বর্ষায় দু’কূল ভাঙা আশা
গ্র্যান্ড হোটেল, সকাল ৯:৪০
ব্যাক টু ক্যামেরা বসে আছেন তিনি। পিছন থেকে পা টিপে টিপে গেলে বোঝা যাচ্ছে, এক মনে জপ করছেন। শালটা কোলে পাতা। আমাদের দেখেই উঠে দাঁড়ালেন। চা আনতে বললেন। “আপনাদের লিকার চা তো? আমি আবার দুধ, চিনি ছাড়া চা খেতেই পারি না।” সরল স্বীকারোক্তি। এর পর ২৬ জানুয়ারির ছুটির সকালে আশা ভোঁসলে এমন অনেক দুঃখের কথা বললেন, যা শুনতে পেশাদার সাংবাদিকেরও চোখে জল এসে যাচ্ছিল।


অনেক দিন পর কলকাতায়...
হ্যাঁ। অনেক বছর পর। সকাল সকাল উঠে পড়েছি। ভাল লাগছিল পুল সাইডে একা একা বসে থাকতে। কলকাতার সকালগুলো বড্ড ভাল।

আপনার যা ব্যস্ত শিডিউল। গতকাল সন্ধ্যাবেলা ফ্রেন্ডস এফএম আয়োজিত ‘রাহুল আর আমি’। তার দু’দিন আগে সচিন তেন্ডুলকরের সঙ্গে আপনার ছবি ‘মাই’-এর মিউজিক লঞ্চ। শান্তি আসবে কোথা থেকে এত ব্যস্ত থাকলে?
(হেসে) হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন। তবে এই ব্যস্ততাই ভাল।

সচিনকে কী বললেন?
আমি সচিনের বিরাট ফ্যান। অনেক কথা হল। আমার তো ওকে দেখেই নার্ভাস লাগে! এত বড় ক্রিকেটার।

ওয়ান ডে থেকে সচিন হঠাত্‌ অবসর নিলেন কেন জিজ্ঞেস করলেন না?
না। কাজ নিয়ে আমি কোনও কথা বলিনি ওর সঙ্গে। শুধু একবার বললাম টেস্ট ম্যাচ খেলবে ঠিক করেছ, বেশ করেছ। বললাম ‘ডটে রহো’, ভাল সময় এল বলে। ওর পক্ষে পাঁচ দিনের ক্রিকেটটাই ভাল এখন। আমরা পুরনো দিনের লোক। আমাদের টেস্ট ক্রিকেটটাই ভাল লাগে। একদিনের ক্রিকেট বা টি টোয়েন্টি ভাল লাগে না। ওখানে শুধু ‘মারো মারো ভাগো ভাগো’। কিন্তু পাঁচ দিনের খেলা অন্য জিনিস। টেস্ট ক্রিকেটে অনেকক্ষণ পর একটা ভাল শট! উফ, ওটার মজাই আলাদা।

আপনি এখনও টেস্ট ক্রিকেটের খোঁজখবর রাখেন?
হ্যাঁ, অবশ্যই। টেস্ট হলেই আমাকে টিভির সামনে পাবেন। আর আজ থেকে নয়, সেই ১৯৫৫ থেকে। সুনীল (গাওস্কর) তো আমাদের পারিবারিক বন্ধু। মুম্বইয়ের অনেক ক্রিকেটারই আমাদের বাড়িতে আসতেন। নরি কন্ট্রাকটর হোক বা সুভাষ গুপ্তে। ‘মাই’-এর অডিও রিলিজ অনুষ্ঠানে সচিনকে ডিনারে অনেক গল্প বলছিলাম। কয়েকটা জিনিসও দিলাম ওকে।

তাই! কী দিলেন?
আমার আর পঞ্চমের একটা এলপি রেকর্ড আছে যা এখন আর কোথাও পাওয়া যায় না। সেটা দিলাম। ‘আশা-আর ডি ইন ....’ কী যেন নাম লন্ডনের ওই বিখ্যাত হলটার?

রয়্যাল অ্যালবার্ট হল...
ইয়েস। আশা-আর ডি ইন রয়্যাল অ্যালবার্ট হল। ওটা ছাড়াও কয়েকটা রেকর্ড দিলাম। আর একটা জিনিসও দিলাম জানেন। ‘ইন আঁখো কী মস্তি’ গাওয়ার সময় আমি গানটা নিজে একটা কাগজে লিখেছিলাম। কোথায় কী সুর লাগবে, নিজেই সেগুলো কথার পাশে পাশে লিখে রেখেছিলাম। সেই কাগজটার মূল্য সচিন বুঝতে পারবে বলেই ওকে দিলাম।

আশাজি, ওয়ান ডে থেকে সচিন অবসর নেন। রিকি পন্টিং অবসর নেন। রাহুল দ্রাবিড় অবসর নেন। কিন্তু আশি বছর বয়সেও অবসর শব্দটা আপনার ডিকশনারিতে নেই।
আমার তো মনেই হয় না যে আমার আশি বছর বয়স হয়েছে। বয়স কী বলুন তো? যদি ভাবেন আমি বুড়ো হয়ে গিয়েছি তা হলে তিরিশেও আপনি বুড়ো। আমার সেই রকম লাগে না।

কিন্তু এত বছর পর ক্লান্তি তো সবারই আসে। সকালে হাঁটু ব্যথা তো, সাধারণ বা অসাধারণ কাউকেই ছাড়ে না...
আমার হয় না জানেন! আমার পায়ে মাঝে মাঝে একটা নার্ভের সমস্যা হয়। সেই থেকে একটু ব্যথা হয়। ব্যস।
সংবাদ মাধ্যমের সংগ্রহে মা-মেয়ের একমাত্র ছবি
তা হলে বলুন, আশা তাই-এর ইয়ং থাকার টিপস কী? কী করেন আশা ভোঁসলে?
সকালে উঠে চা খাই। তার পর হালকা ব্রেকফাস্ট। তার পর তানপুরা নিয়ে রেওয়াজে বসি। রেওয়াজ মানেই বসে বসে ‘ওম’ লাগানো। ৯টা নাগাদ বসে ৯টা ২০ পর্যন্ত ওটাই চলে। তার পর কিছুক্ষণ দরাজ গলায় গাইলাম। তার পর...(হাসি)

তার পর?
(হাসতে হাসতেই) তার পর হাতে ব্যথার জন্য কিছুক্ষণ ডাম্বেল তুলি। হাত পড়ে যায় এই বয়সে খুব। আমার দুই হাঁটুর অস্ত্রোপচারও হয়েছে। সেই সময় অনেক রক্ত চলে গিয়েছিল শরীর থেকে। কিন্তু ডাক্তাররা আমাকে অন্য কারও রক্ত দিতে চাননি। কী জানি, ওদের কী ভরসা ছিল আমার উপর। তাই ফিট থাকতেই ডাম্বেল করি। তার পর স্নান। ব্যাস রেডি টু গো।

আপনি তো একটা চ্যারিটিও শুরু করেছেন কিছু দিন হল?
(অনেকক্ষণ চুপ) হ্যাঁ। শুরু করেছি। ৮ অক্টোবর আমার মেয়ে বর্ষা হঠাত্‌ আত্মহত্যা করে। সেই সময় আমি সিঙ্গাপুরে...

সরি আশাজি...
না না। ভগবান যখন লিখেছেন, আমাকে তো মুখোমুখি হতেই হবে। সিঙ্গাপুর থেকে ফেরার সময় পাঁচ ঘণ্টার ফ্লাইটে আমার যে কী অবস্থা হয়েছিল!

আপনি ওখানে তো একটা পুরস্কার নিতে গিয়েছিলেন?
আমাকে একটা পুরস্কার দিচ্ছিল ওখানে। সিঙ্গাপুর পৌঁছতে পৌঁছতে রাত হয়ে গিয়েছিল। আজ মনে হয়, না গেলেই হত... না গেলেই ভাল হত (আবেগে গলা বসে যেতে শুরু করেছে)।

তার পর?
পুরস্কার নিলাম। এর পর রাতে হোটেলে ফিরতেই বর্ষার ফোন। “তুমি এক্ষুনি চলে এসো। আমার তোমাকে এক্ষুনি দরকার।” আমি ওকে কিছুক্ষণ বোঝালামও। বললাম কালকে বিকেলেই ফিরছি। এত রাতে আমি প্লেন কোথায় পাব? পরের দিন বিকেলে ফিরলাম। বাড়ি পৌঁছোবার আগেই ওর বডি নিয়ে চলে গিয়েছিল। ভালই করেছিল। বর্ষাকে ওই অবস্থায় আমি দেখতে পারতাম না।

বুঝতে পারছি...
আমার আর বর্ষার স্বামী-স্ত্রীর মতো সম্পর্ক ছিল। সব সময় আমাকে বকত। এই শাড়িটা পোরো না। এটা কী গয়না পরেছ! এক বার একটা মিউজিক ভিডিওর জন্য লম্বা হাতার ব্লাউজ পরেছিলাম। আমাকে দেখেই বলল, “তোমার কি প্রিয়াঙ্কা চোপড়া হওয়ার ইচ্ছা হয়েছে নাকি? তুমি আশা ভোঁসলে।” ও খাবার বানালে আমাকে খেতেই হবে। ওর আমার উপর সব সময় একটা জোর ছিল। ও চলে যাওয়ার পর খালি মনে হয় আমাকে ও ভাবে বলার আর কেউ নেই। আমার ছেলে কোনও দিন এ সব জিজ্ঞেস করেনি। বর্ষা করত। ও চলে যাওয়ার পর তাই মনে হয়, জীবনটা একদম শূন্য হয়ে গিয়েছে। একদম খালি হো গয়ি মেরি জিন্দেগি...(কান্না)

আশাজি...
তার পর বাড়িতে ওর খালি ঘরটা...ওর আলমারি...ওর জিনিসপত্র। কলকাতাতে একটা শাড়ির দোকান আছে না ‘আনন্দ’ বলে?

হ্যাঁ আছে।
সেখান থেকে কত দামি দামি শাড়ি কিনেছিল ভাবতে পারবেন না! আমি আজকাল আর অত রংচঙে শাড়ি পরি না। তাও মাঝে মাঝে মনে হয় বর্ষার আলমারি খুলে পরেই ফেলি ওর শাড়িগুলো। ও যেখানেই থাকুক খুশি হবে।

ওই ট্রাস্টটাও তো বর্ষার জন্যই করা...
হ্যাঁ। ওর জন্যই। ডিসেম্বর মাসে আমি পুণেতে একটা শো করি। আটশো থেকে হাজার লোকের অডিটোরিয়াম ছিল ওটা। কিন্তু ওখান থেকেই ওরা আমাকে এক কোটি ছত্রিশ লক্ষ টাকা তুলে দেয়। পুণেতে আমাদের ‘মাই মঙ্গেশকর’ নামে একটা হাসপাতাল আছে। সেটার একটা ‘উইং’ এবং ‘ওপিডি’ বর্ষার নামে দান করেছি। এ সবের পিছনেই আমার ভাই হৃদয়নাথ।

আচ্ছা।
হ্যাঁ, বর্ষা চলে যাওয়ার পর ওই আমাকে বলে, “তানপুরা নিয়ে বসো দিদি। তোমার দুঃখ একমাত্র ভোলাতে পারে তোমার গান।” ওর জন্যই আবার রেওয়াজে বসা।

বর্ষাজি ৮ অক্টোবর চলে গেলেন। তার কত দিন পরের কথা এটা?
তার ঠিক তিন দিন পরের ঘটনা। ওই আমার গুরু আজকে। নিজেও পণ্ডিত। আমির খান সাহেবের শিষ্য। প্রায় তিন মাস আমি গাইতেই পারছিলাম না। ওই মোটিভেট করত আমাকে। তিন মাস পর ওই শো-তে আমার গলা কিছুটা ঠিক হল। তার পর গতকাল কলকাতায় এই শো-টা। মানুষ নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন যে আমার গলা ক্রমশ ঠিক হচ্ছে।

এই যে রেওয়াজ করতে বসতেন, দিদি লতাও থাকতেন আপনার সঙ্গে?
না। আমি একা না হলে রেওয়াজ করতে পারি না। হয় একা, নয় গুরুজির সামনে। তা ছাড়া রেওয়াজ হয় না। হৃদয়নাথ থাকত। তাও সব সময় না।

আপনার ছবিতে অভিনয় করা নিয়ে বর্ষা কী বলতেন?
আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম ওকে। বলেছিল, “তোমার বাবা অভিনেতা ছিলেন। প্লে-ব্যাক করার সময় তো তুমি এক প্রকার অভিনয় করতেই। তা হলে স্ক্রিনে অভিনয় করতে আপত্তি কোথায়?” আমাকে এও বলেছিল, “এমনিতে তোমার গলা খুব উঁচু। গলা নীচে নামিয়ে অভিনয় করতে হবে। আর স্টেজ শো করার জন্য তোমার ডান হাতের খুব বেশি মুভমেন্ট হয়। সিনেমায় সেটা কম না করলে মনে হবে যাত্রা করছ।” আমি শুনতাম ওর কথা। তবে সিনেমাটা দেখতে চায়নি।

কেন?
সিনেমার শু্যটিং শেষ হবার পর একদিন বললাম, আমার শু্যটিং শেষ। তুই দেখতে যাবি তো? আমাকে বলল ছবির শেষে কী হয়? আমি বললাম, আমি মারা যাই। শুনেই আমাকে বলেছিল যে পয়সা দিলেও ও দেখতে যাবে না। তুমি মরে যাবে এটা আমি দেখতে পারব না। এ রকম ভাবনা ওর প্রায়ই হত। আমাকে বলত “দিদিমওসি (লতা) এখন ৮৩। তুমি ৮০। তোমাদের বাকি বোনেদের বয়সও অনেক। মামার বয়স ৭৬। এই বাড়িতে বড় হয়েছি। তোমাদের ছোটবেলা থেকে দেখছি। কিন্তু কাউকে মরতে দেখতে চাই না। তোমাদের আগে যেন আমিই মারা যাই!”

খুব স্পর্শকাতর ছিলেন বর্ষা?
খুবই। রাগী ছিল, কিন্তু মনটা নরম ছিল খুব। ভাইকে খুব ভালবাসত। আমার নিজের মনে হয় বর্ষা গানটাও খুবই ভাল গাইত। তার পর সেটাও ছেড়ে দিল। কেন জিজ্ঞেস করলে বলত,“আমি তো লতা-আশা হতে পারব না। তা হলে গেয়ে লাভ কী!” তার পর সাংবাদিকতা করল কিছু দিন। খুব ভাল লিখত। ওর একটা লেখার উপর ‘সাজ’ ছবিটা বানানো হয়েছিল। দেব আনন্দ, চেতন সবার ব্যাপারে লিখেছিল। একা একা কার্গিল গিয়েছিল যুদ্ধের সময়।

আপনি বারণ করেননি?
আমি আমার ছেলে-মেয়েদের খুব একটা বারণ করি না। কেউ যদি ‘ড্যাশিং’ হয়, তার যেটা ইচ্ছা সেটাই করা উচিত এটাই আমি মনে করি। আডবাণীজির সঙ্গে দেখা করেছিল। কেন যে সাংবাদিকতা ছেড়ে দিল কে জানে! আমি বলতাম তুই কী করবি বাড়িতে বসে? কোনও উত্তর দিত না। চুপ করে থাকত।

ওঁর মৃত্যুর পর ‘প্রভুকুঞ্জ’ কেমন লাগে?
যেমন আগে ছিল, একদম তাই। ওর ঘরের কোনও জিনিস আমি সরাইনি। তিন জন কাজের লোক আছে। ওরা সব কাজ করে। আমাকে প্রায়ই জিজ্ঞেস করে কী কাজ করব? আমি বলি, বর্ষার ঘরটা পরিষ্কার রাখো। খালি মনে হয়, ও ঘর থেকে বেরিয়ে এসে কথা বলবে আমার সঙ্গে।

খুব শকিং...

আমি জীবনে অনেক আঘাত পেয়েছি। তবে সেগুলো যে আসবে সেটা বুঝতে পারতাম। কিন্তু এটা হঠাত্‌ হল। তৈরি ছিলাম না একদমই। গানটাই এখন সম্বল। এখন তো তানপুরাটা আমার শোওয়ার ঘরেই থাকে। যখন ইচ্ছা হয়, রেওয়াজ করি। আজ সকালে আপনাকে ইন্টারভিউ দেওয়ার আগেও রেওয়াজ করলাম। তবে রাত দশটার পর আর করি না। কারণ আমার নাতি আমার পাশে শোয়।

একটু অন্য প্রসঙ্গে আসছি। আপনি কলকাতায়। আর ডি বর্মনের স্মৃতি। কেমন লাগে সব মিলিয়ে আজকে আপনার?
খুবই ভাল লাগে। পঞ্চম আমাকে কলকাতা চিনিয়েছিল। ঢাকুরিয়া লেক, লং ড্রাইভ, রাস্তায় খাওয়া...সব ও-ই শিখিয়েছিল। আমি প্রথম এই হোটেলে আসি ১৯৫২ সালে। তখন পুরো বলিউডের সিটিং, আড্ডা সব এখানেই হত। বুঝতেই পারছেন কলকাতার কতটা প্রভাব ছিল বলিউডের উপর। তবে অনেক দিন পর কলকাতায় এসে আমার একটা জিনিস ভাল লাগছে কলকাতা অনেক পরিষ্কার হয়েছে। ফ্লাই-ওভার হয়েছে। বোধহয় মেট্রো রেলের জন্য ব্রিজ বানানো হচ্ছে। রাস্তায় এক রকমের আলো লাগানো হয়েছে দেখলাম। আগে কলকাতায় এলে আমার খুব দুঃখ হত। কিন্তু লেডি মমতা আসার পর দেখছি অনেক কিছুই বদলে গিয়েছে।

আপনি তো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ফ্যান?
খুব বড় ফ্যান। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আর ইন্দিরাজি। মমতাকে ভাল লাগে ওঁর সততার জন্য। স্ট্রাগলটা দেখুন। তার ওপর নিজের মতো করে ভাঙা ইংরাজিতে কথা বলেন। উনি যেটা, সেটাই দেখান। সুতির শাড়ি পরে রাজ্য শাসন করা চাট্টিখানি কথা নয়! ওঁর সততা আমাকে খুব টানে। আর টানে ওঁর আত্মত্যাগ করার ক্ষমতা। আমি বিশ্বাস করি নিয়মানুবর্তিতা আর আত্মত্যাগ করার ক্ষমতা না থাকলে বড় হওয়া যায় না। জানেন কত দিন টক দই, ছাস আর আইসক্রিম খাইনি?

কত দিন?
শেষ খেয়েছিলাম যখন ১৩ বছর বয়স।

মানে ৬৭ বছর টক দই, ছাস আর আইসক্রিম খাননি!

না খাইনি। গলার জন্য খাইনি। মাঝে মাঝে নাতি-নাতনিরা বলে আইসক্রিম খেতে। তখন এক চামচ খেয়ে বাকিটা ভাল করে বাটিতে নাড়াই (হেসে)। ঠান্ডা ভাবটা পুরো চলে গেলে দুধের মতো খেয়েনি।

আজকে যখন গান রেকডর্র করতে যান, চোখ বন্ধ করলে কখনও মিস করেন না কিশোরদা, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বা মহম্মদ রফিকে?

আমি কালকেই আমার ছেলেকে বলছিলাম, এই জন্মে আর ও রকম গলা শোনবার সৌভাগ্য হবে না। আমি হেমন্তদার যে কত বড় ফ্যান তা কল্পনাও করতে পারবেন না। একটা গান ছিল দাদার, ‘আঁচল সে কিঁউ বাঁন্ধ লিয়া...’। গানটা পাগলের মতো ভাল লাগত আমার। তখনকার দিনে মেয়েরা প্রেমে পড়ে ওই গানটা গাইত (হাসি)। কলকাতার মেয়েদের কাছে আটপৌরে ভাবে শাড়ি পড়া শিখতে চাইতাম। কিন্তু কেউ আমাকে শেখাতে পারেনি। যাদের কাছে জিজ্ঞেস করতাম তারা তখন ‘স্যাটারডে ক্লাব’-এ যেতেই ব্যস্ত থাকত।

রান্নাও করতেন শোনা যায়। গুলজার এক বার বলেছিলেন, আশা ভোঁসলে গান না করলে, শুধু রান্না করেই সংসার চালাতে পারতেন।

হ্যাঁ। সব রকম রান্নার ব্যাপারেই আমার ন্যাক ছিল। বাঙালি পদগুলো আজও খুব ভাল বানাই। শুধু পেঁয়াজ দিয়ে মাছের ঝোলটাই যা বানাতে পারি না। কিন্তু সরষে ইলিশ, বড়ি দিয়ে পারশে, চিংড়ির কাটলেট, চিংড়ির মালাইকারি, ভাপা ইলিশ সব জানি। নিশ্চিত ভাবে বলছি আমার থেকে ভাল বাঙালি রান্না আর কেউ করে না (হাসি)।

দুবাইতে তো রেস্তোরাঁও খুলেছেন?

হ্যাঁ। খুব ভাল চলছে সেটা। আমি আর হেড কুক মিলে সব মেনু ঠিক করেছি ওখানে। এখন তো চেন অফ রেস্তোরাঁও হয়ে গেছে। ইজরায়েলেও আমার রেস্তোরাঁ ভাল চলছে। ওখানে এত ঝামেলা, যুদ্ধ। কিন্তু বিদেশিরা আমার রেস্তোরাঁই প্রেফার করে।

ভারতে খুলছেন না কেন?

এখানে জায়গা পাচ্ছি না। তিন থেকে চার হাজার স্কোয়ার ফুট তো কম করে লাগবেই। কিন্তু কেউ জায়গা দিচ্ছে না।

আর এক বার আর ডি বর্মনের প্রসঙ্গে ফিরি। আজকাল আর ডি বর্মনের মিউজিশিয়ানদের সঙ্গে কথা বললেই বোঝা যায়, ওরা আপনাকে একেবারেই পছন্দ করেন না।
তাই?

হ্যাঁ, কেন বলুন তো?
(অনেকক্ষণ চুপ) বলছি আপনাকে। ওরা এমনিতে সারাদিন মদ খেত। আমি আসার পর আমিই পঞ্চমকে সামলাতাম। প্রথম প্রথম দেখতাম টাকা, চাবি, ঘড়ি সব পঞ্চমের টেবিলের ওপর খোলা পড়ে থাকত। আমি আসার পর ওর জন্য আলমারি বানিয়ে, চাবি ওর পকেটে দিয়ে বলতাম এগুলো এ ভাবে রেখো না। এ সব করতাম বলেই ওরা একদম পছন্দ করত না আমাকে। মেয়েরা তো এগুলো করবেই। শুধু তাই নয়, পঞ্চমের দামি মদের বোতলও পড়ে থাকত টেবিলে। এদের মধ্যে অনেকেই বাড়ি যাবার সময় তুলে নিয়ে যেত সেগুলো। পঞ্চম রাজা ছিল। ওর এ সবের দিকে মনই ছিল না। এমনকী সকালবেলা বাড়ি থেকে এলে এই মিউজিশিয়ানরা পঞ্চমের বাড়িতেই ব্রেকফাস্ট করত। তার পর সারাদিন ওখানে। রাতে দারু, মদের আসর।
আমি এগুলো বন্ধ করেছিলাম বলেই ওদের রাগ।

ওরা তো এমনকী...

আজকাল তো এও শুনি, মনোহারী হোক, বাসু হোক কী চক্রবর্তী, সবাই বলেছে ওরা নাকি সুর দিত আর পঞ্চম ব্যবহার করত সেগুলো। পঞ্চম অত ‘ফার্টুস’ সঙ্গীত পরিচালক ছিল না যে ওদের সুর ব্যবহার করবে। পঞ্চম অনেক অনেক বড় মাপের সঙ্গীত পরিচালক ছিল। পঞ্চম সুরটা করে দিয়ে ওদের দিয়ে কন্ট্রা-মেলোডিটা করাত। রেকর্ডিং স্টুডিওতে পঞ্চম মেশিনে গিয়ে বসত, এরা রিহার্সাল করাত, ১ ২ ৩ বলাত। ওদের কথা শুনে হাসি পায় আমার। পঞ্চম নাকি ওদের থেকেই অনুপ্রেরণা পেয়েছিল। মানুষ চলে গেলে সবাই যা ইচ্ছে তাই বলে। তখনও শুনতাম স্বপন (চক্রবর্তী) বলত ও নাকি সুর তৈরি করত। খুব রাগ হত আমার। বলতামও পঞ্চমকে। কিন্তু পঞ্চমের মনটা এত বড় ছিল! শুনে হাসত খুব। বলত, “বোলনে দো উনকো, যানে দো, ক্যয়া ফরক পরতা?” আরে আর ডি বর্মন ছিল বলেই তো আশা ‘আশা’ হল।

না না ম্যাম, এটা কী বলছেন? আপনি অসম্ভব ভার্সেটাইল। সে আপনি শঙ্কর জয়কিষেনের সঙ্গেই কাজ করুন, কী এস ডি বর্মন, কিংবা রবিজি বা ও পি নায়ার সাব...

হ্যাঁ তা ঠিক। কিন্তু আশা-র যে ওয়েস্টার্ন গান গাইবার ক্ষমতা আছে, সেটা তো পঞ্চমই দেখাল দুনিয়াকে। গীতাদি একটু একটু গাইত।

হঠাত্‌ যখন পশ্চিমী ঘরানার গান গাইতে শুরু করলেন, কোনও বিরোধিতার মুখে পড়েননি?
কে বিরোধিতা করবে? গাইতাম তো দিদি আর আমি। গীতাদি মাঝে মধ্যে। গীতাদির জন্যও খুব খারাপ লাগে। যত দিন রায় ছিলেন, সুখী ছিলেন। দত্ত হয়েই বদলে গেল ওঁর জীবনটা।

লতা মঙ্গেশকরকে নিয়ে প্রশ্ন করছি একটা। আর ডি বর্মন কিন্তু ওঁর জীবনের সবচেয়ে ভাল সুর করা কিছু গান গাইয়েছেন দিদিকে দিয়ে। কখনও জিজ্ঞেস করেননি এই গানটা আপনাকে না দিয়ে দিদিকে কেন দেওয়া হল?
না, কোনও দিন না। আমার স্বভাবেই নেই সেটা। আমার মনে হত আমি দিদির মতো গাইব। কিন্তু ওইটুকুই। না কোনও দিন আর ডিকে জিজ্ঞেস করেছি আমি, না ও আমাকে কোনও দিন বলেছে। জীবন থেকে এটুকু বুঝেছি, ব্যবসা আর বাড়ি, দু’টো একদম আলাদা সম্পর্ক। এই দু’টোকে এক করা কখনওই ঠিক নয়। সব ঝামেলার শুরু এটা থেকেই। তবে ‘শালিমার’ ছবিটা যখন হয় তখন আমি বলেছিলাম, পঞ্চম তুমি আমাকে একটাও গান দিলে না? তখন বলেছিল দিচ্ছি, দিচ্ছি। ‘মেরা পেয়ার শালিমার’ গানটা দিয়েছিল। আরও একটা গান দিয়েছিল, ‘আও না, গলে লগাও না’। ওটাতেও আমি বলেছিলাম আমাকে একটাও গান দিচ্ছ না? তখন দিয়েছিল এই গানটা। ব্যস, ওই দু’বার।

বর্ষার আত্মহননের দু’মাস পরেই বালাসাহেব ঠাকরের মৃত্যু...
বালাসাহেবের বয়স হয়েছিল অনেক। এখন উদ্ধব আছে। খুব শান্ত ছেলে। ছবি তুলতে ভালবাসে। উদ্ধব আসলে আর্টিস্ট। ভালই করবে মনে হয়।

‘অ্যায় মেরে ওয়তন কে লোগো’ গানটার ৫০ বছর হল। গানটা তো গাইবার কথা ছিল আপনার। পরে যদিও লতাজি গান।
ওটা নিয়ে আর কিছু বলতে চাই না। যে জিনিস বহু বছর আগে ঘটে গিয়েছে, তা নিয়ে কথা বলে কী লাভ?

আচ্ছা আশাজি, আপনি বলেছিলেন যখন আপনার দুঃখ হয়, গান গেয়ে সেটা কমানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু যারা আমাদের মতো সাধারণ মানুষ, যারা গাইতে পারে না, তারা দুঃখ থেকে বেরোবে কী ভাবে?
শুধু কয়েকটা ছোট জিনিস মনে রেখো। সুখ হোক কী দুঃখ, কোনওটাই স্থায়ী নয়। দিনও সারা জীবন থাকবে না। রাতও তাই। দুঃখ তো আসবেই। কিন্তু একদিন তা চলে যেতে বাধ্য। শুধু সময়ের ওপর ভরসা রাখো। সময়ই আমাদের পরম মিত্র। হ্যাঁ, কান্না পাবে, মনেও পড়বে। কিন্তু সময় সব ভুলিয়ে দেবে। আর দুঃখ পেলে একেবারে শান্ত হয়ে যাও। মনে রেখো এটা তোমার ভবিতব্য। তোমাকে তার মুখোমুখি দাঁড়াতেই হবে। মনটাকে শুধু শক্ত রাখো। ‘কড়ক’ রাখো। আর খারাপ সময় নিজের পাশে ভাল বন্ধু রেখো। মানুষ যখন জন্মায় তখন তিনটে জিনিস লেখা থাকে। জন্ম, মৃত্যু আর বিয়ে। মৃত্যু তো আসবেই। আমাদের কত জনের বাড়িতে মহামৃত্যুঞ্জয়ের পুজো হয়। কিন্তু তাও মৃত্যু আসে তো? বিয়েও সেই রকম। যেখানে যোগ আছে, সেখানেই হবে। সবার জন্য কেউ না কেউ ঠিক আছে। যদিও সব সময় সব কিছু প্ল্যান মাফিক চলে না। তাই সবটাই তোমাকে মাথা পেতে নিতে হবে। ভগবান যখন সাফল্যও দিচ্ছে, দুঃখও তাই। আর ভগবানের ওপর বিশ্বাস রাখো। ভগবান কী দেবেন? ভগবান মানে ‘ছতরি’, ছাতা। রোদ-বৃষ্টিতে তো তোমাকে হাঁটতেই হবে। কিন্তু ভগবান থাকলে একটা ছাতা তোমার সম্বল হিসেবে থাকবে।

এত বছর পর জীবনটা দেখলে কি মনে হয় মহিলারা পুরুষদের থেকে অনেক বেশি শক্ত?
হ্যাঁ, অনেক বেশি। মেয়েরা যখন কিছু ঠিক করে নেয়, তখন তা অর্জন করেই ছাড়ে। না হলে বলুন না, বাড়ি সামলে, ছেলেমেয়ে সামলে, শাশুড়ি-শ্বশুর সামলে, বর সামলে সে তো বাইরেও কাজ করতে যাচ্ছে। কোনও পুরুষ মানুষকে দু’টো বাচ্চা দিয়ে বাড়ি সামলানোর দায়িত্ব দিন, দেখবেন পারবে না।

আশাজি, আশি বছর বয়সে তা হলে ‘আশা’ নামটা সার্থক হল বলুন?

হ্যাঁ হল। আজকেও যে ভাবে আমি দাঁড়িয়ে আছি, এত বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও, তাতে কিছু মানুষের মনে তো আশা জাগাতে পেরেছি। আজকে যখন মেয়েকে হারিয়েও স্টেজে গান গাইতে পারছি, তখন আমাকে দেখে নিশ্চয়ই অনেকে ভাবে, আশা যখন পারল, আমরাও পারব না কেন! এটাই এই জীবন থেকে আমার পরম পাওয়া।

অনার্ড আশাজি।

থ্যাঙ্ক ইউ বেটা।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.