এক বছরেই মৃত ৯৬
ভবঘুরেদের সরকারি আবাস যেন অন্ধকূপ, মৃত্যুর মিছিল
মানবিকতায় এ যেন সেলুলার জেলকেও লজ্জা দেবে।
একটি জানলাহীন অন্ধকার কুঠুরি। তাতেই খোঁয়ারের পশুর মতো গুঁজে রয়েছেন ২০০ জনের বেশি মানুষ। অস্বাস্থ্যকর, প্রায় দমবন্ধ অবস্থায় সেখানে প্রতি মাসে গড়ে আট জন করে মারা যাচ্ছেন। খাস কলকাতার ঢাকুরিয়ায় এই ভবঘুরে হোম পরিচালনার দায়িত্ব রাজ্য সরকারের।
ঢাকুরিয়ার ১৫৩ নম্বর শরৎ ঘোষ গার্ডেন রোডে সমাজকল্যাণ দফতরের এই ভবঘুরে হোমে গত এক বছরে (১ জানুয়ারি ২০১২ থেকে ৩১ জানুয়ারি ২০১৩) ৯৬ জন আবাসিকের মৃত্যু ঘিরে তোলপাড় শুরু হয়েছে প্রশাসনিক মহলে। হোমের চিকিৎসকেরা এবং হোমের রেফারাল হাসপাতাল এমআর বাঙুর-কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, মৃতেরা প্রত্যেকেই মারাত্মক অপুষ্টিতে ভুগছিলেন। এঁদের মধ্যে রমানাথ দাস, নরেন্দ্রপ্রসাদ সিংহ, বাবর, নীরেন্দ্র, রুদ্র স্বামী, বাবলু চহ্বাণ, কমল কিশোরের মতো মোট ১৮ জনকে এম আর বাঙুর হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য আনা হয়েছিল। তাঁদের দেহে মাত্রাতিরিক্ত অপুষ্টির কথা হাসপাতালের টিকিটেই লেখা রয়েছে।
বাকিরা মারা গিয়েছেন হোমে। হোমের চিকিৎসকেরাই এঁদের বেশির ভাগের মৃত্যুর কারণ হিসেবে জানিয়েছেন গাদাগাদি করে একটিমাত্র পুতিগন্ধময় ঘরে থাকায় খাওয়া বন্ধ হয়ে এবং ক্রস ইনফেকশনে আবাসিকদের মৃত্যু হয়েছে। হোম কর্তৃপক্ষই বিষয়টি নিয়ে হস্তক্ষেপের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লিখিত অনুরোধ জানিয়েছেন। এর পরেই এ ব্যাপারে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন রাজ্যের ‘কন্ট্রোলার অফ ভ্যাগরেন্সি’ বিশ্বনাথ চক্রবর্তী।
বিশ্বনাথবাবুর কথায়, “এটা ঠিক যে, ঢাকুরিয়ার ভবঘুরে হোমে একটু বেশি সংখ্যায় আবাসিকের মৃত্যু হয়েছে। আসলে জায়গার অভাব এবং আবাসিকদের চাপ সামলানো যাচ্ছে না। গোটা কলকাতায় এমন হোম মাত্র দু’টি। তবে ঢাকুরিয়ার বিষয়টি আমি খতিয়ে দেখতে বলেছি। একটা ঘরের মধ্যে এত জনকে রাখা উচিত নয়। খুব তাড়াতাড়ি ওখানে নতুন ভবন হবে।”
ঠিক কী অবস্থা ঢাকুরিয়ার ওই হোমে? বুধবার দুপুরে গিয়ে দেখা গেল, ২২৬ জন আবাসিক রয়েছেন একটি মাঝারি মাপের অন্ধকার কুঠুরিতে। কটু গন্ধে ঘরের ত্রিসীমানায় যাওয়া যাচ্ছে না। জায়গা এতই কম যে, কেউ ভাল করে হাঁটাচলা করতে পারছেন না। খাট পাতার জায়গা নেই, মেঝেতেই ঠাঁই। অধিকাংশ আবাসিক মানসিক ভাবে অসুস্থ বলে ঘরের দরজা অধিকাংশ সময়ে তালাবন্ধ। তাঁদের সঙ্গে একই ঘরে থাকেন মানসিক ভাবে সুস্থ আবাসিকেরা।
বন্ধ ঘরে বেশির ভাগ আলো-পাখা চলে না। আবাসিকেরা নিজেরা রান্না করলে খাওয়া জোটে, না-হলে জোটে না। দেখাশোনার কেউ নেই বলে দিনের পর দিন স্নান হয় না। ঘর পরিষ্কারের লোক নেই। চরম অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বহু আবাসিকের গায়ে পোকা হয়ে গিয়েছে।
হোমের এক উচ্চ-আধিকারিক বললেন, “মনে হয় নরকে আছি। মানুষগুলোর জন্য সরকারের কোনও মাথাব্যথা নেই। কোনও পরিকাঠামো নেই। আমাদের কাজ হল অসহায়ের মতো বসে থাকা আর ঘর থেকে নিয়ম করে লাশ বার করা।” তাঁর আরও বক্তব্য, “একটা কুঠুরিতে এ ভাবে মানুষগুলো পড়ে থাকে। প্রায় সকলে যক্ষ্মায় আক্রান্ত। অগস্ট-সেপ্টেম্বর নাগাদ প্রতিদিন ১০-১২ জন করে ডায়েরিয়ায় মারা যান।”
হোমে দু’জন চিকিৎসক। তাঁদের অন্যতম অমিতাভ মণ্ডলের কথায়, “এমন অমানবিক পরিস্থিতি যে, কল্পনা করা যায় না। লোকগুলো বসে-বসে মারা যাচ্ছে। অসহায় লাগছে। মৃত্যুর প্রধান কারণ, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে একসঙ্গে এত লোকের বসবাস। ছোঁয়াচে রোগ হুহু করে ছড়াচ্ছে।” অমিতাভবাবুর আরও বক্তব্য, “হোমের ঘরে এত দুর্গন্ধ, দূষণ আর আবর্জনা যে ওখানে থেকে আবাসিকদের ‘অ্যানারক্সিয়া নার্ভোসা’ নামের স্নায়ুরোগ হচ্ছে। খাবার পেলেও খেতে পারছেন না। অপুষ্টিতে ভুগছেন, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমছে। এক দিন ঘরেই মরে যাচ্ছেন।”
বাঙুর হাসপাতালের সুপার সন্তোষ রায়ও জানান, ঢাকুরিয়ার হোম থেকে প্রতি মাসেই তাঁদের হাসপাতালে রোগী আসেন। তাঁর কথায়, “প্রায় প্রত্যেকে হাড়ের উপরে চামড়া, শারীরিক ও মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত, গায়ে পোকা, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নেই। অনেক চেষ্টা করেও এঁদের অধিকাংশকে বাঁচানো যাচ্ছে না।”
ভবঘুরেদের হোমগুলি যে ভাবে, যে নিয়মে চলে তাতে বীতশ্রদ্ধ মানবাধিকার কর্মী সুজাত ভদ্র জানান, সম্প্রতি এমন একাধিক হোম ঘুরে তাঁদের মনে হয়েছে যেন নরক দর্শন করছেন। চূড়ান্ত অমানবিক ভাবে ভবঘুরেদের রাখা হয়েছে। যুগ বদলেছে, কিন্তু এঁদের জন্য নীতি বদলের কথা কারও মনে হয়নি।
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.