সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যেতে বসেছে সেই সব সাদা-কালো পিকনিক। সব কিছু আরও রঙিন, আরও উজ্জ্বল। জেনারেশন ওয়াই ঝক্কি ছাড়াই চাইছে আরও বেশি কিছু। আর এখানেই পাল্টে যাচ্ছে পিকনিকের পুরনো হিসেব নিকেশ। নতুন পিকনিককে স্বাগত জানাচ্ছেন ব্যবসায়ীরাও। ফলে লক্ষ্মী এখন শুধু বাণিজ্যেই নয়, বসত করছেন পিকনিকেও।
এক ফোনে
প্রথম ফোনটা এসেছিল নবদ্বীপের নিরঞ্জন দেবনাথের কাছে। কলেজের বন্ধু রবীন এখন পূর্বস্থলিতে। সেখানে পাখিরালয়ে পিকনিক করতে যাওয়া একটি দলের সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে তিনি জেনেছিলেন, এঁরা তার কলেজের বন্ধু নিরঞ্জনের পাড়ার লোক। তারপর নিরঞ্জনের টেলিফোন নম্বর নিয়ে ফোন করতে বেশি সময় লাগেনি। সেই ফোনেই ২৬ জানুয়ারি পুরনো প্রায় দশ জন বন্ধুর পরিবার মিলিয়ে নবদ্বীপের গঙ্গার ধারে হল পিকনিক কাম গেটটুগেদার। নবদ্বীপ, পারুলিয়া, কৃষ্ণনগর, বজবজ এমনকি চিত্তরঞ্জন থেকে ছুটে এসেছিলেন ছোটবেলার দশ বন্ধু। তবে পিকনিকের আয়োজনে অবশ্য কাউকেই খুব বেশি ব্যস্ত হতে হয়নি। স্থানীয় বাসিন্দা নিরঞ্জনের ডেকরেটার্সের ব্যবসা। সমস্ত ব্যবস্থা তিনিই করেছিলেন। তাঁর কথায়, ‘‘এখন তো এক ফোনেই পিকনিক। আপনাকে শুধু বলতে হবে কোথায়, কতজন যাবেন আর কি খাবেন ব্যস, হয়ে গেল।’’ চলতি মরসুমে পিকনিকের এটাই লেটেস্ট ট্রেন্ড।
|
শীতের ছুটিতে
ছুটির ত্র্যহস্পর্শ! শুক্রবার ছিল ফতেহা-দোয়াজ-দহম। শনিবার প্রজাতন্ত্র দিবস। তৃতীয় দিনটি সাপ্তাহিক ছুটির দিন রবিবার। মাসের শেষে লম্বা ছুটির এমন সোনালি সুযোগ কি হাতছাড়া করা যায়? বিশেষ করে যখন ফের জাঁকিয়ে ফিরে এসেছে শীত। জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে হঠাৎ পাওয়া টানা তিন দিনের এই ছুটির সুযোগ হাতছাড়া করতে চাননি কেউই। পিকনিক আর পর্যটন নিয়ে তুমুল ব্যস্ত থেকেছেন তাঁরা। কৃষ্ণনগরের পর্যটন ব্যবসায়ী উজ্জ্বল চৌধুরী যেমন বলেন, ‘‘এই টানা ছুটিতে পিকনিকের আয়োজন করতে আমরা হিমসিম খেয়ে গিয়েছি। অফিস কলিগ থেকে ছাত্রছাত্রী সকলেই এই ছুটির দিনগুলোকে বেছে নিয়েছিলেন। তাই এবারে ২৫ ও ২৬ জানুয়ারি অসম্ভব চাপ ছিল।’’ তবে স্কুলগুলোতে সদ্য নতুন মরসুমের পড়াশোনা শুরু হওয়ায় দূরের হাতছানিতে সাড়া দেননি অনেকেই। তাই কাছেপিঠের বেড়ানো বা পিকনিকেই মজেছিলেন আট থেকে আশি সকলেই।
‘ট্যুর’ নাকি ‘প্যাকেজ’
পিকনিকের সেই চেনা ছবিটা অবশ্য পাল্টে গিয়েছে গত কয়েক বছরে। নিতান্ত সাদামাটা বনভোজন বা চড়ুইভাতি এখন ‘পিকনিক ট্যুর’ বা ‘প্যকেজ পিকনিকে’ পরিণত হয়েছে। নতুন প্রজন্মের কাছে এই পিকনিক ট্যুর বা প্যাকেজ পিকনিক ক্রমশ হট কেক হয়ে উঠছে। কলেজ পড়ুয়াদের কথায়, ঝামেলা একেবারেই নেই। শুধু কোথায়, ক’জন যাব আর কি খাব এটুকু জানিয়ে দিলেই কেল্লাফতে। কৃষ্ণনগরের পর্যটন ব্যবসায়ী উজ্জ্বল চৌধুরী বলেন, ‘‘একদিন ও একরাতের দূরত্ব বা খুব সকালে বেরিয়ে বেশি রাত হলেও বাড়ি ফিরে আসা যায় এমন স্পটেই পিকনিক করার চাহিদা ক্রমশ বাড়ছে। আমরা এই ধরণের পিকনিকের নাম দিয়েছি পিকনিক ট্যুর। মানে ধরুন, পিকনিক হল আবার সেই সঙ্গে বেড়ানোটাও। আর খরচটাও থাকে নাগালের মধ্যেই। ২০০ থেকে ৩০০ টাকার মধ্যে যাতায়াত খাওয়া সবই হয়ে যায়। এই ধরণের পিকনিকে এখন ঝুঁকছেন সকলেই।” আর প্যাকেজ পিকনিকটা কী রকম? নবদ্বীপের কয়েকজন ক্যাটারিং ব্যবসায়ী জানাচ্ছেন, ‘‘প্যাকেজ পিকনিকের স্পটটা নির্দিষ্ট থাকে। সেই স্পটটা ঠিক করেন পিকনিক পার্টি। বাকি সব সামলাতে হয় আমাদেরকেই। সকালের টিফিন থেকে বিকেলের স্ন্যাক্স কিংবা খাবার টেবিল সবটাই আমাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। পিকনিক পার্টির শুধু ‘এসো বসো আহারে।’
পিকনিকে বসতি লক্ষ্মী
পিকনিকের ‘দিনভর হুল্লোড়’ এর অন্য পিঠে জড়িয়ে রয়েছে স্থানীয় মরসুমি অর্থনীতি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই অর্থনীতি আরও পোক্ত হচ্ছে বলেই মত স্থানীয় ব্যবসায়ীদের। কিন্তু কী ভাবে? এই প্রসঙ্গে নবদ্বীপের দীর্ঘদিনের ডেকরেটার্স ব্যবসায়ী নিরঞ্জন দেবনাথ বলছেন, ‘‘বছর পাঁচেক আগেও পৌষ মাস আমাদের কাছে একেবারে সর্বনাশ না হলেও অফ সিজন ছিল। হাতেগোনা দু’একটি শ্রাদ্ধানুষ্ঠান ছাড়া কাজকর্ম তেমন কিছুই হত না। কিন্তু এই বছর শুধু পৌষ মাসেই পিকনিকের কারণে যে কাজ হয়েছে তা অভাবনীয়।” একই ভাবে ক্যাটারিং ব্যবসায়ী শান্তনু ভৌমিক, নিতাই বসাক কিংবা মাইক ব্যবসায়ী বাপি সূত্রধর প্রত্যেকেই একবাক্যে জানিয়েছেন ভরা পৌষেও এবারের বাজার ছিল চাঙ্গা সৌজন্যে পিকনিকের এই নতুন ট্রেন্ড পিকনিকের দায় দায়িত্ব যখন পিকনিক পার্টি নিতে চাইছেন না তখনই হিসেবটা দাঁড়াচ্ছে- ফেল কড়ি মাখো তেল বেকার যুবকদের সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে এসেছেন স্থানীয় ছোট বড় ব্যবসায়ীরাও আর তাই পিকনিকের সঙ্গে সঙ্গেই যুক্ত হয়ে পড়ছে পর্যটন, ডেকরেটার্স, ক্যটারিং, মাইক সহ সবকিছুই।
এক ঢিলে দুই পাখি
নিরঞ্জনবাবুর কথায়‘‘এখন যাঁরা পিকনিক করতে যান তাঁরা কিন্তু পিকনিকের ধারণাটা টেলিভিশন, সিরিয়াল কিংবা সিনেমা থেকে পান। ফলে মাঠের মধ্যে কার্পেট, চেয়ার- টেবিল পেতে, বেলুন, রঙিন ছাতা টাঙিয়ে ডি.জে বাজিয়ে যে পিকনিক তাতে বিভিন্ন স্তরের ব্যবসায়ীরা উপকৃত হচ্ছেন। এ বছরে আমার কাছ থেকে জিনিসপত্র নিয়ে দীঘা তো বটেই পুরী পর্যন্ত গিয়ে পিকনিক করে এসেছে একাধিক দল। মরসুম শেষে তাতে লাভবান হচ্ছি আমরাই।” ক্যাটারিং ব্যবসায়ী শান্তনু ভৌমিক বলেন, ‘‘পিকনিককে ঘিরে ব্যবসায় দুটো দিক। তার একটা তো আর্থিক। অন্যটা প্রচারের দিক। পঞ্চাশ ষাট জনের একটি পিকনিক দল থেকে আমরা সারা বছরের অন্যান্য অনেক বড় কাজের অর্ডার পাচ্ছি। তাছাড়াও যারা আমাদের ক্যাটারিং-এ সার্ভিসিং, রান্না, ধোয়ামোছার কাজের সঙ্গে যুক্ত তাঁরাও এই মরসুমে প্রচুর উপরি উপার্জন করে নিতে পারছেন। পাশাপাশি আমাদেরও কিছুটা বেড়ানো হয়। হিসেব কষে দেখেছি এ বছর শীতকালে কোনও কোনও ছুটির দিনে একসঙ্গে তিনটে বা চারটে পিকনিকের কাজ করতে হয়েছে। যেটা সব ধরণের ব্যবসায়ীদের কাছে অত্যন্ত ইতিবাচক লক্ষণ।’’
নবদ্বীপ ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক উত্তমকুমার সাহা বলেন, ‘‘যদি বাণিজ্যিক দিক থেকে বললে ইদানীংকালে যে ধরণের পিকনিক হচ্ছে তাতে সব ধরণের ব্যবসায়ীরাই লাভবান হচ্ছেন। বিশেষ করে পিকনিকের হাত ধরে বহু বেকার যুবক নানা ধরণের ব্যবসা শুরু করার সুযোগ পাচ্ছেন। পিকনিকের ছোট পরিসরে কাজ করতে করতে এরা নিজেদের আত্মবিশ্বাস ও পরিচিতি দুই-ই বাড়িয়ে তুলতে পারছেন। ফলে বাণিজ্যিক দিক থেকে এই নতুন ধরণের পিকনিককে আমরা স্বাগত জানাই।” |