হাসপাতালে প্রসব-সুরক্ষা নিয়েই সংশয় রাজ্যে
প্রসঙ্গ সেই পরিকাঠামোয় ঘাটতি। যার জেরে মাথা চাড়া দিয়েছে বিস্ময়কর এক সংশয় এ রাজ্যে শিশু-জন্মের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান বেশি উপযোগী, নাকি বাড়ি?
হাসপাতাল-স্বাস্থ্যকেন্দ্রে না বাড়িতে কোথায় জন্মালে শিশু-মৃত্যুর হার কমবে, কিংবা কোথায় মা ও নবজাতকের যথাযথ যত্ন সম্ভব, সাধারণত সে ব্যাপারে কোনও দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকার কথা নয়। এর উত্তর একটাই প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব সব সময়ে কাম্য। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রতিক এক সমীক্ষার পরে সরকার একটু অন্য রকম ভাবতে বাধ্য হচ্ছে। সমীক্ষার ফলাফল দেখে স্বাস্থ্য দফতরও পড়েছে যথেষ্ট অস্বস্তিতে।
যেখানে ডাক্তারেরা বারবার বাড়িতে প্রসবের পরিবর্তে হাসপাতালে আসার কথা বলছেন, যেখানে প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবের হার বাড়াতে চালু হয়েছে ‘জননী সুরক্ষা যোজনা’র মতো প্রকল্প, সেখানে হঠাৎ এ হেন ‘অন্য ভাবনা’ কেন?
কারণ সরকারি সমীক্ষায় ধরা পড়েছে, রাজ্যের বহু জায়গায় হাসপাতালে প্রসব হওয়ার পরেও কিছু শিশুকে বাঁচানো যায় না শুধুমাত্র পরিকাঠামোর অভাবে। অথচ দেখা যাচ্ছে, একই তল্লাটে বাড়িতে জন্মানো বহু শিশু দিব্যি বেঁচেবর্তে থাকছে! এতেই ফাঁপরে পড়েছেন স্বাস্থ্য-কর্তারা। প্রতি ধাপে তথ্য-পরিসংখ্যান সমৃদ্ধ সমীক্ষা-রিপোর্টটিকে তাঁরা উড়িয়ে দিতে পারছেন না। আবার সেটা মেনে নিলে তাঁদের এ-ও মানতে হয় যে, প্রতিষ্ঠানিক প্রসবের সুযোগ-সুবিধাবৃদ্ধি সংক্রান্ত সরকারি দাবির অনেকটাই স্রেফ গালভরা। বস্তুত স্বাস্থ্য-কর্তাদের অনেকে একান্তে কবুল করছেন, সমীক্ষায় উঠে আসা তথ্য জানার পরেও ঘুরে না-দাঁড়ালে প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবের ধারণাটাই ব্যুমেরাং হয়ে ফিরতে পারে।
গত কুড়ি বছরে প্রসব হয়েছে, এমন মায়েদের উপরে সমীক্ষাটি ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটে (আইএসআই) সম্প্রতি পেশ করা হয়। নমুনা হিসেবে বেছে নেওয়া হয় এমন দু’টো জেলাকে, যার একটি প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবের নিরিখে অনেকটা এগিয়ে, অন্যটি বহু গুণ পিছিয়ে। একটি হল হুগলি, অন্যটি মুর্শিদাবাদ। জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশন চালু হওয়ার পরে গত আট বছরে এই দুই জেলায় প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবের হার যথাক্রমে ৮১% ও ৫৩%। সমীক্ষকেরা দুই জেলা ঘুরে মায়েদের কাছে জানতে চেয়েছেন, সন্তান কোথায় জন্মেছে, কেমন আছে, নিজের ও বাচ্চার যত্নের কী কী ব্যবস্থা পেয়েছেন, ইত্যাদি। সমীক্ষা বলছে, প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবের ক্ষেত্রে আগের বারো বছরের তুলনায় সুযোগ-সুবিধা বেড়েছে, সামগ্রিক ভাবে শিশু-মৃত্যুর হারও কমেছে। কিন্তু গত আট বছরে বাড়িতে প্রসব হওয়া যত শিশুর মৃত্যু হয়েছে, হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যক্ষেত্রে জন্মগ্রহণের পরে মৃত্যুর সংখ্যা তার কিছুটা বেশি!
এবং সমীক্ষকদের মতে, পরিকাঠামোর ঘাটতিই এর মূল কারণ।
সমীক্ষকদলের প্রধান রতন খাসনবিশের ব্যাখ্যা, “প্রতিষ্ঠানে রোগীর চাপ বেশি থাকায় ছেড়ে দেওয়ার তাড়াও থাকে বেশি। তাই প্রসব-পরবর্তী যে যত্ন প্রসূতি ও শিশুর দরকার, বেশ কিছু ক্ষেত্রে তার অভাব। হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরার পরে অনেক বাচ্চা অসুস্থ হয়ে পড়ছে, মারাও যাচ্ছে। বাড়িতে স্বাস্থ্য-কর্মী মারফত নজরদারিতেও ঘাটতি।” সমীক্ষকদলের অন্যতম সদস্য অরিজিতা দত্তের আক্ষেপ, “আমরা দেখেছি, বহু হাসপাতালে একই বেডে একাধিক মা-বাচ্চাকে গাদাগাদি করে রাখা। অনেকের ক্রস ইনফেকশন হচ্ছে। বহু জায়গায় ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নার্স না-থাকায় প্রসবের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন দাই, যাঁর কি না ন্যূনতম প্রশিক্ষণও নেই। যা শিশু-মৃত্যুর আশঙ্কা বহু গুণ বাড়াচ্ছে।”
বস্তুত বাড়িতে সন্তানের জন্ম না-দিয়ে হাসপাতাল-স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আসার জন্য সরকারি প্রচারে ঘাটতি না-থাকলেও প্রতিষ্ঠানে প্রসবের মান ও নিরাপত্তা যে বিশেষ বাড়ানো যায়নি, গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে শুরু করে বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল পর্যন্ত নানা ‘প্রতিষ্ঠানের’ হাল তা-ই বলছে। অরিজিতার কথায়, “প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবের বিকল্প নেই। এর হার বাড়াতে না-পারলে শিশু-মৃত্যু কমানো যাবে না। কিন্তু মহিলারা এখন যত সংখ্যায় প্রসবের জন্য হাসপাতালে আসছেন, সেই অনুযায়ী পরিকাঠামো বাড়ছে না। স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এসেও যদি দাইয়ের ভরসায় থাকতে হয়, তা হলে মান বাড়বে কী করে?”
ওঁদের সমীক্ষা-রিপোর্ট সরকারকে পেশ করা হয়েছে। কী বলছেন স্বাস্থ্য-কর্তারা? তাঁরা মানছেন, পরিস্থিতি না-পাল্টে নিছক প্রসূতিকে হাসপাতালে পাঠানোর প্রচার চালিয়ে দীর্ঘমেয়াদি লাভ সম্ভব নয়। মা-শিশুর মৃত্যু-হার কমানোর লক্ষ্যে মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গঠিত টাস্ক ফোর্সের চেয়ারম্যান ত্রিদিব বন্দ্যোপাধ্যায়ও সমস্যাটা মেনে নিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য, “দেড় বছর আগে জেলা হাসপাতাল ও মেডিক্যাল কলেজ মিলিয়ে নবজাতক শয্যা ছিল ৭২টি। তা বেড়ে হয়েছে দেড় হাজার। আমরা চেষ্টা চালাচ্ছি।” ত্রিদিববাবুর আশ্বাস, ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র সংস্কারের বিস্তারিত পরিকল্পনা তাঁদের রয়েছে। হাসপাতাল-ফেরত শিশুদের উপরে স্বাস্থ্য-কর্মীরা কী ভাবে নিয়মিত নজর রাখবেন, তা নিয়েও ভাবনা-চিন্তা চলছে। “দ্রুত ব্যবস্থা হবে। আশা করা যায়, অল্প কিছু দিনে অবস্থা বদলাবে।” বলছেন ত্রিদিববাবু।
আপাতত সেই পরিবর্তনেরই অপেক্ষা।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.