রেজ্জাক-আরাবুল কাণ্ডে পুলিশি তদন্তের নিরপেক্ষতা নিয়ে এ বার প্রশ্ন তুলে দিল কলকাতা হাইকোর্ট। ভাঙড়ের তৃণমূল নেতা আরাবুল ইসলামের বিরুদ্ধে ‘সশস্ত্র হামলা’র গুরুতর অভিযোগকে লঘু করে দেখানোর যৌক্তিকতা কী, বুধবার হাইকোর্ট তা জানতে চেয়েছে। সিপিএম বিধায়ক রেজ্জাক মোল্লাকে আক্রমণে অভিযুক্ত ওই নেতা ঘটনার দু’দিন পরে বামনঘাটায় প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ালেন কী ভাবে, আদালতের কাছে তা-ও বোধগম্য হয়নি। পাশাপাশি পুলিশ হেফাজতে থাকাকালীন আরাবুলকে রাজ্যের এক মন্ত্রী দেখতে যাওয়ায় বিস্ময় প্রকাশ করে হাইকোর্ট তিনটি বিষয়েই রাজ্যের হলফনামা চেয়েছে। বিচারপতি চান, খোদ স্বরাষ্ট্র-সচিব সেই হলফনামায় সই করবেন। রেজ্জাক-মামলায় নিম্ন আদালতে জামিন পেয়ে যাওয়া আরাবুল অবশ্য বামনঘাটা-কাণ্ডের জেরে আপাতত জেল হেফাজতেই। ওই মামলায় তাঁর জামিনের আর্জি এ দিন আলিপুর আদালতে নাকচ হয়ে গিয়েছে।
গত ৬ জানুয়ারি কলকাতা লেদার কমপ্লেক্স থানা-এলাকার কাঁটাতলায় রেজ্জাক মোল্লা আক্রান্ত হয়েছিলেন। এফআইআরে অভিযোগ করা হয়েছিল, আরাবুল সিপিএম বিধায়কের উপরে চড়াও হয়ে তাঁকে গুরুতর ভাবে জখম করেছেন। এ বিষয়ে পুলিশি তদন্তের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে হাইকোর্টে মামলা দায়ের করেছেন রেজ্জাকের ছেলে। তাঁর আর্জি, হাইকোর্টের তত্ত্বাবধানে দল গড়ে নিরপেক্ষ তদন্তের ব্যবস্থা হোক। এ দিন সেই মামলার শুনানিতে হাইকোর্টও তদন্তের গতি-প্রকৃতি নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছে। কী রকম? |
আদালত-সূত্রের খবর: কাঁটাতলার ঘটনায় পুলিশ আরাবুলের বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০৭ (হত্যার চেষ্টা) ও ৩২৬ (মারাত্মক ভাবে আঘাত করা) নম্বর ধারা রুজু করেনি। এমন গুরুতর অভিযোগের তদন্তে পুলিশের এ হেন ভূমিকা দেখে হাইকোর্ট যৎপরোনস্তি বিস্মিত। এ ব্যাপারে প্রশাসনের ব্যাখ্যা তলব করা হয়েছে। কাঁটাতলার দু’দিন পরে (৮ জানুয়ারি) লেদার কমপ্লেক্স থানা-এলাকার বামনঘাটায় সিপিএমের মিছিলের উপরে হামলাতেও আরাবুল প্রধান অভিযুক্ত। এবং এ ক্ষেত্রেও পুলিশের ভূমিকায় বিস্ময় প্রকাশ করে হাইকোর্ট জানিয়েছে, সে দিন বামনঘাটায় পুলিশের সামনে দাঁড়িয়েই আরাবুল কী ভাবে যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করলেন, তা তাদের মাথায় ঢুকছে না।
এখানেই শেষ নয়।
১৭ জানুয়ারি গ্রেফতার হওয়ার পরে আরাবুল যখন পুলিশি হেফাজতে এসএসকেএমে ভর্তি, ১৯ তারিখে হাসপাতালে তাঁকে দেখতে যান রাজ্যের পুর-নগরোন্নয়নমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। গিয়েছিলেন রাজারহাটের তৃণমূল বিধায়ক সব্যসাচী দত্তও। পুলিশ হেফাজতের কোনও অভিযুক্তকে মন্ত্রী কী ভাবে দেখতে যেতে পারেন, আগের দু’টি ঘটনার মতো সে সম্পর্কেও হাইকোর্টের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন আবেদনকারীর আইনজীবী বিকাশ ভট্টাচার্য। যার ভিত্তিতে এ দিন হাইকোর্ট রাজ্য সরকারকে নির্দেশ দিয়েছে, তিনটি প্রশ্নের ব্যাখ্যা রাজ্য সরকারকে হলফনামা দিয়ে আদালতের কাছে পেশ করতে হবে। বিচারপতি দীপঙ্কর দত্ত এ-ও জানিয়ে দেন, হলফনামায় যে কোনও অফিসারের সই থাকলে হবে না। সই করতে হবে স্বয়ং রাজ্যের স্বরাষ্ট্র-সচিবকে।
সরকার কী বলছে?
স্বরাষ্ট্র-সচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্য, “আদালতের নির্দেশ এখনও হাতে পাইনি। সেটা দেখে যা বলার বলব।” সচিব কিছু না-বললেও হাইকোর্টের নির্দেশ শুনে আরাবুলের প্রতি নরম মনোভাবই দেখিয়েছেন ফিরহাদ হাকিম। এ দিন তাঁর প্রতিক্রিয়া, “রেজ্জাক সাহেব নিজেই তো কিল-চড়-ঘুসির কথা বলেছেন! কিল-চড়-ঘুসিতে কি খুনের চেষ্টার মামলা হয়? কোনও মারণাস্ত্র ব্যবহার হয়নি। পুলিশ তদন্তে তেমন কিছু পেয়েছে বলেও শুনিনি।
তা হলে কীসের ভিত্তিতে ৩০৭, ৩২৬ ধারা?” আদালতের নির্দেশ দেখে সরকার উপযুক্ত হলফনামা দেবে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রী। অন্য দিকে রেজ্জাক মোল্লার বক্তব্য, “বুঝতে পেরেছিলাম, পুলিশের তদন্তে গাফিলতি রয়েছে। তাই নিরপেক্ষ তদন্ত চেয়ে আমার ছেলে মামলা করেছিল।” |
|
তিন প্রশ্ন |
|
• আরাবুলের বিরুদ্ধে ৩০৭ (খুনের চেষ্টা) ও ৩২৬ (অস্ত্রের আঘাত) ধারা নয় কেন?
• ৮ জানুয়ারি বামনঘাটায় আরাবুল কী করে পুলিশের সামনে ঘুরে বেড়ালেন?
• পুলিশ হেফাজতের অভিযুক্তকে দেখতে মন্ত্রী হাসপাতালে গেলেন কী ভাবে? |
|
হাইকোর্টের নির্দেশের প্রেক্ষিতে প্রশাসনকে এ দিন বিঁধেছে সব বিরোধী দলই। “এর আগে হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট রাজ্য সরকারকে তিরস্কার করেছে। বিধানসভায় পাশ হওয়া বিল পর্যন্ত আদালতে খারিজ হয়ে যাচ্ছে! সরকারকে প্রত্যেক দিন বিচারবিভাগের কাছে ধাক্কা খেতে হচ্ছে। সেই দুর্ভাগ্যজনক দিন যেন না-আসে, যে দিন বিচারালয় থেকেই সরকার চালাতে হবে।” বলেন বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্যের দাবি, “পুলিশের একাংশ আইনের রাস্তায় না-গিয়ে সরকারকে তোষণের পথে যাওয়ায় বিভ্রাট বাড়ছে।” বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের আক্ষেপ, “আদালতের মন্তব্যে স্পষ্ট যে, বাম আমলের দলতন্ত্রের ধারা এখনও অব্যাহত।”
বস্তুত রেজ্জাকের উপরে হামলার ঘটনায় পুলিশ যথাযথ ধারা প্রয়োগ করলে সংশ্লিষ্ট মামলাটিতে আরাবুলের জামিন হতো না বলে হাইকোর্টে অভিযোগ জানিয়েছেন আবেদনকারী। ঘটনা হল, বামনঘাটা-কাণ্ডে পুলিশ আরাবুলকে জামিন-অযোগ্য ধারাতেই ফেলেছে। এ ক্ষেত্রে অন্যান্য অভিযোগের সঙ্গে ৩০৭ ও ৩২৬ ধারাও জোড়া হয়েছে, যাতে আরাবুল এখনও জামিন হয়নি।
এবং ওই মামলায় তাঁর জামিন এ দিনও আলিপুর আদালত খারিজ করে দিয়েছে। জামিনের আর্জি নিয়ে শুনানি চলাকালীন এজলাসের ভিতরে এ দিন প্রবল বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়েন দু’পক্ষের কৌঁসুলিরা। একটা সময়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় বিচারক কাজী সফিউর রহমান এজলাস ছেড়ে বেরিয়ে যান। মিনিট দশেক বাদে অবস্থা কিছুটা স্বাভাবিক হলে ফের শুনানি শুরু হয়। সরকারপক্ষও আরাবুলের জামিনের বিরোধিতা করে। সব পক্ষের সওয়াল শুনে আদালত আরাবুলের জামিন নাকচ করে দেয়। বিচারক বলেন, ঘটনার গুরুত্ব এবং অন্যান্য বিষয় বিচার করে জামিনের আবেদন খারিজ করা হল।
এ দিন আরাবুল জামিনে খালাস পাবেন আশা করে সেই কাঁটাতলাতেই উৎসবের তোড়জোড় করেছিলেন তাঁর সমর্থকেরা। নেতাকে অভ্যর্থনা জানাতে তৈরি হয়েছিল মঞ্চ। আলিপুর আদালতের রায় জানার পরে স্বভাবতই তাঁদের আয়োজন-উৎসাহে ভাটা পড়ে। সন্ধ্যায় দেখা যায়, বাঁধা মঞ্চ খুলে দেওয়া হচ্ছে। নিভে গিয়েছে আলোও। |