তিনি কথা বললে বাকি টিম মুগ্ধ শ্রোতা। তিনি ‘জোক’ করলে বাকি টিম হেসে লুটিয়ে পড়ছে। তাঁর চোখে আত্মবিশ্বাস দেখে বাকি টিমের টেনশন-ফেনশন উধাও। লিয়েন্ডার পেজ এসে পড়তেই টেনিসের নতুন ভারত জেগে উঠল ডেভিস কাপে অগ্নিপরীক্ষা দিতে নামার আটচল্লিশ ঘণ্টা আগে। বুধবার দিল্লিতে দিনভর যার সাক্ষী থাকল আনন্দবাজার।
প্রশ্ন: কাল নাইট শোয়ে পুরো টিম নিয়ে ‘রেস টু’ দেখতে গিয়েছিলেন শুনলাম। কোচ জিশান-টিশান সবাইকে নিয়ে! যাতে সামনের শুক্রবার থেকে ডেভিস কাপে টিম ইন্ডিয়া দুদ্দাড় দৌড়োয়, সে জন্য কি?
লিয়েন্ডার: আরে, উলটোটাই তো বরং ঘটল কাল। সিনেমা দেখে ফিরে মাঝরাতেও ছেলেরা ঘুমোতে পারেনি। এত ‘হরিবল্’ সিনেমা! টিম হোটেলে আমার ঘরে ওদের কেউ কেউ অত রাতেও এসে বসেছিল। তার চেয়ে বরং ওরা আমার অভিনীত ‘রাজধানী এক্সপ্রেস’ দেখলে পারত। কিন্তু কী বলব! হলে ওরা সারাক্ষণ আমার পিছনে লাগছিল, এর থেকেও আমি খারাপ অভিনয় করি কি না!
প্র: তা হলে লিয়েন্ডার পৌঁছতেই বাকি আনকোরা ডেভিস কাপ টিমের মধ্যেও জোশ এসে গিয়েছে?
লিয়েন্ডার: সেটা শুক্র থেকে রবিবার, তিন দিনে বোঝা যাবে।
প্র: গতকাল এয়ারপোর্টে নেমেই নাকি সটান প্র্যাক্টিসে চলে এসেছিলেন? এটা কি ওই এগারো বিদ্রোহীকে আপনার বার্তা যে, দেশপ্রেম কাকে বলে দ্যাখ?
লিয়েন্ডার: ভারতীয় ডেভিস কাপ দলে আমার তরুণ সতীর্থদের বাদে এই মুহূর্তে বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে কাউকে আমার কোনও বার্তা দেওয়ার নেই। আর সেটাও ঠিক বার্তা নয়। বরং কৈফিয়ত যে, ফ্লাইট লেট করায় তোমাদের সঙ্গে প্র্যাক্টিসে যোগ দিতে দেরি হয়ে গেল ভাই। সরি। তবে তার পরে টানা তিন ঘণ্টা আমি প্র্যাক্টিস করেছি।
প্র: ঊনচল্লিশ বছর বয়সে, ২৩ বছর ডেভিস কাপে কাটানোর পরেও এত এনার্জি পান কী ভাবে?
লিয়েন্ডার: কোনও একটা ক্ষেত্রে দেশের প্রতিনিধিত্ব করার সৌভাগ্য হয়েছে, এই মহা গৌরব প্রতি মুহূর্তে অনুভব করে। আমার কাছে টেনিস খেলাটা সবচেয়ে বড়। তার চেয়েও বড়, দেশের হয়ে খেলাটা। আমি আমার জাতীয় পতাকার জন্য খেলি, আমার দেশের জনগণের জন্য খেলি। যত দিন শক্তি থাকবে, ডেভিস কাপে খেলে যাব। |
নতুন ভারত, নতুন সঙ্গী। ডেভিস কাপের অনুশীলনে
লিয়েন্ডারের সঙ্গে পুরব রাজা। বুধবার। ছবি: রমাকান্ত কুশাওয়া |
প্র: অজানা, দুর্বল পার্টনার নিয়ে খেলে হেরে চললেও খেলে যাবেন? লিয়েন্ডার পেজ নামেরও তো একটা ভাবমূর্তি রক্ষার দায় রয়েছে আপনার?
লিয়েন্ডার: সেই ভাবমূর্তি একটা-দুটো হারে কিচ্ছু বিগড়োবে না। ডেভিস কাপে তেইশ বছরে ৪৮টা টাইয়ে খেলা। ছিয়াশিটা ম্যাচ জেতা। তেরোটা গ্র্যান্ড স্ল্যাম ডাবলস খেতাব। ৫০টা এটিপি টুর্নামেন্ট চ্যাম্পিয়নএগুলোও তো আমার নামের পাশে রয়েছে।
তা ছাড়া প্লেয়ার, কোচ, ক্যাপ্টেন সবাই আসবে-যাবে। চিরনশ্বর শুধু টেনিস খেলাটা। খেলাটার যেন কোনও ক্ষতি না হয়, সেটা টেনিসের সঙ্গে জড়িত প্রত্যেকের দেখা উচিত। একটা কথা আজ এখানে জানাচ্ছি। অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের সময় আমি সোমদেবের সঙ্গে লম্বা সিটিং করেছি। অনেকক্ষণ কথা হয়েছে। ওদের জুনিয়র ছেলেদের সঙ্গেও যতটা পেরেছি যোগাযোগ করেছি। কথা বলেছি। ওদের সঙ্গে কথা বলে আমার অন্তত এটুকু মনে হয়েছে যে, ওরাও একটা সুষ্ঠু মীমাংসার অপেক্ষায় আছে।
প্র: তা হলেও কি এই রঞ্জিত-পুরব-বিজয়ন্তদের বদলে সোমদেব-য়ুকিদের নিয়ে কোরিয়ার বিরুদ্ধে খেলতে পারলে আপনি খুশি হতেন না?
লিয়েন্ডার: তা হলে তো বলা উচিত ফেডেরার, জকোভিচ, নাদালকে নিয়ে খেলতে পারলে সবচেয়ে বেশি খুশি হতাম! আসল কথাটা হল, এই যে আমার পাশের তিনটে চেয়ারে আমার যে তিন টিমমেট বসে আছে, ওদের আর ওদের খেলার ক্ষমতার ওপর আমি পুরোপুরি শ্রদ্ধাশীল। আমাদের চার জন প্লেয়ারের মধ্যে কোনও তফাত নেই। আমি বিশ্বাস করি, কোরিয়াকে আমরা হারাতে পারব।
তবে বহু বছর পরে নিজেদের দেশে আমরা ডেভিস কাপে আন্ডারডগ হিসেবে নামছি। আমার তেইশ বছরের ডেভিস কাপ জীবনে নেদারল্যান্ডস, ক্রোয়েশিয়া, এই দিল্লিতেই আমেরিকা এ রকম হাতে গোনা কয়েকটা মাত্র টাই ছাড়া এ রকম অদ্ভুত পরিস্থিতি কখনও হয়নি।
প্র: সেটার জন্য কি মহেশ ভূপতিদের বিদ্রোহই দায়ী নয়?
লিয়েন্ডার: আমাকে হাজার বার খোঁচালেও ওই বিষয়ে আমি কিছু বলব না। আমি কী খেলোয়াড়, কী ক্যাপ্টেন কোনও অবস্থায় এ ধরনের ঘটনায় নিজেকে জড়াইনি। আমি বিশ্বাস করি, প্লেয়ারের কোনও বিষয় নিয়ে ফেডারেশনের ওপর ক্ষোভ থাকলে সেটা দু’পক্ষের আলোচনার মাধ্যমে সুষ্ঠু সমাধান করা উচিত। দেশ বা খেলাটাকে বিতর্কের মধ্যে টেনে না এনে। এখন আমাদের উচিত, ভারতের ইয়ং টেনিস প্রজন্মকে সঠিক রাস্তা দেখিয়ে, সঠিক ভাবে নাড়াচাড়া করে আন্তর্জাতিক স্তরে তোলার চেষ্টা করা।
প্র: মহেশ-সোমদেবদের জোট তো বলছে, ওরাও সেটার জন্যই এআইটিএ-র বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামতে বাধ্য হয়েছে?
লিয়েন্ডার:: কী বলব? কোনও কিছুর জন্যই দেশের জাতীয় দল বা খেলাটাকেই বিতর্কে টেনে আনা কি ঠিক?
প্র: তা হলে আপনি চণ্ডীগড়ের ডেভিস কাপ টাই-তে খেললেন না কেন?
লিয়েন্ডার: (এই প্রথম বিরক্ত মুখে) তেইশ বছরে আমি মাত্র তিনটে ডেভিস কাপ টাই মিস করেছি। চণ্ডীগড়েরটার সময় আমি তার আগেই অন্য একটা টুর্নামেন্টে (ওয়ার্ল্ড টিম টেনিস), তা-ও একটা বিদেশি দলের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ ছিলাম খেলার জন্য। লিখিত চুক্তি লঙ্ঘন করা তো প্রায় শৃঙ্খলাভঙ্গ করা। এর বাইরে একবার সুইডেনের সঙ্গে কব্জির চোট, আর একবার দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে কাঁধের চোটের জন্য খেলতে পারিনি।
প্র: ‘রাজধানী এক্সপ্রেস’-এর রাগী যুবককে কি তা হলে দেশের রাজধানীতে চল্লিশ ছুঁইছুই বয়সে ভারতীয় টেনিসকে নতুন করে উদ্ধারে নামতে হচ্ছে?
লিয়েন্ডার: উদ্ধার নয়, ভারতীয় টেনিসকে সেবা করতে নামছি। বরাবরের মতো। দেশের পতাকার নীচে দাঁড়ানোর চেয়ে বড় গৌরব আর কিছু হতে পারে না। সবার সেটাই হওয়া উচিত। |