সিপিএমের জোনাল সদস্য কৌসর আলি তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে এক পক্ষের নেতাকে অস্ত্র সরবরাহ করতেন বলে দাবি করল পুলিশ। বর্ধমান আদালতে পেশ করা নথিতেও তারা এ কথা জানিয়েছে।
বৃহস্পতিবার বর্ধমানের রায়নায় পলেমপুর গ্রামে কৌসর আলির বাড়ির কাছে একটি ডোবা থেকে ফের অস্ত্রশস্ত্র মিলেছে বলে পুলিশের দাবি। আগেই তাঁকে বাড়িতে স্টেনগান ও নাইন এমএম পিস্তল রাখার অভিযোগে ধরা হয়েছে। তবে সিপিএমের দাবি, পঞ্চায়েত নির্বাচন সামনে থাকায় শাসকদল ও প্রশাসনের একাংশের আঁতাঁতে অস্ত্র-উদ্ধারের ‘নাটক’ চলছে।
বর্ধমানের পুলিশ সুপার সৈয়দ মহম্মদ হোসেন মির্জা জানান, এ দিন সকালে কৌসর আলির বাড়ির পিছনে একটি ডোবা থেকে ফের উদ্ধার হয় পলিথিনে মোড়া দু’টি স্টেনগান, দু’টি নাইন এমএম পিস্তল, দু’টি করে স্টেনগান ও নাইন এমএম পিস্তলের ম্যাগাজিন এবং ২০টি কার্তুজ। গত ২৪ জানুয়ারি কৌসরকে গ্রেফতার করে পরের দিন নিজেদের হেফাজতে নিয়েছিল জেলা পুলিশ। তাদের দাবি, জেরার মুখে তিনি আরও অস্ত্র লিুকয়ে রাখার কথা কবুল করেন। সে কারণেই এ দিন ফের অভিযান চালানো হয়।
সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য তথা বিধানসভায় বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের দাবি, “পরিকল্পনা করেই পুলিশ কৌসর আলির বাড়িতে অস্ত্র উদ্ধার করতে গিয়েছিল। এক জন প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, যিনি এখন রাজ্য সরকারের উপদেষ্টা হয়েছেন, স্থানীয় পুলিশ-প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠক করেন। সেখানেই ওই পরিকল্পনা হয়েছে। রাত দেড়টায় পুলিশ কৌসরের বাড়িতে হানা দিয়েছিল। ওই এলাকায় কেউ-কেউ বলেছেন, দরজাটা (কৌসরের বাড়ির) একটু চওড়া হলে বোফর্স কামানও ঢুকিয়ে দিতে পারতাম!” |
প্রাক্তন রেলমন্ত্রী তথা তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় পাল্টা দাবি করেন, “কৌসর আলি দীর্ঘদিন ধরেই সিপিএমের জেলা সম্পাদক অমল হালদার, জেলা সভাধিপতি উদয় সরকারদের স্নেহের পাত্র। সিপিএমের শীর্ষ নেতাদের জ্ঞাতসারেই সে অস্ত্রভাণ্ডার গড়ে তুলেছিল। আগের বাম সরকার এর দায় এড়াতে পারে না।” যদিও গত দেড় বছর ধরে তাঁরা কী করছিলেন, সেই প্রশ্নের সদুত্তর মেলেনি। তাঁদেরই দলের নেতাকে অস্ত্র জোগানোর যে অভিযোগ রয়েছে, সেই প্রসঙ্গও তিনি এড়িয়ে গিয়েছেন।
রাজ্য কমিটির বৈঠকে ব্যস্ত থাকায় অমলবাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। তবে জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রাজ্জাক মণ্ডল বলেন, “সিপিএমের এক জোনাল নেতা অস্ত্র সরবরাহ করছেন তৃণমূলের নেতাকে! একথা কেউ বিশ্বাস করবে? এ দিন যে পলিথিনে আগ্নেয়াস্ত্রগুলি ছিল, সেগুলি বেশ নতুন। অস্ত্রগুলিও যথেষ্ট চকচকে। যদি গ্রেফতার হওয়ার সাত দিন আগেও কৌসর সেগুলি ডোবায় লুকিয়ে রেখে থাকে, জল ঢুকল না কেন?” সূর্যবাবুও এক প্রশ্ন তুলেছেন।
এসডিপিও (বর্ধমান) অম্লানকুসুম ঘোষ বলেন, “বস্তার গায়ে তো জলকাদা লেগেই ছিল। তবে ঠিক কতদিন আগে ওই বস্তা জলে ফেলা হয় তা জানতে হলে ফরেনসিক পরীক্ষা করাতে হবে।” পুলিশ সুপার বলেন, “যে তিনটি স্টেনগান ও তিনটি নাইন এমএম পিস্তল উদ্ধার হয়েছে, সেগুলি মেরামত করা। কিন্তু আসল আগ্নেয়াস্ত্রের বহু কলকব্জাই ওতে লাগানো রয়েছে। এক-একটি স্টেনগানের দাম প্রায় এক লক্ষ টাকা, নাইন এমএম পিস্তলের দাম ৪০ হাজার টাকা, তার গুলির দাম তিন-চারশো টাকা।”
যে তৃণমূল নেতাকে কৌসর অস্ত্র সরবরাহ করতেন বলে অভিযোগ, সেই শেখ নিয়ামুল হক মণ্ডলকে আগেই গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এক সময়ের ডাকসাইটে সিপিএম নেতা, পরে তৃণমূলে আসা বামদেব মণ্ডলের গোষ্ঠীর সঙ্গে তাঁর অনুগামীদের সংঘর্ষ লেগেই ছিল। রায়নার এক তৃণমূল নেতার দাবি, “বামদেবের সঙ্গে এঁটে উঠতে না পেরেই নিয়ামুল সিপিএমের লোকেদের সাহায্য চায়। কৌসরের অস্ত্র ও লোকবলে বলিয়ান হয়েই তারা বামদেবকে এলাকাছাড়া করে।” বর্ধমানের দলীয় পর্যবেক্ষক অলোক দাস বলেন, “এটা ঠিকই যে আমাদের দলের মধ্যে সিপিএমের অনুপ্রবেশ ঘটেছে কিছু জায়গায়। কিছু নেতা সিপিএমের লোকদের সঙ্গে নিয়ে পুরনো কর্মীদের কোণঠাসা করার চেষ্টা করছেন। আমরা নজর রাখছি। দল নিষ্ক্রিয় থাকবে না।”
পুলিশ জানিয়েছে, নিয়ামুলকে জেরা করেই কৌসরের অস্ত্রের কথা জানা গিয়েছে। গত ২৫ জানুয়ারি রায়না থানার সাব-ইনস্পেক্টর জিল্লাল রহমান সিজেএম আদালতে পেশ করা নথিতে জানিয়েছেন, গত ২ জানুয়ারি রায়নার বনতির গ্রামে তৃণমূলের দু’টি গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছিল। তাতে জড়িত শেখ নিয়ামুলকে নিয়মিত অস্ত্র সরবরাহ করতেন কৌসর। পুলিশি হেফাজতে থাকার সময়ে নিয়ামুলই সে কথা তাঁকে জানিয়েছেন। সে ক্ষেত্রে কেন তাঁকে গোপন জবানবন্দি দিতে আদালতে পাঠানো হল না, সেই প্রশ্ন তুলেছে সিপিএম। এসডিপিও বলেন, “সেই জবানবন্দি উনি সময় মতোই দেবেন।”
পুলিশ সুপার বলেন, “কৌসর কোথা থেকে অস্ত্র পেলেন, তা স্পষ্ট হয়নি। তবে ওঁকে জেরা করে আমরা জেনেছি, আরও কিছু আগ্নেয়াস্ত্র তিনি লুকিয়ে রেখেছেন। সেগুলি উদ্ধার করার জন্য অভিযান চলবে।” |