হাসপাতালের শয্যার ধারে হাতে হাত মিলেছিল। এ বার সুর মিলল!
আসন্ন পঞ্চায়েত ভোটে ‘সন্ত্রাসমুক্তি’র জন্য লড়াই চালানোর ডাক দিলেন আব্দুর রেজ্জাক মোল্লা। আর রেজ্জাকেরই জেলায় দাঁড়িয়ে সেই আহ্বানের প্রতিধ্বনি করলেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য! জনতার কাছে দু’জনেরই আবেদন, তোলাবাজির হাত থেকে উদ্ধার করতে হবে গরিবের পঞ্চায়েতকে।
সিপিএমের অন্দরের সমীকরণে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এবং প্রাক্তন ভূমিমন্ত্রীর দূরত্ব আপাতত আড়ালে চলে গিয়েছে রেজ্জাকের উপরে হামলার পরেই। রেজ্জাক-কাণ্ডের প্রতিবাদে পথে নেমেছেন বুদ্ধবাবু। এ বার বুদ্ধবাবুর সমাবেশে মোবাইল-বাহিত হয়ে হাজির হলেন রেজ্জাক! হাসপাতালে বন্দি থাকতে থাকতেই বারুইপুরে রবিবারের সমাবেশের জন্য তাঁর বার্তা রেকর্ড করে পাঠিয়েছিলেন ক্যানিং পূর্বের প্রবীণ বিধায়ক। এক সিপিএম কর্মীর হাতে মাইক্রোফোনের সামনে-ধরা মোবাইল থেকে রেজ্জাকের ঘোষণা, “মানুষ সন্ত্রাসমুক্তি চাইছে। এই লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিতে হবে বামপন্থীদেরই। তোলাবাজদের হাত থেকে গরিবের পঞ্চায়েতকে রক্ষা করতে হবে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তোমরা পারবে। আমি আমার সর্বশক্তি দিয়ে তোমাদের পাশে থাকব!” মোবাইল বন্ধ হতেই রাসমাঠ জুড়ে হাততালির ঝড়!
এর আগে জেলার কর্মসূচিতে যেতে না-পেরে মোবাইলে বার্তা দিয়েছেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দলের পার্টি কংগ্রেসে বা নির্বাচনী সমাবেশে ভিডিও-বার্তা পৌঁছেছে জ্যোতি বসুর। কিন্তু বুদ্ধবাবুর সমাবেশে রেজ্জাকের মোবাইল-ভাষণ পঞ্চায়েত ভোটের আগে দক্ষিণ ২৪ পরগনা সিপিএমের ভাঁড়ারে নিঃসন্দেহে নতুন রসদ!
বস্তুত, বারুইপুরে জেলা বামফ্রন্টের এ দিনের সমাবেশে বক্তা তালিকাতেই ছিলেন রেজ্জাক। কিন্তু তাঁর উপরে হামলা এবং সেই কারণে তাঁর অনুপস্থিতি গোটা জমায়েতেই নতুন মাত্রা যোগ করেছিল। মাঠ ছাপিয়ে আশেপাশের রাস্তায় ভিড়। |
যাদের উদ্দেশে রেজ্জাকের বার্তার অব্যবহিত পরেই বুদ্ধবাবুও বললেন, “গ্রামাঞ্চলের মানুষ তৈরি হোন পঞ্চায়েত ভোটের জন্য। যে কোনও দিন পঞ্চায়েত ভোটের ঘোষণা হয়ে যাবে। আমরা তিলে তিলে পঞ্চায়েত তৈরি করেছিলাম। পঞ্চায়েত ছিল গ্রামের মানুষের সরকার। এখন পঞ্চায়েতের অফিসে শুধু দুর্নীতি আর গুন্ডামি!” সার্বিক নৈরাজ্য মোকাবিলায় রেজ্জাকের মতোই বুদ্ধবাবুরও দাওয়াই ‘মানুষের জোট’। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, “এত চুরি, এত তোলাবাজি! পাড়ায় পাড়ায় শুধু সমাজবিরোধীরা কথা বলবে? মেয়েরা সন্ধ্যার পরে বেরোতে ভয় পাবে? পাড়ায় পাড়ায় তৈরি হোন, জোট বাঁধুন! একে রুখতেই হবে! মানুষ রুখে দাঁড়ালে এ সব চলবে না!” ঘটনাচক্রে, মুকুন্দপুরের হাসপাতাল থেকে আজ, সোমবারই ছুটি পাওয়ার কথা রেজ্জাকের। আরাবুল-বাহিনীর হাতে আক্রান্ত রেজ্জাকের পাশে যে ভাবে গোটা সিপিএম দাঁড়িয়েছে, যে ভাবে দলে তাঁর কদর বেড়েছে, হাসপাতাল থেকে বেরোনোর পরে তাঁর জন্য অভিবাদন অপেক্ষা করবে বলাই বাহুল্য! আক্রান্ত রেজ্জাকের এখন এতটাই মূল্য যে, কৃষক সভার যাবতীয় কমিটি থেকে তিনি নিজে আগাম ছুটি চাইলেও মুক্তি সম্ভবত হচ্ছে না ‘চাষির ব্যাটা’র। মালদহে সিপিএমের কৃষক সভার যে রাজ্য সম্মেলন আজ শেষ হচ্ছে, সেখানে নতুন কমিটিতে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রেজ্জাকের নাম রেখে দেওয়ারই পক্ষপাতী দলের একটি বড় অংশ।
তবে শুধু ‘চাষির ব্যাটা’ নয়, বুদ্ধবাবুরা চাইছেন শিল্পের পক্ষে জোরালো সওয়াল কর্মসূচিতে রেখেই পঞ্চায়েত ভোটে নামতে। আগামী ৩১ জানুয়ারি ও ১ ফেব্রুয়ারি আলিমুদ্দিনে সিপিএমের রাজ্য কমিটির বৈঠকে শিল্পায়নের প্রসঙ্গে এই মর্মেই আলোচনা হওয়ার সম্ভাবনা। তার আগে এ দিন বুদ্ধবাবু পরিষ্কারই বলেছেন, “শুধু চাষবাস নিয়ে থাকলে এগোতে পারব? ছেলেমেয়েরা ক্ষমা করবে কেন? বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে বেরিয়ে কি চাষ করতে যাবে? পাঁচ বছর পরে রাজ্যটা কোথায় যাবে, ভাবতে হবে না?”
দক্ষিণ ২৪ পরগনায় এ বার বামেদের সামনে জেলা পরিষদ পুনরুদ্ধারের লড়াই। সেই নিরিখে এ দিনের ভিড়, সমাবেশ শেষে বুদ্ধবাবুকে ঘিরে মহিলাদের আছড়ে পড়া, পায়ে হাত দিয়ে প্রণামের হিড়িক ইঙ্গিত বামেদের পক্ষে স্বস্তিজনক। বুদ্ধবাবুর প্রতিক্রিয়ায়, “এই মাঠে আগেও মিটিং করেছি। কিন্তু আজ মনে হচ্ছিল, রাস্তা থেকে মাঠে ঢুকতেই পারব না!” মঞ্চ থেকে নেমে সিপিআইয়ের রাজ্য সম্পাদক মঞ্জুকুমার মজুমদার তবু সাবধানী, “ভিড় দেখলেই কি সব বোঝা যায়? তবু একটা আন্দাজ পাওয়া যায়। সেটা বেশ ভাল!”
ভোট এখনও ভবিষ্যতে। বুদ্ধ-রেজ্জাকের এক সুরে দক্ষিণ ২৪ পরগনা আপাতত স্বস্তিতে। জেলা সম্পাদক সুজন চক্রবর্তী বলতে পারছেন, “যত আক্রমণ হবে, তত মিছিল লম্বা হবে!” |