দিল্লির গণধর্ষণ-কাণ্ডের ষষ্ঠ অভিযুক্ত তাহা হইলে অপ্রাপ্তবয়স্ক হিসাবে ছাড় পাইয়া গেল। জন্মতারিখে ছয় মাসের এ দিক ও দিকের উপর তবে আক্ষরিক অর্থেই জীবনমরণ নির্ভর করে! বিদ্যালয়ের প্রদত্ত নথি অনুযায়ী ১৭ বৎসর ৬ মাস বয়স, তাই ‘বালক’টি অবশিষ্ট পাঁচ অভিযুক্তের জন্য নির্ধারিত শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হইতে রেহাই পাইল, তাহার জন্য অন্য কোনও গুরু শাস্তিও প্রযোজ্য নহে। স্বভাবতই দুর্ভাগা মেয়েটির পরিবার মর্মাহত। তাঁহারা কন্যার মুখে শুনিয়াছিলেন, সেই কালসন্ধ্যায় তাহার উপরে যে আমানুষিক অত্যাচার চলে, তাহাতে অন্য সঙ্গীদের তুলনায় এই ‘বালকটি’ কোনও অর্থে কম অপরাধী ছিল না, বরং তাহার নিজহস্তে কৃত কর্মের বর্ণনা শুনিলে কাঁপিয়া উঠিতে হয়। ওই কন্যার স্বজনরা সুতরাং উচ্চতর আদালতে মামলার প্রস্তাব বিবেচনা করিতেছেন। তাঁহারা নিজেদের কন্যা হারাইয়াছেন, শোকের প্রাবল্য স্বভাবতই তাঁহাদের ক্ষোভে উদ্বেল করিতেছে। কিন্তু জুভেনাইল জাস্টিস বোর্ডের এই সিদ্ধান্ত কেবল তাঁহাদের নহে, দেশ জুড়িয়া অসংখ্য মানুষকেই প্রবল বিচলিত করিতেছে। ভারতীয় আইনে অপ্রাপ্তবয়স্কদের জন্য লঘু শাস্তির এই অযৌক্তিক ব্যবস্থা বিষয়ে মৌলিক ও সঙ্গত প্রশ্ন উঠিতেছে। ঠিক কোন বয়স প্রাপ্তবয়স্ক বলিয়া বিবেচিত হইবার বয়স, বিষয়টি পুনর্বিবেচনার দাবি উঠিয়াছে। সেই বয়ঃসীমা কমাইয়া আনিবার দাবি ধ্বনিত হইতেছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই অপ্রাপ্তবয়স্ক অপরাধীরা কী ভাবে ছাড়া পাইয়া আবারও অপরাধে (গুরুতর অপরাধেই) নিমজ্জিত হইয়া সামাজিক পীড়ার কারণ হইয়া দাঁড়ায়, তাহার বহুবিধ দৃষ্টান্ত সামনে আসিতেছে। শোরগোলের মধ্যে যাহা ক্রমেই স্পষ্ট: জুভেনাইল জাস্টিস বা অপ্রাপ্তবয়স্কের বিচার-বিধি এক বার গোড়া হইতে ফিরিয়া ভাবিবার অবকাশ এখন, এই মুহূর্তে দিল্লির ভয়াবহ ঘটনাটির সূত্রে।
প্রথমেই বলা দরকার, এই ‘বালক’টির জন্য মৃত্যুদণ্ডই সাজা হওয়া উচিত কি না, তাহা ভিন্ন প্রশ্ন। আসল কথা, তাহার সহিত অন্যান্য অভিযুক্তের মধ্যে এতখানি তারতম্য করা উচিত হইতেছে কি না। আসল কথা, প্রাপ্তবয়স্ক ও অপ্রাপ্তবয়স্কের মধ্যে অপরাধের গুরুত্বের এতখানি ব্যবধান হওয়া উচিত কি না। নির্ধারিত বয়ঃসীমা আঠারো বৎসর না হইয়া ষোলো বা সতেরো বা তেরো যাহা খুশি হইতে পারে, ইহা কেবলই একটি সংখ্যামাত্র। আসল কথা, ঠিক কোন যুক্তিতে জঘন্যতম হিংস্র অপরাধ কম বয়সে করিলে তাহা কম শাস্তিযোগ্য, বেশি বয়সে করিলে তাহা বেশি শাস্তিযোগ্য?
সাধারণ ভাবে, যুক্তিটি সংশোধনের। প্রাপ্তবয়স্ক হইবার আগে মানুষের বিচারবুদ্ধি সমগ্রত বিকশিত হয় না, তাই তাহাদের ক্ষেত্রে মারাত্মক অপরাধের দায়ে ধৃত ব্যক্তিকেও আত্মসংশোধনের সুযোগ দেওয়া দরকার: যুক্তি ইহাই। কিন্তু শাস্তি না দিলেই সেই সংশোধন নিশ্চিত করা যায়? শাস্তির মাধ্যমে সংশোধনের ব্যবস্থার কথাও ভাবা যায় না কি? সর্বাধিক গুরুতর প্রশ্ন: আত্মসংশোধনের অধিকার এবং সুযোগ কি কেবল অপ্রাপ্তবয়স্কেরই প্রাপ্য? প্রাপ্তবয়স্ক কী দোষ করিল? কোন নিয়মে আঠারো বৎসর পার হইলেই ভুল বুঝিবার, নিজেকে সৎপথে আনিবার সম্ভাবনা কমিয়া যায়? আর যদি অপরাধের মাত্রা কমাইবার কথাই ভাবা হয়, অর্থাৎ নিষেধকের যুক্তিতে অপ্রাপ্তবয়স্ককে লঘু শাস্তিদানের কথা ভাবা হয়, সে ক্ষেত্রে বলিতে হয়, ইহা মনকে চোখ ঠারা ভিন্ন কিছু নহে। অপরাধমাত্রা কমিবার বদলে বরং অল্পবয়সি অপরাধীদের উৎসাহদানের কাজটি ইহাতে উত্তমরূপে সাধিত হয়। আসল কথা, অপরাধের কোনও বয়স হয় না, অপরাধের গুরুত্বই একমাত্র বিচার্য। যে অপরাধের গুরুত্ব যেমন, বয়স-নিরপেক্ষ ভাবে তাহার শাস্তিও তেমন হউক। নির্ভয়ের উদাহরণটিতে স্পষ্ট বোঝা যায়, এখানে এই ব্যক্তির চিন্তাভাবনা, কর্মপন্থা কোনও কিছুই যখন অপ্রাপ্তবয়স্ক-সুলভ ছিল না, তাহার ফলাফল অর্থাৎ শাস্তিও অপ্রাপ্তবয়স্কতার নিরিখে নির্ধারিত হওয়া উচিত নহে। বহু দশক ধরিয়া একটি অত্যন্ত অসঙ্গত বিধান চলিয়া আসিতেছে। দিল্লির ধর্ষণকাণ্ড অনেক ক্ষেত্রে দেশকেই অভূতপূর্ব ভাবে কাঁপাইয়া দিয়াছে। এই বিশেষ ক্ষেত্রটিতেও গভীর ও সুচিন্তিত পরিবর্তন আসুক, প্রত্যাশা ছিল। প্রত্যাশায় ছাই পড়িল। |