অর্থমন্ত্রী ও আমজনতার মুখে সামান্য হলেও হাসি ফোটাল রিজার্ভ ব্যাঙ্ক।
আর্থিক বৃদ্ধির হারকে চাঙ্গা করতে ন’মাস পরে সুদের হার কমিয়ে অর্থ মন্ত্রকের পাশে দাঁড়াল রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। বহু দিনের অনুরোধ-উপরোধের পর পি চিদম্বরমের আবেদনে সাড়া দিলেন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর ডি সুব্বারাও। একই সঙ্গে তিনি সুদের হার কমানো এবং নগদ জোগান বাড়ানোর সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলেন। যে হারে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলিকে টাকা ধার দেয়, সেই ‘রেপো রেট’ কমল ০.২৫%। একই হারে কমলো ‘ক্যাশ রিজার্ভ রেশিও’ (ব্যাঙ্কগুলিকে যে অনুপাতে নগদ অর্থ রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কাছে জমা রাখতে হয়)।
|
ডি সুব্বারাও |
আমজনতার জন্য সুখবর হল, এর ফলে ব্যাঙ্কগুলি ঋণের উপর সুদের হার কমাতে পারে। বিশেষ করে বাড়ি-গাড়ি কেনার ক্ষেত্রে। যাঁরা ইতিমধ্যেই ঋণ নিয়েছেন, তাদের মাসিক কিস্তির (ইএমআই) পরিমাণও কমতে পারে। আজ রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ঘোষণার পরেই স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া-সহ প্রধান সরকারি-বেসরকারি ব্যাঙ্কের শীর্ষকর্তারা ইঙ্গিত দিয়েছেন, তারা এই সুরাহা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে আগ্রহী। বস্তুত, এ দিন রাতেই ০.২৫% শতাংশ সুদ কমানোর কথা ঘোষণা করেছে আইডিবিআই-সহ একাধিক বাণিজ্যিক ব্যাঙ্ক। স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া বুধবার এই সংক্রান্ত ঘোষণা করতে পারে বলে আশা শিল্প মহলের। সুদ কমানোর ইঙ্গিত দিয়েছে এলআইসি হাউসিং ফিনান্স-ও।
প্রাথমিক হিসেব অনুযায়ী, যদি কেউ বাড়ি কেনার জন্য ২০ বছরের মেয়াদে ৫০ লক্ষ টাকা ঋণ নিতে চান, তা হলে সুদের হার ১১.২৫% থেকে কমে ১১% হলে, ইএমআই কমবে প্রায় ৮৫০ টাকা। তবে একই সঙ্গে আশঙ্কাহল, সেভিংস অ্যাকাউন্ট, ফিক্সড ডিপোজিটের সুদ কমতে পারে।
রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাচ্ছে কেন্দ্র এবং শিল্পমহল। সুব্বারাওয়ের ঘোষণার পরেই মুম্বইয়ের শেয়ার সূচক ঊর্ধ্বগামী হয়। তবে লগ্নিকারীরা লাভের টাকা ঘরে তোলার জন্য শেয়ার বেচতে থাকায় দিনের শেষে সেনসেক্স পড়ে ১১২ পয়েন্ট। তাতে অবশ্য রিজার্ভ ব্যাঙ্কের মূল উদ্দেশ্যের হানি হয়নি বলেই মনে করছে শিল্পমহল। তাদের বক্তব্য, রেপো রেট কমিয়ে ৭.৭৫%-এ নিয়ে আসায় শুধু বাড়ি-গাড়ি নয়, কর্পোরেট সংস্থাগুলি শিল্পের জন্য যে ঋণ নেয়, তার সুদও কমবে। পাশাপাশি, ক্যাশ রিজার্ভ রেশিও কমে ৪% হওয়ায় ব্যাঙ্কগুলি বাড়তি নগদ ১৮ হাজার কোটি টাকা হাতে পাবে। ফলে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে তারা আরও উদার হতে পারবে। অনেকেই সুদের হার বেশি বলে বাড়ি-গাড়ি কেনা স্থগিত রেখেছেন। সুদ কমার কারণে তাঁরা সিদ্ধান্ত বদলালে আবাসন ও গাড়ি শিল্পে জোয়ার আসবে। তাই আবাসন সংস্থাগুলির সংগঠন ক্রেডাই সকলের আগে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে।
ঠিক এই কারণেই অর্থমন্ত্রী সুদের হার কমানোর আর্জি জানাচ্ছিলেন। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক শেষ বার সুদের হার কমিয়েছিল গত বছর এপ্রিলে। তার পরে আর্থিক বৃদ্ধির হার এক দশকে সব থেকে কমে এসেছে। চিদম্বরম বলেছিলেন, সুদের হার কমলে শিল্পোদ্যোগীদের ঋণের খরচ কমবে। নয়া লগ্নি আসবে। উৎপাদন বাড়বে। কিন্তু রক্ষণশীল অর্থনীতিবিদ সুব্বারাওয়ের পাল্টা যুক্তি ছিল, আগে মূল্যবৃদ্ধির হারে লাগাম পরাক সরকার। তবেই সুদের হার কমানো সম্ভব হবে। কারণ মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে রাখাই রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাথমিক দায়িত্ব। মতাদর্শের এই সংঘাত কার্যত সম্মুখ সমরে পরিণত হয়েছিল। সুব্বারাও আজ অবশ্য বলেন, “মূল্যবৃদ্ধি অনেকটাই কমে এসেছে, তাই আমরা আর্থিক বৃদ্ধি বাড়াতে সহায়ক সুদ নীতি নিচ্ছি।” তিনি মনে করছেন, মার্চে মূল্যবৃদ্ধির হার ৬.৮%-এ নেমে আসবে। প্রসঙ্গত, ডিসেম্বরে মূল্যবৃদ্ধির হার গত তিন বছরে সর্বনিম্ন, ৭.১৮%।
তবে আজ ক্রমবর্ধমান রাজকোষ ঘাটতি ও আমদানি-রফতানির ঘাটতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সুব্বারাও। এই দুই ঘাটতি কমাতে চিদম্বরম আগামী বাজেটে কী পদক্ষেপ করছেন, সে দিকে তিনি কড়া নজর রাখবেন বলেও জানিয়ে দিয়েছেন।
যোজনা কমিশনের উপাধ্যক্ষ মন্টেক সিংহ অহলুওয়ালিয়ার মতে, সম্প্রতি এক গুচ্ছ সংস্কারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্র। খুচরো ব্যবসা-সহ বেশ কিছু ক্ষেত্রে বিদেশি লগ্নির পথ প্রশস্ত করা হয়েছে। তেলের ভর্তুকিতে রাশ টানার কাজ চলছে। তাই রিজার্ভ ব্যাঙ্ক সুদের হার কমিয়েছে। তাঁর কথায়, “দীর্ঘ মন্দার পর অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। এখন সুদের হার কমা নতুন লগ্নির ক্ষেত্রে উৎসাহ বাড়ানোর কাজ করবে।” প্রধানমন্ত্রীর আর্থিক উপদেষ্টা পরিষদের চেয়ারম্যান সি আর রঙ্গরাজন মনে করছেন, মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে থাকলে ভবিষ্যতে সুদের হার আরও কমবে। অবশ্য অনেক অর্থনীতিবিদেরই মত, বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত সুদ ছাড়াও দ্রুত ছাড়পত্র, করের হার-সহ আরও অনেক কিছুর উপর নির্ভর করে। সে দিকেও নজর দিতে হবে সরকারকে । |