কাঙ্ক্ষিত নন কলকাতায়, বার্তা রুশদিকে
সলিমা নাসরিনের পর এ বার সলমন রুশদি।
২০০৭-এর নভেম্বরে তসলিমাকে কলকাতা ছাড়তে বাধ্য করেছিল রাজ্য সরকার। সেটা ছিল বামফ্রন্টের রাজত্ব। ২০১৩-র জানুয়ারিতে সলমন রুশদির কলকাতায় আসা ঠেকাল রাজ্য সরকার। যখন জমানা তৃণমূলের। কী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, কী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অসহিষ্ণুতার উত্তরাধিকার অব্যাহত কলকাতায়।
অথচ এই কলকাতাই ২০০২ সালে গোধরা পরবর্তী দাঙ্গার সময় গুজরাত থেকে পালিয়ে আসা কুতবউদ্দিনকে আশ্রয় দিয়েছিল। ধর্ম-সম্প্রদায় ভেদে বিপন্ন মানুষ এখানে আশ্রয় পান, এটাই ছিল এই রাজ্য তথা শহরের রেওয়াজ, সংস্কৃতি। কিন্তু ২০০৭-এর ২১ নভেম্বর কলকাতার রাজপথে এক দল লোকের বিশৃঙ্খল তাণ্ডব ও তার জেরে সেনা নামানোর পরিপ্রেক্ষিতে পর দিনই যখন তসলিমাকে এক রকম জয়পুরে যেতে বাধ্য করা হয়, তখনই জানা গিয়েছিল, এই শহরের চরিত্র বদলাচ্ছে। আর বুধবার রুশদি যখন পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচি সত্ত্বেও তাঁর এক দিনের কলকাতা সফর বাতিল করে দিলেন, তখন বোঝা গেল, এই শহর তার সহিষ্ণুতার ধর্মই হারিয়ে ফেলেছে।
ভারতের স্বাধীনতা ও দেশভাগের প্রেক্ষাপটে রুশদির লেখা ‘মিডনাটইস চিলড্রেন’-এর উপর ছবি তৈরি করেছেন দীপা মেটা। বুকার পুরস্কার জয়ী এই উপন্যাসে বাংলার প্রসঙ্গও রয়েছে, সুন্দরবনের সূত্র ধরে। সেই ছবিরই প্রচার উপলক্ষে গত সাত দিন ধরে বিনা বাধায় দিল্লি, বেঙ্গালুরু এবং মুম্বইয়ে গিয়েছেন রুশদি। এবং কোনও রকম ঝঞ্ঝাট ছাড়াই। কলকাতা ছিল দীপাদের প্রচার-তালিকায় একেবারে শেষে। রুশদির সঙ্গে দীপা এবং অভিনেতা রাহুল বসুরও আসার কথা ছিল এখানে। পাঁচ বছর আগেও রুশদি কলকাতায় এসেছিলেন। তখন কোনও গোলমাল হয়নি। তাই রুশদি ঠিক করেছিলেন, কলকাতায় যাচ্ছেন বলে বইমেলাও ঘুরে যাবেন। পুলিশের কাছে রুশদির যে-সফরসূচি এসে পৌঁছয়, তাতে দেখা যায়, তিনি বুধবার সন্ধ্যা সাতটার পর বইমেলায় যাবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা আর হল না। রুশদির সঙ্গে দীপাও তাঁর কলকাতা সফর বাতিল করেন। কলকাতায় এ দিন সন্ধ্যায় ছবির প্রচারের ওই অনুষ্ঠানে ছিলেন শুধু রাহুল বসু। দীপা মেটার স্বামী ডেভিড হ্যামিল্টন ওই ছবির প্রযোজক। গত বছর জয়পুর সাহিত্য উৎসবে রুশদিকে নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে যোগ দিতে দেওয়া হয়নি। জয়পুরের দেখানো সেই পথেই এ বার হাঁটল কলকাতা।
কলকাতায় বিক্ষোভ।—নিজস্ব চিত্র
কী ঘটেছিল মঙ্গলবার? মহাকরণ সূত্রের খবর, এ বার একেবারে শেষ মুহূর্তে, রাতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে পরোক্ষে রুশদির কাছে এই মর্মে বার্তা পৌঁছে দেওয়া হয় যে, তিনি কলকাতায় কাঙ্ক্ষিত নন। এক জন মধ্যস্থতাকারীর মাধ্যমে তাঁকে তা জানায় সরকার। পুলিশের বক্তব্য, রুশদি শহরে ঢুকলে কিছু মৌলবাদী সংগঠন বিক্ষোভ দেখাত, ছড়াত উস্কানি। কলকাতা পুলিশের স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চ মঙ্গলবার লালবাজারে যে রিপোর্টটি পাঠায়, তাতে বলা হয়, বিমানবন্দরে নামা মাত্র রুশদিকে বিক্ষোভ, স্লোগান, কালো পতাকা দেখানো বা পথরোধের মুখে পড়তে হতে পারে। কিন্তু লালবাজার ও মহাকরণের আশঙ্কা ছিল, রুশদির এই সফর ঘিরে শহর জুড়ে এর চেয়েও বড় অশান্তি হতে পারে। বস্তুত, এ দিন সকালে দু’টি সংগঠনের ’শ দেড়েক যুবক দীর্ঘক্ষণ বিমানবন্দরের সামনে বিক্ষোভ দেখান। রুশদির সফর যে বাতিল হয়ে গিয়েছে, সে খবর তাঁদের কাছে ছিল না। পরে খবর পেয়ে তাঁরা ফিরে যান। রাজ্য সরকারের বক্তব্য, এই ঘটনা থেকেই বোঝা যাচ্ছে, তাঁদের আশঙ্কা অমূলক ছিল না। বিশেষ করে, ২০০৭ সালে তসলিমা নাসরিনকে নিয়ে অভিজ্ঞতার কথা মাথায় রেখে ঝুঁকি নেওয়ার পথে রাজ্য হাঁটতে চায়নি। স্বরাষ্ট্র দফতরের এক কর্তার কথায়, “আমরা রুশদিকে আসতে বারণ করিনি। গোটা পরিস্থিতিটা তাঁকে জানিয়েছিলাম। তার পর তিনি নিজেই সফর বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেন।”
রাজ্যের মুখপাত্র তথা রাজ্যের পুর ও নগরোন্নয়নমন্ত্রী ববি হাকিমের দাবি, রুশদির কলকাতা সফর নিয়ে রাজ্যের কাছে আগাম খবর ছিল না। তিনি বলেন, “কে রুশদিকে ডেকেছে, কেনই বা তিনি কলকাতায় আসবেন? সরকারের কাছে ওঁর আসার ব্যাপারে আগাম খবর ছিল না। কেউ মনে মনে ভেবে থাকতে পারেন বাংলায় যাব, আবার হয়তো ভেবেছেন যাব না এতে আমাদের কী করার আছে?”
রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতরের এক কর্তারও দাবি, “মঙ্গলবার সন্ধ্যায় আমাদের কাছে খবর আসে যে, লেখক সলমন রুশদি বুধবার মুম্বই থেকে কলকাতায় আসছেন। সঙ্গে সঙ্গে মুম্বই পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানানো হয়, ১২ ঘণ্টা আগে খবর পেয়ে রুশদির জন্য নিরাপত্তার বন্দোবস্ত করা কঠিন। কিছু ক্ষণ পর মুম্বই পুলিশ জানিয়ে দেয়, উনি কলকাতায় আসবেন না।”
মন্ত্রী বা স্বরাষ্ট্র দফতরের এক কর্তা এ কথা বললেও ওই দফতরের অন্য এক কর্তা জানিয়েছেন, মঙ্গলবার চূড়ান্ত হলেও পুলিশ কিন্তু দু’তিন দিন আগেই জেনেছিল, রুশদির কলকাতায় আসার সম্ভাবনা আছে। প্রশাসনের একাংশ জানিয়েছে, রুশদির নিরাপত্তার জন্য কলকাতা বিমানবন্দরে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছিল। ঠিক হয়েছিল, বুধবার সকালে দশটা দশ নাগাদ মুম্বই থেকে জেট সংস্থার বিমানে (ফ্লাইট নম্বর নাইন ডব্লিউ ৬১৯) কলকাতায় নামার পরে রুশদিকে সকলের চোখের আড়ালে ছয় বা সাত নম্বর গেট দিয়ে বের করে আনা হবে। তার পর সেখানে গাড়ি বদল করে এক পাঁচতারা হোটেলে নিয়ে যাওয়া হবে। জানা গিয়েছে, সেখানে থেকে তাঁর বাইপাসের ধারে আর একটি পাঁচতারা হোটেলে আসার কথা ছিল ‘মিডনাইটস চিলড্রেন’-এর সাংবাদিক বৈঠকে। রুশদি নিজে চেয়েছিলেন বইমেলার এত কাছে এসে সেখানে ঘুরে যেতে।
রুশদি আসতে চেয়েও আসতে পারছেন না, এটা লজ্জার! প্রশাসন ওঁর আসার ব্যাপারে অন্য রকম ভয় পাচ্ছে, এটা দুঃখের!
নিরাপত্তাজনিত কোনও কারণ থাকলে আলাদা কথা! তবে আদর্শগত কারণে আসা নিয়ে আপত্তি করাটা অযৌক্তিক।
রুশদির ভারতের যে কোনও জায়গায় যাওয়ার অধিকার আছে। কলকাতায় তাঁকে আসতে না-দেওয়া অন্যায়।
লেখকের মত প্রকাশের অধিকার কেড়ে নেওয়া হল। তবে অবাক হইনি। আমার চেয়ে বড় ভুক্তভোগী আর কে?
এত কিছুর পরেও তড়িঘড়ি কেন বিশ্বখ্যাত লেখকের জন্য দরজা বন্ধ করে দিল কলকাতা?
রাজনীতির কারবারিরা বলছেন, পঞ্চায়েত ভোটের মুখে সংখ্যালঘুদের ভাবাবেগে আঘাত লাগতে পারে, এমন কোনও কাজই সরকারের পক্ষে করা সম্ভব নয়। তাই রুশদির কলকাতায় আসার খবর পেয়ে মঙ্গলবার উত্তরবঙ্গ থেকে খোদ মুখ্যমন্ত্রী বইমেলার আয়োজকদের ফোন করে জানতে চান, তাঁরা রুশদিকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন কি না এবং তিনি আসছেন কি না। পুলিশের একটি সূত্রের খবর, বইমেলার আয়োজকরা লিখিত ভাবে জানান যে, রুশদিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। সেই নথি রুশদির কাছে পাঠিয়েও দেওয়া হয়। গিল্ড-এর সভাপতি সুধাংশু দে বলেন, “মঙ্গলবার মুখ্যমন্ত্রীকে জানিয়ে দিই, রুশদিকে গিল্ড-এর পক্ষ থেকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। ক্যালকাটা লিটারারি মিট-এর তরফে মালবিকা বন্দ্যোপাধ্যায় আমাদের জানান, রুশদি নন, তবে রুশদির কাহিনির উপর তৈরি ছবির পরিচালক দীপা মেটা ও রাহুল বসুর উপস্থিত থাকার কথা তাঁদের মঞ্চে।”
সরকারের এই সিদ্ধান্ত যে কিছুটা হলেও প্রভাব ফেলেছে, সেটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের রাজ্য সম্পাদক সিদ্দিকুল্লা চৌধুরীর বিবৃতিতেই। সম্প্রতি রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন কারণে ক্ষুব্ধ সিদ্দিকু্ল্লা কিন্তু এ দিন বলেছেন, “মমতার সরকার শুভবুদ্ধির পরিচয় দিয়ে সংখ্যালঘুদের মন জয়ের চেষ্টা করছে।” তৃণমূলের সংখ্যালঘু সেলের চেয়ারম্যান ইদ্রিশ আলি তো উচ্ছ্বসিত: “রুশদির পশ্চিমবঙ্গে আসা বন্ধ করে দেওয়ার জন্য রাজ্য সরকার তথা মুখ্যমন্ত্রীকে অভিনন্দন।” ঘটনাচক্রে, ২০০৭-এর নভেম্বরে তসলিমাকে ঘিরে অশান্তির ঘটনায় এই ইদ্রিশকেই পুলিশ গ্রেফতার করেছিল।
সিপিএম কিন্তু মাপা ও সতর্ক প্রতিক্রিয়া দিয়েছে। বিধানসভার বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র বলেন, “রুশদির কলকাতায় আসা রাজ্য সরকার চাইছে না, এটা সরকারি ভাবে বলা হয়নি। সরকারি ভাবে কিছু বলা না-হলে তার প্রতিক্রিয়া দেওয়া মুশকিল। নতুন করে সমস্যা তৈরি হতে দেওয়া উচিত নয়।” তসলিমাকে কলকাতা থেকে বিতাড়নের দাবিতে যে-দিন তাণ্ডব চলে, সে রাতেই সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু বলেছিলেন, “তসলিমার থাকা নিয়ে শহরে অশান্তি হলে তাঁর কলকাতা ছেড়ে চলে যাওয়াই উচিত।”
তবে বিজেপি এর তীব্র সমালোচনা করেছে। গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেন, “সলমন রুশদি গুজরাতের যে কোনও শহরে এলে তাঁকে লাল কার্পেট পেতে স্বাগত জানানো হবে।” দলের সর্বভারতীয় মুখপাত্র নির্মলা সীতারামনের কথায়, “সলমন রুশদি, কমলহাসনদের বিরুদ্ধে যা ঘটছে, আমরা সেগুলিকে সঠিক বলে মনে করছি না।” দলের রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ বলেন, “সিপিএমের আমলে তসলিমা নাসরিন আর তৃণমূলের আমলে সলমন রুশদি। তৃণমূল তো সবেতেই সিপিএমের পদাঙ্ক অনুসরণ করছে!”
তসলিমা অবশ্য এ বারের ঘটনায় অবাক নন। বলেছেন, “আমার চেয়ে বড় ভুক্তোভোগী আর কে আছে?” খেদের সঙ্গে তিনি বলেন, “কলকাতা বইমেলায় আমায় যেতে দেওয়া হয় না। আমার বই নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। সবাই যেন ভয় পায়।” রুশদির ঘটনায় তাঁর একটাই কথা বলার, “এ রকম ভাবে গণতন্ত্র চলতে পারে না।”কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কেউই এ বিষয়ে কিছু বলতে রাজি নন। সূত্রের বক্তব্য, আইন-শৃঙ্খলা রাজ্যের বিষয়। তাই গোটা বিষয়টি রাজ্যই জানবে। কংগ্রেস মুখপাত্র পি সি চাকো বলেন, “আমাদের দল স্বাধীন মতপ্রকাশের পক্ষে। তবে আমি জানি না ওখানে কী হয়েছে। কোনও ব্যক্তি তাঁর নিজের মত দিতেই পারেন আর দেশের সব জায়গাতেও যেতে পারেন।”
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.