কলকাতা বিমানবন্দরের আন্তর্জাতিক টার্মিনাল। সকাল সাড়ে দশটা। ট্রলি-ব্যাগ হাতে ঢাকার বিমান ধরার জন্য দাঁড়িয়ে ছিলেন এক যাত্রী, রোহিত কান্দোই। অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “কোনও গণ্ডগোল হয়েছে? নাকি বড়সড় কোনও ভিআইপি আসছেন?”
চার দিকে থিকথিক করছে পুলিশ। কয়েক নিমেষের মধ্যেই ভুল ভাঙল রোহিতের। নাহ্, তেমন বড় কোনও গণ্ডগোল নয়, বিমানবন্দরের কর্মী ইউনিয়নের ভোট চলছে মাত্র! আন্তর্জাতিক বিল্ডিং-এর কাচে সাঁটা প্রচুর পোস্টার। সামনে বড় বড় ফ্লেক্স, প্ল্যাকার্ড, পতাকা!
ক’দিন আগেই ঢাকঢোল পিটিয়ে উদ্বোধন হয়েছে ঝাঁ চকচকে নতুন টার্মিনালের। সেই টার্মিনালকে সামনে রেখেই নিজেকে নতুন করে শো-কেস করার কথা ভাবছে কলকাতা বিমানবন্দর। মুখ্যমন্ত্রী নিজে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বলে গিয়েছেন, রাজ্যে লগ্নি টানতে এই বিমানবন্দর অনেকটা ভূমিকা নেবে বলে আশা করছেন তাঁরা। কিন্তু ক’দিনের মধ্যে বিমানবন্দরের এ কী চেহারা? বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ থেকে রোহিতের মতো সাধারণ যাত্রী, সবাই হতবাক।
মঙ্গলবার গোটা দিন ধরে দেশের অন্যতম প্রধান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটি কার্যত ছিল বহিরাগতদের হাতে। রাস্তার মাঝখানে ব্যারিকেড করে ১৪৪ ধারা জারি। শ’চারেক পুলিশের সঙ্গে র্যাফ, সিআইএসএফ জওয়ান। তবু আটকানো যায়নি বহিরাগতদের দাপাদাপি। টার্মিনালের উল্টো দিকে গাড়ি রাখার জায়গায় অজস্র অচেনা মুখের ভিড়। রীতিমতো সন্ত্রস্ত মুখে ঘোরাফেরা করছেন বিমানবন্দরের অধিকর্তা বি পি শর্মা, সিআইএসএফ কম্যান্ডান্ট রাকেশ রাজা, পুলিশের কর্তারা। কর্তৃপক্ষের এক অফিসারের কথায়, “ভাগ্যিস! নতুন টার্মিনাল রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব এই কর্মীদের হাতে তুলে দিইনি!” তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায়কে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “বিমানবন্দরের কর্মীরাও মানুষ। ফলে ভোট ঘিরে তাঁদের উৎসাহ থাকবেই।” তবে তাঁর মতে, ভোটটা প্রশাসনিক বিল্ডিংয়ে করা হলে সেটা যাত্রীদের চোখে পড়ত না। বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষই বিল্ডিং পরিবর্তন করে ভোটটা আন্তর্জাতিক বিল্ডিংয়ে এনেছেন বলে তাঁর দাবি। কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, প্রশাসনিক ভবন পাল্টেছে। নতুন ভবন কাচ দিয়ে ঘেরা। সেখানে ভোট করানোটা ঝুঁকির হতে পারত। |
এক দিকে সিপিএম সমর্থিত এমপ্লয়িজ ইউনিয়ন। অন্য দিকে, কংগ্রেসের কামগর ইউনিয়ন। যাদের সঙ্গে রয়েছে তৃণমূল। সব মিলিয়ে ভোটার সংখ্যা ১৪৯২। আন্তর্জাতিক বিল্ডিং-এর গায়েই ভোটকেন্দ্র। সকাল সাতটা থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত ভোট পড়ল ১১৭১ (রাতে গণনা শেষে ২০০ ভোটে জিতেছে কামগর)। আর তারই জন্য সারা দিন ধরে কার্যত চলল যুদ্ধকালীন তৎপরতা। মঙ্গলবারের কর্মী-ইউনিয়নের ভোটের জন্য পাঁচ বছর আগে, সিপিএম জমানায় যেমন লাল করে দেওয়া হয়েছিল চারপাশ, এ বার কামগর ইউনিয়নের হলুদ পতাকা ও সূর্য চিহ্ন দখল করেছে সেই জায়গা। বিস্মিত অধিকর্তা বি পি শর্মার প্রশ্ন, “আপনাদের রাজ্যে কি সমস্ত ভোটই এত জাঁকজমক করে হয়?”
বাস্তবিক মঙ্গলবারে বিমানবন্দরের ভোট যেন কেশপুর-নন্দীগ্রামের ভোটকেও হার মানাল। সকাল থেকেই বিমানবন্দরের চারপাশ ঘিরে নিয়েছিল বহিরাগত যুবকের দল। স্রেফ ভোটারদের ভয় দেখাতে নিয়ে আসা হয়েছিল তাঁদের। তেমনই এক যুবক জানালেন, তাঁর নাম রতন সেন। মামা দীপক রায়কে চশমা পৌঁছে দিতে বিমানবন্দরে এসেছেন বলে দাবি। দীপকবাবু কি বিমানবন্দরে কাজ করেন? উত্তর, “না।” এর চেয়ে বেশি কিছু জানতে চাইবার আগেই রতন সরে পড়লেন। তবে টার্মিনালের সামনে সকাল থেকে তৃণমূলের হয়ে যিনি সবচেয়ে সক্রিয় ছিলেন সেই বিশ্বনাথ দাস অকপটে স্বীকার করলেন, তিনি দলের কর্মী। বিমানবন্দরে কাজ করেন না। শুধু ভোট ‘করানোর’ জন্যই তাঁকে ডেকে আনা হয়েছে।
ভোটপর্ব শুরু থেকেই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে বিমানবন্দর চত্বর।
যাত্রীদের সামনেই কয়েক জন ভোটারকে ধাক্কাধাক্কি করা হয়। অভিযোগ, বিরোধী পক্ষে ভোট দিতে পারেন এমন কর্মীদের পথ আটকানো হচ্ছিল। বিমানবন্দরের দমকল বিভাগের সুপারভাইজার দেবাশিস মুখোপাধ্যায়ের অভিযোগ, “ভোট দিতে এসেছিলাম। গাড়ি রাখার সময়ে বাইরের ছেলেরা আমাকে মারধর করেছে।”
সংবাদমাধ্যমের সামনে এত কথা বলার জন্য বিশ্বনাথ দাস ও তাঁর দলবল এসে সরিয়েও নিয়ে গিয়েছেন দেবাশিসবাবুকে। এ সমস্তই ঘটেছে যাত্রীদের সামনেই। রোহিতের কথায়, “এত দিন বলতাম পুওর স্টেট। এখন যেন আরও অধঃপতনের দিকে এগোচ্ছি। না হলে একটা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের এই হাল হয়?”
অবাক বিমানবন্দরের ভোটাররাও। ভোট দিয়ে বেরিয়ে এক মহিলা কর্মী বলেন, “এত দিন চাকরি করছি। এমনটা দেখিনি! কী রকম ভয় করছে!” এর মাঝেই এক কর্মী এসে তাঁকে ধমক মেরে বললেন, “এখন এত কাঁদছ? কিন্তু আগে যে ওরা ঘরে ঢুকে ঢুকে মারত, সে কথা বললে না তো!”
যাঁদের সম্পর্কে বলা, তাঁদের বেশির ভাগ নেতা-কর্মী-সমর্থকই এ দিন ভোট দিতে পারেননি বলে অভিযোগ উঠেছে। সিপিএম নেতা অমিতাভ নন্দীর কথায়, “ভোটের নামে প্রহসন হয়েছে। পুলিশের চোখের সামনেই আমাদের কর্মীদের মারধর করা হয়েছে।”
ভোট দিতে পারুন আর না পারুন, সব দলের কর্মীরাই যেহেতু নির্বাচনে ব্যস্ত, পুরনো টার্মিনালের ভিতরে সাফাইয়ের কাজও ব্যাহত হয় এ দিন। দুবাই থেকে কলকাতায় নেমে এক যাত্রী শান্তনু দত্ত-র প্রশ্ন, “বিমানবন্দর নোংরা করে এ সব কী হচ্ছে? আমরা কি পিছন দিকে হাঁটছি?” |