|
|
|
|
|
নামে বাকস্বাধীনতা,
দেশে সেন্সরেরই বিশ্বরূপ
জয়ন্ত ঘোষাল • নয়াদিল্লি |
|
সনিয়া গাঁধীর নির্দেশ। তাই সুর বদলে ফেললেন সুশীলকুমার শিন্দে।
কমলহাসনের ‘বিশ্বরূপম’ ছবিটি প্রদর্শনের ব্যাপারে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গোড়ায় কিন্তু নেতিবাচক মনোভাবই নিয়েছিলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, ছবি দেখালে যদি দেশে আইন-শৃঙ্খলার সমস্যা দেখা দেয়, তা হলে ছবির প্রদর্শন আটকানো যেতেই পারে। তবে বিষয়টি যেহেতু বিচারাধীন ছিল, বিতর্ক থেকে দূরে থাকার কৌশল নিয়েছিল কংগ্রেস। গত কাল মাদ্রাজ হাইকোর্ট ছবিটিকে ছাড়পত্র দিয়ে আজ আবার নতুন করে স্থগিতাদেশ দিয়েছে। এখন সনিয়ার নির্দেশে মত বদলে শিন্দে বলছেন, “আমরা মুক্ত সমাজে বাস করি। এখানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে। শিল্পীর স্বাধীনতা রয়েছে।”
সমাজবিদরা মনে করছেন, শিন্দের এই দ্বিমুখিতা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। তামিলনাড়ুতে কমলহাসনের ছবি নিয়ে বিতর্কও কোনও ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়। দেশ জুড়েই এক ধরনের সেন্সরশিপের সংস্কৃতি প্রবল আকার নিচ্ছে বলে মনে করছেন ওঁরা। কখনও জয়পুর সাহিত্য উৎসবে পাকিস্তানের সাহিত্যিকদের আসার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হচ্ছে। কখনও আটকানো হচ্ছে সলমন রুশদিকে। কলকাতাতেও রুশদির আসার ব্যাপারে রাজ্য সরকার তথা কলকাতা পুলিশ নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। সিপিএম জমানায় তসলিমা নাসরিনকে নিয়েও কলকাতায় একই কাণ্ড হয়েছিল। সেই থেকে তসলিমা এখনও কলকাতা যাওয়ার ছাড়পত্র পাননি। কখনও বিতর্কের নিশানা হয়ে উঠছেন আশিস নন্দী থেকে শাহরুখ খান। কমল নিজে আজ সাংবাদিক সম্মেলনে প্রয়াত শিল্পী মকবুল ফিদা হুসেনের কথা উল্লেখ করেছেন। তাঁর ছবি নিয়ে বিতর্ক ও মামলা-মোকদ্দমার জেরেই এ দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন হুসেন।
সমাজবিদদের চোখে একটা বিষয় স্পষ্ট ভারত যতই বৃহত্তম গণতন্ত্রের বড়াই করুক না কেন, দেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে বিড়ম্বনা কম নয়। ইদানীং কেন্দ্রীয় সরকার একাধিক ক্ষেত্রে কিছুটা নমনীয় মনোভাব নেওয়ার চেষ্টা করছে বটে। নাগরিক সমাজের আন্দোলনের পিছনে গণতান্ত্রিক বিক্ষোভের যৌক্তিকতা স্বীকার করে নিচ্ছেন সনিয়া গাঁধী। কথা বলতে চেয়ে চিঠি লিখছেন অণ্ণা হজারেকে। দিল্লিতে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলছেন। বিচারপতি জে এস বর্মাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছেন। এ সবই হচ্ছে, কিন্তু সামগ্রিক ভাবে সেন্সর-সংস্কৃতির বদল ঘটছে না বলেই সমাজবিদদের মত। তাঁদের ধারণা, রাজনৈতিক দলগুলি আসলে নিজেদের পিঠ বাঁচাতেই যুব সমাজের অসন্তোষকে খানিকটা স্বীকৃতি দিচ্ছে। কারণ, এই অসন্তোষকে কেন্দ্র করে যুবসমাজ সঙ্ঘবদ্ধ হলে তাদের অস্তিত্বের সঙ্কট দেখা দিতে পারে।
সমাজতত্ত্ববিদরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, আদতে প্রায় কোনও দলই এই সেন্সর-সংস্কৃতির বাইরে নয়। আজ হয়তো বিজেপি প্রশ্ন তুলছে, “কংগ্রেসের কোন মুখটা আসল? শিন্দে যখন কমলহাসনের বিপক্ষে বিবৃতি দেন সেটা, নাকি আজ যখন তাঁর পক্ষে বিবৃতি দেন সেটা?” কিন্তু জয়পুর সাহিত্য উৎসবের যাবতীয় বিতর্কে সেই বিজেপিই নীতি-পুলিশের ভূমিকা নিয়েছে।
সলমন রুশদি থেকে শুরু করে পাক লেখকদের ভারতে আসার বিরোধিতা করেছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার যখন রুশদিকে কলকাতায় আসতে বারণ করছে, তখন আবার বিজেপি তার তীব্র নিন্দা করছে। তামিলনাড়ুর রাজনীতিতে কমলহাসনের ছবিকে ঘিরে বিভেদ সৃষ্টি হয়েছে ডিএমকে ও এআইএডিএমকের মধ্যে।
সম্প্রতি দলিত-দুর্নীতি নিয়ে মুখ খুলে নিজেই এক বিতর্কের কেন্দ্র হয়ে ওঠা সমাজমনস্তত্ত্ববিদ আশিস নন্দীর মতে, সামগ্রিক ভাবে এখানে যে কোনও শাসক দলের মানসিকতাই সেন্সরমুখী। বাকস্বাধীনতা খর্ব করার ক্ষমতাও তাদেরই হাতে। ক্ষমতার সেই প্রতিষ্ঠানগুলোকে কারা কী ভাবে ব্যবহার করতে পারছেন, বাকস্বাধীনতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে সেটাই বড় প্রশ্ন।
পশ্চিমবঙ্গে সম্প্রতি একটি ব্যঙ্গচিত্রকে কেন্দ্র করেই গ্রেফতার হতে হয়েছিল এক অধ্যাপককে। আজও বিশ্বরূপম-বিতর্কের আবহে দেশ জুড়ে একটি কার্টুনের কথাই মুখে মুখে ফিরেছে গাঁধীমূর্তির নীচে লেখা রয়েছে ‘হে রাম’। তাই দেখে এক পুলিশ কনস্টেবল মোবাইল থেকে তাঁর বড় কর্তাকে ফোন করে প্রশ্ন করছেন, “স্যার! এটাও কমলহাসনের একটা সিনেমার নাম। এর উপরেও কি কালি লেপে দেব?” |
|
|
|
|
|