতে পারেনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। অন্য দিকে, ডানলপের দরজা চিরতরে বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হওয়ায় রাজ্যের শিল্প আবার ধাক্কা খেল। ধাক্কা খেল রাজ্যের ভাবমূর্তিও।
ডানলপ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, “এখনও আদালতের নির্দেশের প্রতিলিপি হাতে পাইনি। সেটা পেলে আইনি পরামর্শ নিয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ করা হবে।” তবে সংস্থা সূত্রের খবর, এই রায়ের বিরোধিতা করে উচ্চ আদালতে যাওয়ার (হয় হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ নয়তো সুপ্রিম কোর্ট) প্রস্তুতি নিচ্ছেন
ডানলপ কর্তৃপক্ষ।
ডানলপের কাছ থেকে বকেয়া আদায় করতে মামলা করেছিল পাওনাদার ১৬টি সংস্থা। রায়ে বলা হয়েছে, যে ১৬টি সংস্থার কয়েকশো কোটি টাকা পাওনা হয়েছে, লিকুইডেটর তাদের সেই বকেয়া শোধ করবেন। আবেদনকারীদের অন্যতম ভিন রাজ্যের সংস্থা স্মিস ক্যাপিটালের আইনজীবী রঞ্জন দেব জানান, লিকুইডেটর এখন আবেদনকারী পাওনাদারদের টাকা মেটানোর জন্য ডানলপের সম্পত্তি বিক্রি করবেন। আবেদনকারী সংস্থাগুলি ছাড়াও সম্পত্তি বিক্রির টাকায় কারখানার কয়েকশো শ্রমিকের পাওনা, ব্যাঙ্ক থেকে নেওয়া ঋণ এবং রাজ্য সরকারের প্রাপ্যও শোধ করবেন লিকুইডেটর। ডানলপের কাছে রাজ্য সরকারের বিভিন্ন সংস্থার পাওনা প্রায় ১০০ কোটি টাকা। সাহাগঞ্জের কারখানার শ্রমিকদের বকেয়ার পরিমাণ ৪০ কোটি টাকা। তবে সব মিলিয়ে ডানলপের মোট বকেয়া কত, তা এখনও স্পষ্ট নয়। সরকারের এক প্রতিনিধি জানান, তা ৭০০-৮০০ কোটি টাকা তো হবেই।
সূত্রের খবর, কাল, শনিবার সাহাগঞ্জে গিয়ে কারখানার দখল নেবেন লিকুইডেটর। মামলা চলাকালীন বিভিন্ন সংস্থার আইনজীবীরা বারবার অভিযোগ করেন, ডানলপ কর্তৃপক্ষ কোনও দিনই সুস্থ ভাবে কারখানা চালাতে আগ্রহ দেখাননি। আদালতে বিভিন্ন তথ্যপ্রমাণ দিয়ে দাবি করা
হয়, কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন পদ্ধতিতে ডানলপের সম্পত্তি আত্মসাৎ করার চেষ্টা করেছেন। রায়েও ডানলপের এই ভূমিকাকে ‘প্রকাশ্যে ডাকাতি’ বলে মন্তব্য করা হয়েছে।
রুইয়ার হাতে ডানলপ রয়েছে সাত বছর ধরে। ওই সাত বছরে একাধিক বার বন্ধ হয়েছে সাহাগঞ্জের কারখানা। ২০০৬ সালে নতুন সাজে সাহাগঞ্জের কারখানা খোলার পরে দু’বছর চালু ছিল ডানলপ। তবে কোনও সময়েই উৎপাদনের ঘোষিত লক্ষ্যমাত্রা ছুঁতে পারেনি সাহাগঞ্জ। এরই মধ্যে তারা অবশ্য রুগ্ণতা কাটিয়ে বিআইএফআর থেকে বেরিয়ে আসে। সংস্থাটিকে চাঙ্গা করতে ২০০৮-এর অক্টোবরে বামফ্রন্ট সরকার তাকে ‘রিলিফ আন্ডারটেকিং’-এর তকমা দেয়। ওই তকমা থাকলে পাওনাদারেরা টাকা আদায়ের জন্য আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যায় না।
ওই সময় বিশ্বজোড়া মন্দার প্রভাবে মার খায় ডানলপের ব্যবসা। উৎপাদন বন্ধ হয় সাহাগঞ্জে। তবে চার মাসের মধ্যে ফের কারখানাচালু হয়। ২০১০ সাল থেকে শুরু হয় স্টক এক্সচেঞ্জে ডানলপের শেয়ার কেনাবেচাও। কিন্তু এর পরে রিলিফ আন্ডারটেকিংয়ের মেয়াদশেষ হয়ে যায়। নতুন রাজ্য সরকার আর সেই মেয়াদ বাড়াতে রাজি হয়নি। বিভিন্ন দাবিতে কর্মীরাও আন্দোলন শুরু করেন। ২০১১ সালের ৮ অক্টোবর ফের উৎপাদন বন্ধের নোটিস ঝোলান কর্তৃপক্ষ। আর খোলেনি কারখানার দরজা। অম্বাত্তুরের কারখানা বন্ধ হয় ২০১২-এর ২২ ফেব্রুয়ারি। |
|
|
|
|
|