বহুত্ববাদী হওয়ার পরীক্ষায় ভারতীয় গণতন্ত্র ক্রমেই অকৃতকার্য হইয়া চলিয়াছে। তামিলনাড়ুতে যদি কমল হাসানের চলচ্চিত্রের প্রদর্শন বন্ধ করার অসহিষ্ণুতা সরকার ও জনসমাজের ক্ষুদ্র একাংশকে পাইয়া বসে, পশ্চিমবঙ্গে তবে সলমন রুশদির পদার্পণের সম্ভাবনা অঙ্কুরেই নাশ করিতে কায়েমি স্বার্থচক্রীদের অপকৌশলে প্রশাসন মদত দেয়। ইহাকে ‘সংস্কৃতির পীঠস্থান কলিকাতার লজ্জা’ আখ্যা দেওয়া স্বাভাবিক। সঙ্গতও। কিন্তু সত্য ইহাই যে, এমন লজ্জা এই প্রথম এই শহর ও তাহার নাগরিকদের কলঙ্কিত করিল না। ২০০৭ সালের নভেম্বরে লেখিকা তসলিমা নাসরিনকে কলিকাতা হইতে নির্বাসিত করিতে মৌলবাদীদের ষড়যন্ত্রে তদানীন্তন শাসক গোষ্ঠী বামফ্রন্ট যে ন্যক্কারজনক ভূমিকা পালন করে ও পন্থা-পদ্ধতি অবলম্বন করে, তাহার মধ্যেও ওই অসহিষ্ণুতা এবং মৌলবাদকে তোষণ ও তাহার কাছে নির্লজ্জ আত্মসমর্পণের লজ্জা নিহিত ছিল। তসলিমা বেশ কিছু কাল কলিকাতায় ভারত সরকারের অতিথি হিসাবে বসবাস করার পর সহসা যে-ভাবে বিনা প্ররোচনায় তাঁহাকে রাজ্য ছাড়া করিতে কিছু স্বার্থসন্ধানী উঠিয়া পড়িয়া লাগেন এবং সরকার যে-ভাবে আইনশৃঙ্খলার দোহাই দিয়া এক সাহিত্যিকের মত প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষার দায় এড়ায়, তাহা গভীর লজ্জার।
সলমন রুশদি অবশ্য কলিকাতায় বাস করিতে আগ্রহী ছিলেন না, তিনি কেবল তাঁহার বন্দিত উপন্যাস ‘মিডনাইট্স চিল্ড্রেন’-এর চলচ্চিত্রায়নের একটি প্রচার অনুষ্ঠানে, তাহার সহিত হয়তো অন্য কিছু অনুষ্ঠানেও, যোগ দিতে আসিতেছিলেন। একই ধরনের অনুষ্ঠান তিনি অন্যান্য ভারতীয় শহরে করিয়াছেন। এই চলচ্চিত্র বা তাহার ভিত্তিস্বরূপ উপন্যাসটিতে ইসলামের, পয়গম্বরের কোনও আলোচনা নাই। না-থাক, কলিকাতার শ’খানেক মৌলবাদী বিমানবন্দরে প্ল্যাকার্ড লইয়া হাজির হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে ‘সংখ্যালঘুর ধর্মীয় ভাবাবেগের স্পর্শকাতরতা’ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ধর্মনিরপেক্ষ সরকারকে সতর্ক করিয়া থাকিবে। নানা সূত্রে যে-সকল তথ্য মিলিয়াছে, তাহাতে অবশ্য সন্দেহ ঘনাইতেই পারে যে, ওই মুষ্টিমেয় প্রতিবাদীরা রুশদির কলিকাতায় আগমনের সংবাদটাও জানিতেন না, তাঁহাদের সে সমাচারও রাজ্য সরকারের প্রশাসনিক স্তর হইতেই জানানো হয়, যাহাতে তাঁহারা বিবৃতি-বিক্ষোভ মারফত ‘সংখ্যালঘুর ভাবাবেগ’-এর বিষয়টিকে সরকারের সামনে অজুহাত রূপে খাড়া করিয়া দিতে পারেন। সমগ্র ঘটনাপরম্পরায় এমন রহস্যময়তা রহিয়াছে যে, রুশদিকে কলিকাতায় নামিতে না-দিবার সিদ্ধান্তটিতে প্রশাসনের পূর্বপরিকল্পনার আভাস মেলে। একজন লেখককে তাঁহার মতামতের জন্য বিতাড়িত করা কিংবা শহরে নামিতে না দেওয়া কোনও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অভিজ্ঞান নয়। পশ্চিমবঙ্গ বুঝি-বা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা শাসিত হইলেও আজ আর অবাধ বা মুক্ত গণতন্ত্রের পীঠস্থান নয়, কেবল শাসকদের অনুমোদিত শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার সংকীর্ণ, অপরিসর খাঁচা।
এই খাঁচার ভিতর কোনও ভিন্নমতাবলম্বীর আসা-যাওয়া নিষিদ্ধ। বহুত্বের উদ্যাপন নয়, এখানে কেবলই একত্বের সমারোহ। ইহা শাসকের রাজনৈতিক স্বার্থকে সিদ্ধ করে, পঞ্চায়েত নির্বাচন আসন্ন হইলে তাহার সাম্প্রদায়িক স্বার্থকেও সিদ্ধ করিতে পারে, কেননা সাম্প্রদায়িক বিভাজন রাজ্যের নির্বাচনী রাজনীতিরও মেরুকরণ ঘটাইয়া দিয়াছে। তাই যে-কারণে মসজিদের ইমাম-মুয়েজ্জিনদের সরকারি ভাতা প্রদান করা হয়, মাদ্রাসা-শিক্ষার বিস্তারে তহবিল ঘোষিত হয়, কার্যত সেই একই কারণে রুশদির কলিকাতা পদার্পণও নিষিদ্ধ হইয়া যায়। কলিকাতা ও পশ্চিমবঙ্গে ভবিষ্যতে বোধ করি আর রামমোহন-রবীন্দ্রনাথ কিংবা নজরুল-মির মোশারফ হোসেনরা নন্দিত হইবেন না, দুই পার্শ্বে সুলতান আহমেদ, ইদ্রিস আলি, ত্বহা সিদ্দিকি কিংবা নাখোদা মসজিদের ইমামদের লইয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির চর্চা করিবে। তাহাতে যদি বহুত্ববাদের শ্বাস রুদ্ধ হইয়া আসে, আসুক। সাম্প্রদায়িক ভাবাবেগের যূপকাষ্ঠে নিত্যনব উন্মেষশালিনী বুদ্ধি ও মেধা চর্চাকে বলি দিয়াই সোনার বাংলায় ঘাসফুল ফুটিবে। |